The Mirrow

বিদ্যাসাগর : সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র চিন্তার চির-উন্নত এক ধ্বজা

Share the Article

রাহুল রায়

যে কোনো নতুন চিন্তার উন্মেষের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয় প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা। সমাজপতিদের দ্বারা পরিচালিত সমাজে প্রচলিত নিয়ম নীতি যতই ঘুণে ধরা হোক না কেন, সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সেই ব্যবস্থাতেই অভ্যস্থ হয়ে পড়ে। অত্যাচারিত হতে হতে এমন একটা জায়গায় মানুষ চলে যায় যেখানে অত্যাচারী ব্যবস্থাটাই তাদের কাছে স্বাভাবিক হয়ে যায়। সমাজপতিরা তখন বিভিন্ন কলাকৌশলে সেই ব্যবস্থাটাকে মহিমামণ্ডিত করে মানুষের কাছে তুলে ধরেন। সামাজিক ঐতিহ্য রক্ষার নামে সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন পাশে নিয়ে সংকীর্ণমতি সমাজপতিরা নিজেদের স্বার্থরক্ষার্থে নতুন চিন্তাকে গোঁড়াতেই শেষ করতে উঠেপড়ে লেগে যান। সেখানে দাঁড়িয়ে কিভাবে লড়াই করে নিজের মতকে প্রতিষ্ঠা করতে হয় তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবন সংগ্রাম। জীবনের প্রতিটি পদে তাঁকে এই সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে লড়াই করতে হয়েছিল। বিধবা বিবাহের প্রচলন, নারী শিক্ষার বিস্তার, শিক্ষাব্যবস্থার আধুনীকরণ প্রতিটি জায়গাতেই তাঁকে পাহাড়প্রমাণ বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে । উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় বিধবা বিবাহের পক্ষে স্বাক্ষর পড়েছিল ৯৮৭টি, সমাজপতিদের সৌজন্যে এর বিপক্ষে স্বাক্ষর পড়েছিল ৩৬৭৬৩ টি। রাধাকান্ত দেবের মতো তৎকালীন সমাজের প্রভাবশালী লোকেদের নেতৃত্ব যেমন তার বিরুদ্ধে বিরাট জনমত গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়েছিল, তেমনি  সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিম চন্দ্র এমনকি পরবর্তীতে স্বামী বিবেকানন্দ পর্যন্ত বিধবা বিবাহ নিয়ে তাঁর অবদানকে মর্যাদা দিতে গররাজী ছিলেন। কিন্তু কোনো কিছুই তাঁর পথরোধ করতে পারেনি। অথচ সমাজ ও সংখ্যাগরিষ্ঠের চিন্তা করলে বিদ্যাসাগরকে তক্ষুণি পিছিয়ে আসতে হতো। বিদ্যাসাগর পিছিয়ে আসেন নি, দীপ্ত মননে এগিয়ে গিয়েছিলেন। শুধু অন্যদের বিধবা বিবাহে উৎসাহ দিয়ে তথা বিয়ের সব আয়োজন করেই ক্ষান্ত হননি, নিজের ছেলের সঙ্গেও একজন বিধবা মহিলার বিবাহ দিয়েছিলেন। ‘আমি দেশাচারের নিতান্ত দাস নহি ; নিজের বা সমাজের মঙ্গলের নিমিত্ত যাহা উচিত বা আবশ্যক বোধ হইবে, তাহা করিব । লোকের বা কুটুম্বের ভয়ে কদাচ সংকুচিত হইব না’।

ভারতীয় সমাজে আজও মহিলাদের অবস্থান মোটের ওপর ছেলের তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে । বিদ্যাসাগর বুঝেছিলেন যুগ যুগ থেকে শিক্ষার পবিত্র আলো থেকে বঞ্চিত হয়ে মহিলারা খুব স্বাভাবিক ভাবেই এদেশে পিছিয়ে পড়েছিলেন। নারীশিক্ষার প্রসারে শুধু কয়েকটি স্কুল খুললেই হবে না। তারা সংস্কৃতি রক্ষার তথাকথিত দায়িত্ব মাথায় নিয়ে মেয়েদের পথ আগলে দাঁড়াবে। এই সমস্যা সমাধানে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সচেতনা সৃষ্টি করতে হবে। মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে গ্রামের পর গ্রাম ঘুরতে শুরু করলেন। পথে অনেক বাধা, অনেক অপমান, অনীহা তার সঙ্গী হয়েছিল। তাঁকে থামানো যায়নি, সমাজ ও সমাজপতিদের রক্তচক্ষু কোনোদিনই তাঁর গতি কমাতে পারেনি। যে সময়ে মেয়ে ঘরের বাইরে আসতে চাইতো না, বিদ্যাসাগর সমাজ ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতকে আস্তাকুড়ে ছুঁড়ে তাঁদের কাছে শিক্ষার বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন। একই মনোভাব আমরা দেখি উচ্চশিক্ষার পাঠ্যক্রম থেকে সাংখ্য ও বেদান্ত দর্শন সরিয়ে নেওয়া নিয়েও। “বেদান্ত ও সাংখ্য যে ভ্রান্ত দর্শন, এ সম্বন্ধে এখন আর মতদ্বৈত নাই। মিথ্যা হইলেও হিন্দুদের কাছে এই দুই দর্শন অসাধারণ শ্রদ্ধার জিনিষ। সংস্কৃতে যখন এগুলি শিখাইতেই হইবে, ইহাদের প্রভাব কাটাইয়া তুলিতে প্রতিষেধকরূপে ইংরেজীতে ছাত্রদের যথার্থ দর্শন পড়ানো দরকার।” আজকের দিনেও কোনো শিক্ষাবিদ এই মন্তব্য করলে কিছু সময়ের মধ্যেই তার বাড়ির সামনে মারমুখী জনতার ভিড় জমে যাবে । আজ থেকে দেড়শত বছরের আগে ধর্ম তথা সমাজপতিদের এক কোণায় ঠেলে নির্ভিক চিত্তে বিদ্যাসাগর এই কথা বলেছিলেন। শিক্ষাব্যবস্থাকে ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। কারণ ধর্মীয় শিক্ষার ফল যে কত মারাত্মক হতে পারে তিনি তা ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলেন। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে সমাজপতিদের ভয়ে চুপ করে বসে থাকাটা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। অবশেষে যা হওয়ার তাই হয়, তার অদম্য মানসিকতার কাছে আবারও পরাজিত হতে হয় সমাজপতি তথা সংখ্যাগরিষ্ঠের সংকীর্ণ অবস্থানকে।

( রাহুল রায় একজন সমাজকর্মী ও লেখক। )

3 thoughts on “বিদ্যাসাগর : সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র চিন্তার চির-উন্নত এক ধ্বজা”

  1. সুদীপ্ত দেবরায়

    ভালো লাগল । বিদ্যাসাগরের মত পুরুষ এখনো under studied এমনকি বাঙালিদের কাছেও

  2. Monolina Nandy Roy

    সামাজিক প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধ লড়াইয়ের দীর্ঘ পথ বিদ্যাসাগর অতিক্রম করেছিলেন চারিত্রিক দৃঢ়তার গুনে l যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের ওপরে চাপানো হয় স্বার্থপর কতিপয় সমাজপতিদের অবৈজ্ঞানিক সামাজিক মতাদর্শ lস্বীয় স্বার্থ রক্ষায় তারা তৈরী করেছিল এক ক্ষয়িষ্ণু সমাজেরll ,সেখানে জিতে গেলেন ঈশ্বরচন্দ্র তিঁনিই হয়ে গেলেন সংখ্যাগুরুর মেশিহা lযুক্তি ধৈর্য এবং প্রত্যয়ের জোরে,হয়ে গেলেন প্রগতিশীল যুক্তিবাদী মননের.পথপরিচালক, মানুষের মুক্তির দিশারী l আশাবাদী মনকে সম্বল করে এটুকু বলা যেতেই পারে কোনো সমাজে যদি ধর্মীয় গোঁড়ামি সমাজ রাষ্ট্র পরিচালনার হাতিয়ার হয়, সেই সাময়িক মোহ কাটিয়ে ভারত আত্মার মূল সুরে সুর মেলাতে সংখ্যাগরিষ্ঠই এগিয়ে আসবে ঈশ্বরসৃষ্ট (ঈশ্বরচন্দ্র ) পথকে মূল দিশায় পৌঁছতে ঈশ্বর মননে চেতনে, জাগ্রত সত্তার প্রতীক 🙏

Leave a Reply to Monolina Nandy Roy Cancel Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!