The Mirrow

একটি একান্নবর্তী পরিবারের মাতৃবন্দনা : প্রসঙ্গ গ্রাম বরাকের লোকায়ত পরিসর

Share the Article

বিবেকানন্দ মোহন্ত

এক

সরসপুর পাহাড়ের কোল থেকে বেরিয়ে কয়েকটি উঁচু-নীচু টিলার শ্রেণিমালা মাইল খানেক এগিয়ে গিয়ে পর পর বিলীন হয়েছে বিস্তীর্ণ সমতল প্রান্তে, যেটিকে শনবিলের উপরাংশ বললেও অত্যুক্তি হবে না। অন্যূন পনেরো বর্গমাইল এলাকা বিস্তৃত এই শস্য-শ্যামলা সমতল ক্ষেত্রের দু’পাশ বেয়ে প্রবাহিত হচ্ছে দু’টি নদী। পূর্বপ্রান্তে সিংগী এবং পশ্চিম প্রান্তে সিংলা, উভয়েরই গন্তব্যস্থল শনবিল। সরসপুর পাহাড় এবং এই বিস্তীর্ণ কৃষিপ্রান্তরের মধ্যবর্তী টিলাভূমিতেই শ্রীশ্রীকালীমাতার আশ্রয়ে বেড়ে উঠেছিল বহুশতাব্দী প্রাচীন কালীনগর গ্রাম। এই কালীনগর এবং সরসপুরের অংশবিশেষ নিয়েই আজকের রামকৃষ্ণনগর জনপদ।

খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতকের ইটা পরগণার অধিকারী হুকমত রায় নামীয় তালুক অধীন কালীনগর এলাকাটি অষ্টাদশ শতক থেকে সিলেটের দেওয়ান মানিকচাঁদের জমিদারির অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং এ পরিবারের নামাঙ্কিত “সুরুচিগঞ্জ” কাছাড়ি এই গাঁয়েই গড়ে উঠেছিল। যোগাযোগের মাধ্যম ছিল নৌপথ। সিংগীর বুক বেয়ে কুমার বাহাদুরের বাহারি নৌকো এসে ভিড়ত কাছাড়ি ঘাটে। এই নদীটির সংযোগকারী শাখা এসে বিলীন হয়েছে আমাদের বাড়ির ঘাটে, বাল্যের বহু স্মৃতিবিজড়িত এই খেয়াঘাটে!

কৃষিনির্ভর এই গ্রামটিতে বিভিন্ন পেশার লোকজনদের বাস – যেখানে ব্রাহ্মণ ছাড়াও ছুতোর, কামার, তন্তুবায়, কলু, ময়রা, নাপিত, রজক এবং দূর গাঁয়ে মৎস্যজীবি হিন্দু সম্প্রদায়ের বসতি রয়েছে। আমাদের গাঁয়ের মতই দূর গাঁয়ের পদ্মারপারেও লোকসংস্কৃতি চর্চায় কোনো খামতি ছিলনা। এই পরিসর আমাদেরকে উপহার দিয়েছে বিখ্যাত পাখোয়াজ বাদক নীরদ বায়েনকে। মনসামঙ্গল – পদ্মাপুরাণ পালায় নৃত্যের তালে তালে পাখোয়াজ নিয়ে তাঁর পায়তারা আজও স্মৃতিতে অটুট।

যাই হোক, আমাদের গ্রাম কিংবা পড়শি পরিসরের ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট পেশায় নিয়োজিত লোকদের কিন্তু মূল জীবিকা ছিল কৃষিকর্ম। ব্রাহ্মণ ছাড়া প্রতিটি একান্নবর্তী পরিবার থেকে হাল নিয়ে মাঠে নামত কম করেও দশ-বারো জন লোক। যথারীতি প্রকৃতিও তার অপরূপ সাজে ধরা দিত আমাদের চোখে।

আমাদের গ্রামীণ পরিসরে কায়-কারবারের মাধ্যম ক্ষেত্রবিশেষে মুদ্রার বিনিময়ে হয়ে থাকলেও পণ্য বিনিময় প্রথা অর্থাৎ বার্টার সিস্টেমই ছিলো মূল চালিকাশক্তি –  যেটি আমাদের গাঁয়ে বহাল তবিয়তে ছিলো সত্তর-আশির দশক অবধি। নাপিত অর্থাৎ নরসুন্দরদের মধ্যে বন্টন করা থাকত কোন্ কোন্ বাড়ির ক্ষৌরকর্ম কার কার আওতাধীন। তারাও নিয়ম অনুযায়ী নির্দিষ্ট বারে এক একটি বাড়িতে গিয়ে হাজির হতেন। আমাদের বাড়ির ক্ষেত্রে সেটি ছিল প্রতি রোববার। তাদের অনুশাসনে আমরা ছোটোদের “পাতিল ছাট” কেশবিন্যাস বাহারি রূপ ধারণের কোনো সুযোগই পেতোনা; বরং নিয়ম মেনেই প্রতি রোববার এদের উপর চলত ক্ষুর-কাঁচির নির্মম অত্যাচার। বছর শেষে পৌষমাসে ওরা ‘ফসল’ তুলত, আমাদের পরিবারের প্রদেয় মাশুল ধার্য ছিলো বার্ষিক বারো মণ ধান। অন্যান্য খাতে বিশেষত ময়রা, কলু/তিলি, রজকের প্রাপ্য মাশুল ছিলো ক্ষেত্রবিশেষে ছ’সাত মণ ধান। অনুরূপভাবে বাড়ির পরিচারক-পরিচারিকাদেরকেও বার্ষিক কিংবা মাসোহারা মিটিয়ে দেওয়া হত সেই  বার্টার সিস্টেমই।

দুই

আমাদের একান্নবর্তী পরিবারটি কিন্তু জমিদার, মিরাশদার, তালুকদার  কিংবা  জোতদার  কোনোভাবেই  ছিলোনা, ছিলো সম্পন্ন গৃহস্থ পরিবার। তবে, জমিজমা নেহাত কম ছিল না। ১৯৫২-৫৩ কিংবা ১৯৭২-৭৩ সালের  সিলিং প্রক্রিয়ায়  মোট জমির পরিমাণ কমে গিয়েও নিদেনপক্ষে হাল তিরিশ-পঁয়ত্রিশে এসে ঠেকেছিল। যৌথ  পরিবারে বাপ-কাকাদের পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে চারজনই ছিলেন কেন্দ্রীয় কিংবা রাজ্য সরকারের  চাকুরে, যেটা একটি প্রান্তিক তথা বর্ধিষ্ণু গ্রামের ক্ষেত্রে অভাবনীয় বৈকি! পরবর্তী প্রজন্মের আমরা পনেরো ভাই – ষোলো বোন, আত্মীয় -অনাত্মীয়, পরিচারক – পরিচারিকা মিলে এই পরিবারের সদস্য সংখ্যা ষাট- সত্তর তো ছিলই। বারো মাসে তেরো পার্বন এই পরিবারের  সাথে অঙ্গাঙ্গী ভাবেই জড়িত ছিল, যার মধ্যে অন্যতম হলো ফি-বছরের দুর্গাপূজো – যেটি চলে আসছিল ১৯১৫ সাল থেকে।

পেশাদারি মৃৎ শিল্পালয় এই অঞ্চলে ছিলোনা এবং আমরাও সেই পথ মাড়াবার প্রয়োজন বোধ করিনি, কারণ আমাদের পারিবারিক শিল্পী হিসেবে রয়েছেন হরিনগর গ্রামের শ্রেষ্ঠ কারিগর বিনোদ আচার্য মশায়। আমাদের বাড়িতে এসেই তিনি এ কাজে হাত লাগাতেন। মৃন্ময়ী প্রতিমার চিন্ময়ী রূপ ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর জুড়ি মেলা ভার ছিলো। তাঁকে কখনোই আমরা ছাঁচ কিংবা ডাইসের ব্যবহার করতে দেখিনি, তা সত্বেও তিনি বিগ্রহে নিখুঁত তক্ষণ চর্চার স্বাক্ষর রেখে যেতেন। বরাবর একচালা কাঠামোর রীতি প্রচলিত ছিলো আমাদের দেবী আরাধনায়। এই অনুপম শিল্প কর্মটি আগাগোড়া তিনি একাই করে যেতেন, তবে শুধুমাত্র আসন – বসন- রঙয়ের প্রলেপ দেওয়ার পর্বেই নিয়ে আসতেন পরিবারের অন্যদেরকে।

শহরাঞ্চলের শিল্পীরা প্রতিমা নির্মাণ করতে গিয়ে যেসব হাতিয়ার ব্যবহার করে থাকেন – সেসবের কোনো প্রয়োজন পড়ত না আচার্যী মশায়ের। বাঁশ, কাঠ এসব দিয়েই তিনি কাজটি সেরে নিতেন। এই কাজে খুব পাতলা বাঁশের ফালি (বাঁশের টল) খুব উপযোগী ছিলো — যেটি সুঠাম দেহসৌষ্ঠব, বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নিখুঁত রূপটি ফুটিয়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা নিত। আমরা তন্ময় হয়ে সেসব দেখতাম, মাঝে মধ্যে গাঁয়ের আর পাঁচজনও দর্শক হিসেবে এই আসরে এসে জুটতেন। সময়াসময় আমরা কারিগরকে  ক্ষেপাতামও। কখনও বা কোনো বিগ্রহের কনিষ্ঠা কিংবা তর্জনী, অসুর কিংবা সিংহের একটি বা দু’ টি দাঁত খুঁজে পাওয়া যেত না। পরদিন এসে তাঁর সন্ধানী দৃষ্টি পরখ করে চলত  কোথায়  কী ধরণের নাশকতামূলক কর্ম সম্পাদিত হয়েছে —  যেটি তাঁর প্রাত্যহিক রুটিন তল্লাশির মধ্যেই পড়তো। খানিক দূর থেকে চেয়ে থাকতাম মাটির চাড়ায় কাদামাটির মণ্ড থেকে কয়েক খাবলা উনি তুলছেন কি না, তেমনটা হলে প্রাণপণ দৌড়ে নাগালের বাইরে চলে যেতাম। কখনও বড় পুকুরের চারদিকে ছুটতাম – তিনি  পেছন পেছন তাড়া করতেন, হাতে থাকতক চাড়া ও মাটির ঢেলা। আমাদের লক্ষ্য করে বার দু’এক ঢিলও ছুড়তেন। একসময়  পরিশ্রান্ত হয়ে পুকুরের এক কোনে থাকা কাশবনে বসে পড়তেন। তারপর একটু জিরিয়ে নিয়ে সিদ্ধিতে ডুব দিতেন। এ অভ্যাসটি তাঁর ছিল, পুকুরের কিনার থেকে কাদামাটি তোলার ফাঁকে বার কয়েক কাশবনে লুকিয়ে গঞ্জিকা সেবন করাটা তাঁর রুটিনের মধ্যেই পড়ত। আমরাও সুযোগ বুঝে ব্ল্যাকমেল করতে ছাড়তাম না, বলতাম – জেঠুকে এক্ষুনি গিয়ে বলছি। তিনি জিব কেটে মিট মিট করে হাসতেন শুধু।

তিন

গ্রাম বরাকের লোকায়ত পরিসরের এক একটি একান্নবর্তী পরিবারের বার্ষিক উৎসবটি কিন্তু সংশ্লিষ্ট পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো না এবং সেটি ছিলো সামাজিক মেলবন্ধনের প্রধান উৎস। সুতরাং এই দুর্গোৎসব পর্বটিও এই গাঁয়েরই উৎসব হিসেবে বিবেচিত হতো। তাই পরব এবং তার পূর্বাপর যাবতীয় জোগাড়-যন্তর ব্যবস্থাপনায় আর পাঁচজন এগিয়ে আসতেন  স্বতঃস্ফূর্তভাবে, এখানে পারিশ্রমিকের কোনো প্রশ্নই উঠত না। তাই দেখা যায়, মাসভর রান্নাবান্না, খাওয়া-দাওয়ার প্রয়োজনে জ্বালানি লাকড়ি, রামকলার পাতা কিংবা কিত্তা পাতা সংগ্রহে এই গাঁয়ের লোকেরাই দলবেঁধে বেরিয়ে পড়তেন এবং আহরণ করে আনতেন সরসপুরের পাহাড়িয়া অঞ্চল থেকে। প্যাণ্ডেল-শামিয়ানা টাঙানোয় হাত লাগাতেন এ বাড়ির সদস্যদের সাথে এ গাঁয়ের ছেলে-বুড়োরাও। এক্ষেত্রে স্থায়ী মণ্ডপের বাইরে উঠোনে বড় মাপের প্যাণ্ডেল তৈরি হত, আচ্ছাদন হিসেবে থাকতো সুবিশাল প্যারাসুট, Indian Air Force-এর Commissioned Officer মেজোকাকুই সেটি এনেছিলেন একসময়।

আমাদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে অন্যান্য বহুতর উপাদানের মধ্যে একটি ছিলো  ‘ডে-লাইট’ অর্থাৎ হ্যাজাক লাইটের যথাস্থানে প্রতিস্থাপনপর্ব। কারণ পরব-পার্বণ ছাড়া বাকি সময়ে ওরা  গায়ে ঘুমটা টেনে বিশ্রাম নিত বড় ঘরের ছাদের হুকে। আবাহনী পর্বে তাদের নামিয়ে এনে প্রতিষ্ঠা করা হতো প্যাণ্ডেল-মণ্ডপে। যুক্তরাষ্ট্র নির্মিত এই ‘কোলম্যান লাইট’ অর্থাৎ হ্যাজাকটি কিন্তু সচরাচর ব্যবহৃত হওয়া পেট্রোমাক্স নয়। এটির কেরোসিনের ট্যাঙ্কটি থাকে উপরে এবং ম্যান্টল-চিমনি থাকে এর ঠিক নীচে, এখানে পাম্প দেওয়ার কোনো দরকার পড়েনা। রশি টেনে এদেরকে উপরে টাঙ্গানো হয়। পুজোর সময় এক একটি পাঁচ-ছ’শো ওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এরূপ চার-পাঁচটি বাদুর সদৃশ হ্যাজাক লাইটের আলোর বন্যায় ভেসে যেত এ বাড়ির চত্বর- মণ্ডপ।

উৎসব উপলক্ষ্যে মূল বাজারটি করতেন জ্যাঠামশায়। এজন্য তিনি হাট বারে হেঁটে হেঁটেই গিয়ে হাজির হতেন আয়নাখাল বাজারে, ভারবাহী হিসেবে গাঁয়ের ক’জন তাঁর সঙ্গী হতেন। অপরদিকে প্রতিমার সাজ-সজ্জা, অলঙ্করণ, আয়ূধ ইত্যাদির জন্য বড়দাদারা শিলচর জানিগঞ্জ যেতেন। বিভাগপূর্বে বাবা-কাকারা ঐসব নিয়ে আসতেন সিলেট থেকে।

মহাষষ্ঠী থেকে শুরু করে পুজোর ক’দিন ভোর থেকেই শুরু হয়ে যেতো  পাঁকশালের মহাযজ্ঞ, আনাজ- সব্জি কাটতে মা-ককিমাদের সাথে এসে যোগ দিতেন এপাড়া-ওপাড়ার বউ-ঝিরাও। এবাড়িতে সম্পূর্ণভাবে নিরামিষ ব্যবস্থাপনা থাকত উৎসবের এই ক’দিন।

চার

দুর্গোৎসবের এই চার-পাঁচদিনের আনন্দঘন মুহুর্তকে ধরে রাখার জন্য যেমন ছিল খোল-করতাল সহযোগে সমবেত কীর্তন, আরতি গান (ঠাঁট গান, ঠাঁট নৃত্য), পদ্মাপুরাণ, ওঝাগান-ওঝানৃত্য, তেমনি ছিল স্থানীয় কুশীলবদের অভিনীত মনসামঙ্গল কিংবা নৌকাবিলাশের পালাও। সেজন্য গাঁয়ের এবাড়ি-ওবাড়িতে চলত সান্ধ্যকালীন মহড়াপর্ব। প্রতি সন্ধ্যায় কানে আসত পাখোয়াজ-মৃদঙ্গের মন মাতানো বোল কিংবা করতাল- মন্দিরার রিনিঝিনি ঝংকার, চলত গভীর রাত অবধি। মন চাইত এদের ওখানে একটু উঁকি দিয়ে দেখে আসি। কিন্তু আমাদের বাড়িতেও আকর্ষণের তেমন কোনো খামতি নেই,  হৈ হুল্লোড়-হাসিতামাসা, আত্মীয়স্বজন-পরিজনে যে গমগম করছে এই পরিসরটিও!

পুজোর দিনগুলিতে রাতভোরে জেগে উঠে বড় বড় সাজি নিয়ে ফুল তুলতে বেরোতাম, গাঁয়ের অন্যরাও এতে সামিল হতেন। কেউবা পদ্মফুল সংগ্রহে ছুটে যেতেন দূর-দূরান্তের লক্ষ্মীনগর চা-বাগান অবধি, সেখানকার প্রাকৃতিক জলাশয়ে অজস্র পদ্মফুল ফুটত, আজও ফুটে ওখানে। এই সুদীর্ঘ পথচলায় কখনও পায়ে ব্যথা অনুভব করিনি কোনোদিন। পুজোর ক’দিন সপরিবারে কুলপুরোহিত রসময় গোস্বামী-বাবুলালদার সম্পূর্ণ শাস্ত্রীয় উপচার-বিধি মেনে দেবী আরাধনা, কর্মসম্পাদনে যেমন আমাদের মনকে পবিত্র করে তুলত, ঠিক তেমনি এই অর্চনাকে ঘিরে পরিশীলিত হওয়া সুপ্রাচীন লোকায়ত সংস্কৃতির স্বরূপ এবং ধারাটিও এ বাড়ির উৎসবকে পৌঁছিয়ে দিত অনুপম-অতুলনীয়ের শীর্ষস্তরে!

এসবের মধ্যে পুজোর আরতি গান বা ঠাঁটগান- ঠাঁটনৃত্য ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং চিত্তাকর্ষক। এ নৃত্যের বহুল চর্চা পরিলক্ষিত হয়ে থাকে গ্রাম করিমগঞ্জের সুপ্রাচীন লোকায়ত পরিসরে। আমার জ্যাঠামশায় ছিলেন এই গানে পারদর্শী এবং প্রধান পৃষ্ঠপোষকও। পুজোর সপ্তমী থেকে নবমী এই তিনদিনই সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হতো এই আরতি গান। আমাদের গ্রাম ছাড়াও দূরগাঁয়ের লোকেরা এই আসরে এসে অংশগ্রহণ করতেন। প্রায় কুড়ি-পঁচিশ ফুট ব্যাসের বৃত্ত পরিধি জুড়ে ঘুরে ঘুরে গান ও নৃত্য সহযোগে এই আরতি পর্বটি চলতো। জনা চল্লিশেক কলাকুশলীদের পরিবেশিত এই গীতিনৃত্যে বাদ্যযন্ত্র হিসেবে থাকতো দু’ তিনটি মৃদঙ্গ, ত্রিশ-পয়ত্রিশটি রামকরতাল এবং কাঁসর। এই আরতি চলাকালীন মাঝে মাঝে বাদ্যযন্ত্র ভূমিতে রেখে হাত-পায়ের কসরত সহযোগে বিভিন্ন ঢঙে পাক খেয়ে খেয়ে নিজ নিজ যন্ত্র আবার হাতে তুলে নেওয়া হত। আরতি পরিবেশনায় কখনও Clockwise আবার কখনও anti-clockwise direction-এ পরিক্রমা করেও এই গীতিনৃত্যটি চলত। এভাবেই এক একটি দোহা বা গান পরিবেশন করা হত দীর্ঘ সময়ব্যাপী। এক শ্বাসে “ওঁ তারা মা ———-” গানের কলি দিয়ে  কীর্তনীয়ারা যে পাকদণ্ডী সুর তুলতেন বিভিন্ন সুর-ছন্দ-তাল-লয়- ঝংকারে , সেটা নেমে আসতো সেই একই পথ বেয়ে। এবং উঠা-নামায় সময় নিত দুই মিনিটেরও বেশি, কেননা সুদীর্ঘ বৃত্ত পরিধি এক চক্কর শেষ হওয়ার পরও এটির স্থায়ীত্ব থাকত আরও দূরতক্। নয়নাভিরাম এবং মনোমুগ্ধকর এই আরতি অনুষ্ঠান চলত রাত গভীর অবধি।

আজ মনে হয় এই ধরণের গীতিনৃত্য পরিবেশনা যে কতটুকু মানসিক এবং কায়িক শ্রমনির্ভর সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা। এত ভারী ভারী রামকরতালের কর্মকুশলতা দেখিয়ে যাঁরা অবলীলায় এই  কাজটি করে যেতে পেরেছিলেন, তাঁদের মনোবল এবং দেহবল আমাদের মত এত পলকা ছিলনা।

আরতি গান, দ্বিপ্রাহরিক কীর্তন ছাড়াও ছিল অন্যান্য শাস্ত্রীয় এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এরমধ্যে পদ্মাপুরাণের কথা একটু বলতে হয়। এই গান পরিবেশন করতেন আমাদের গাঁয়েরই হরেন্দ্রমামা এবং বায়েন হিসেবে  আসর মাতাতেন দূর গাঁয়ের নীরদ কাকু। মুখোমুখি দু’সারিতে বসতেন এপাড়া-ওপাড়ার গায়ক-যন্ত্রী-দোহাররা, মাঝে এবং উভয় সারির পেছনে থাকত চামরধারী ওঝা এবং পাখোয়াজধারী বায়েনের দৌড়ঝাঁপের দীর্ঘ পরিসর। দশমী ছাড়া বাকী তিনদিনের এক দুপুর বরাদ্দ থাকতো ওঝা নৃত্যের জন্য। নৌকাবিলাস বা অন্য পালার জন্য নির্ঘন্ট বের করা হত রাতের কোটা থেকে।

অপরদিকে পুরুষকেন্দ্রীক সংস্কৃতি চর্চার সমান্তরালে মহাষষ্ঠীর দিন থেকেই শুরু হয়ে যেত মেয়েদের পরিবেশিত আগমনী গান এবং ধামাইল নৃত্য। এই মহানৃত্যে পায়ে পা মেলাতেন সারা গাঁয়ের বৌ-ঝিরা, যেটি গোটা শারদীয় পর্বকে এক ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছে দিত।

প্রতি বছরের এই সম্মিলিত  উৎসব পরবে এ বাড়িই ছিল নিকট কিংবা দূর গাঁয়ের পংক্তিভোজনের কেন্দ্রস্থল। এখানে আসন-কুসন, খাট-পিড়ির তেমন কোনো বালাই থাকতো না। স্থানীয় স্কুল থেকে যেটুকু আসন সংগ্রহ করা হত তার সাথে সংযোজন করা হত সারিবদ্ধ বাঁশের আসন। ধোয়া ওঠা প্রসাদ পরিবেশন করা হত নির্ভেজাল, শুচী-শুদ্ধ রম্ভা-কদলীপত্রে।

শেষকথা

সময়ের স্রোতে আজ বদলে যাচ্ছে গাঁয়ের অটুট বন্ধন, পারস্পরিক সম্প্রীতির বাতাবরণ, সুশৃঙ্খল সমাজ ব্যবস্থার রীতিনীতি  এবং অতি অবশ্যই  জনবিন্যাস। উপগ্রহ সংস্কৃতির দাপটে বাড়ছে আমাদের দৈনন্দিন  চাহিদা, আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখছে আমাদের আত্মকেন্দ্রিকতা এবং প্রতিযোগিতামুখীন চিন্তা-চেতনা। অপরদিকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিও  হয়ে উঠছে অগ্রাধিকারের  শীর্ষস্তরে। ফলে  গাঁয়ের এক একটি একান্নবর্তী পরিবার আজ ভেঙে খান খান হয়ে রূপান্তরিত হচ্ছে মাইক্রো ফ্যামিলিতে। যার দরুণ কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় এর প্রতিফলন বড় নির্মম হয়ে ধরা দিচ্ছে এক একটি লোকায়ত পরিসরে। এই সমাজ ব্যবস্থার সাথে ওতপ্রোতভাবে  জড়িত ছিল সাংস্কৃতিক পরিসর, সেটিও আজ ক্রমবিলীয়মান – অপসৃয়মান হয়ে দাঁড়াচ্ছে দিনকে দিন। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বিলীন হয়ে যাচ্ছে সমঝদার দর্শক-শ্রোতা, পৃষ্ঠপোষক (Sponsors) ও তাঁদের সুবিস্তৃত ঐশীভুবন-প্রাঙ্গণও।

ফলে অন্য অনেক কিছু হারানোর সঙ্গে সঙ্গে ক্রমান্বয়ে আমরা হারিয়ে চলছি আবহমান কাল ধরে পরিশীলিত  হয়ে আসা আমাদের  চিরন্তন পরিচিতি, আমাদের চিরায়ত সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের অনন্যসাধারণ রূপ ও রং।

2 thoughts on “একটি একান্নবর্তী পরিবারের মাতৃবন্দনা : প্রসঙ্গ গ্রাম বরাকের লোকায়ত পরিসর”

  1. Sanjib Deblaskar

    অতি সুখপাঠ্য স্মৃতি জাগানিয়া নিবন্ধ উপহার দিলেন বিবেকানন্দ। আগমনী এবং ঠাট গান নিয়ে একটি স্বতন্ত্র লেখার জন্য বিবেকানন্দকে অনুরোধ করব। খুব দেরি না করে এই পূজা পূজা আবহেই্।

Leave a Reply to Sanjib Deblaskar Cancel Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!