অরুনাভ সেন
বারাসতের প্রসিদ্ধ ডাক্তার নারী শিক্ষার প্রসারক নবীনকৃষ্ণ মিত্রের কন্যা কুন্তীবালার বিয়ে হয়েছিল কালীচরণ ঘোষের সঙ্গে, বিদ্যাসাগর মহাশয় নিজে এই বিয়ের ঘটক, তিনিই কৃষ্ণনগরে গিয়ে পাত্র দেখে আশীর্বাদ করেছিলেন৷ তবে অকালে পুত্রকে হারিয়ে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন কুন্তীবালা৷ মানসিক ভারসাম্য যখন তিনি হারিয়েছেন সেই অবস্থায় একদিন গোঁ ধরলেন বিদ্যাসাগর না খাইয়ে দিলে তিনি খাবেন না, এই সংবাদ গেল বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কাছে তিনি সব শুনে হেসে বললেন —’তা আর কি হবে,মেয়েটা কি না খেয়ে মারা যাবে, আমি দু’বেলা গিয়া খাওয়াইয়া আসিব’৷ তিনি সত্যিই কয়েক মাস ধরে দু’বেলা কুন্তীকে খাইয়ে আসতেন, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের এমন সহৃদয়তার অসংখ্য উদাহরণ গবেষকরা দিতে পারেন৷
তখনকার গণ্ডগ্রাম বারাসতে, ১৮৪৭ সালে বিদ্যালয় স্থাপন করতে প্যারীচরণ ও তাঁর সহযোগীদের কম হেনস্থা সহ্য করতে হয়নি। সেই সব ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে বারাসত কালীকৃষ্ণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়।
বাংলার নবজাগরণের অন্যতম প্রাণপুরুষ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে তাঁর বাড়িতে গিয়েছেন সেকালের অন্যতম জ্ঞান পিপাসু, সমাজ-সংস্কারক তরুণ শিবনাথ শাস্ত্রী৷ সেখানে উপস্থিত অনেক সাক্ষাৎপ্রার্থী। বাড়ির বাইরের দালানে অপেক্ষা করছেন শাস্ত্রী। এমন সময় হাসতে হাসতে সেখানে এলেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। বললেন, তোমরা একটু অপেক্ষা কর, আমি আহার-পর্ব শেষ করে এখনই আসছি৷ একটু পরেই তিনি আবার সেখানে এসে শিবনাথ শাস্ত্রীর মতো অন্য সাক্ষাৎপ্রার্থীদের সাথে হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কথায় হাসতে হাসতে সবাই ক্লান্ত হয়ে গিয়েছেন তখন তিনি তাঁর এক বন্ধুকে বললেন কিছু মুড়ি সেখানে যেন পাঠিয়ে দেয়৷ যথাসময়ে মুড়ি এল। প্রকাশ্য রাজপথের পাশে বারান্দায় বসে সবার সাথে তিনিও মুড়ি খেতে আরম্ভ করলেন৷ শিবনাথ শাস্ত্রী লিখেছেন ‘তাঁহার মত পদস্থ ও সম্মানার্হ ব্যক্তি যে এরূপ সরল ও সহজভাবে রাস্তার ধারে বসিয়া মুড়ি চিবাইতে পারেন, এ ধারণা কাহারও ছিল না’৷
বিদ্যাসাগর মহাশয় কেবল সুপণ্ডিত, সমাজ সংস্কারক ছিলেন এমন নয় বরং মানুষ হিসেবে তিনি সদাচারী, সদালাপী, অনায়াসে যে কোনও মানুষের হৃদয় জিতে নিতে তাঁর দেরী হত না৷ শিবনাথ শাস্ত্রীর বন্ধু ও তাঁর স্ত্রী এসেছেন কলকাতায় বেড়ানোর উদ্দেশ্যে, স্বামী-স্ত্রী উভয়েই তামিলভাষী মানুষ, নির্ভীক সমাজ সংস্কারক বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কথা তাঁরা শুনেছেন, উভয়ের ইচ্ছা বাংলার এই মনীষীকে দেখবেন৷ সেই ইচ্ছাপ্রকাশ তাঁরা বন্ধু শিবনাথের কাছে আগেই করে রেখেছেন৷ বন্ধুপত্নী ও স্বামী ভদ্রলোককে নিয়ে শাস্ত্রী মহাশয় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাড়িতে পৌঁছলে তিনি তাদের সাদরে গ্রহণ শুধু করেননি, পরে একদিন নিমন্ত্রণ করে শিবনাথ শাস্ত্রীর বন্ধু পত্নীকে একটি সুন্দর শাড়ি উপহার দিলেন৷ এরপর বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেল। শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর বাড়ির সামনে ঘোড়ার গাড়ি থামার শব্দে কিছুটা অবাক হয়েছেন। কেন অবাক হবেন না, গাড়ি থেকে নেমে এলেন বিদ্যাসাগর স্বয়ং। ত্রস্ত পদে বাড়ির মধ্যে ঢুকে বললেন, ‘কই হে, তোমার বন্ধুরা কই? আজই এক বিধবা বিবাহ হচ্ছে, এ অনুষ্ঠান দেখবার জন্য আমি তাদের নিতে এসেছি’৷ সেই অনুষ্ঠান থেকে ফিরে শাস্ত্রী মহাশয়ের বন্ধুবর ও তাঁর পত্নী বিদ্যাসাগরের এমন উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন যে অভিভূত হয়ে পড়েন শিবনাথ শাস্ত্রী নিজেই৷
সত্যি বলতে কি বিদ্যাসাগর মহাশয় সম্পর্কে হয়তো আলোচনা শুরু করা যায়, কিন্তু থামা যায় না। তার আগে শিবনাথ শাস্ত্রীর সতেরো বছরের কন্যার সঙ্গে তিনি কেমন রসিকতায় মেতে উঠেছিলেন সেই গল্প একটু শুনি৷ নিজের জ্যেষ্ঠা কন্যা হেমলতাকে তাঁরই অনুরোধে বিদ্যাসাগর মহাশয়ে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছেন শিবনাথ শাস্ত্রী৷ তখন পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্রের বেশ বয়স হয়েছে নানা আলাপ-আলোচনার পর শাস্ত্রী বিদ্যাসাগর মহাশয়কে বললেন তাঁর কন্যার মনে একটি আশঙ্কা আছে তিনি কি অবিবাহিতা নারীদের বেশি বয়স পর্যন্ত বিয়ে না হওয়া পছন্দ করেন! শুনে বেশ উচ্চস্বরে হাসলেন বিদ্যাসাগর মহাশয় তারপর হেমলতাকে বললেন ‘কি গো তুমি কি ভাবছ, বেশি বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেবার ব্যাপারে তোমার বাবাই শুধু বড় সংস্কারক ও বাহাদুর লোক৷ তুমি বুঝি জানো না যে আমি আমার কন্যাদের বেশি বয়সে বিয়ে দিয়েছি৷ তাদের বিয়ের বয়স তোমার চেয়েও বেশি হয়েছিল’৷ হেমলতার তখন সতেরো বছর বয়স। এরপরে রসিকতার স্বরে সেই আলাপচারিতায় হেমলতার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন—’তাছাড়া তোমার চিন্তা কি? বাবা যদি বিয়ে স্থির না-ও করেন আমি তো একটি উপযুক্ত পাত্র উপস্থিত রয়েছি৷ তুমি যেদিন বলবে সেদিনই তোমায় গিন্নী করে আমার বাড়িতে নিয়ে আসব’৷ তারপর সকৌতুকে হেমলতার চিবুক ধরে বললেন তাঁর কি বুড়ো বর পছন্দ হয়!
#######
বাংলার নবজাগরণের প্রাণপুরুষ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের উদ্যোগে ১৮৫৬ সালের ৭ ডিসেম্বর প্রথম ঐতিহাসিক বিধবা বিবাহ নিজের চোখে দেখেছেন শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয়৷ রাজকৃষ্ণ ব্যানার্জির সুকিয়া স্ট্রিটের ভবনে প্রথম বিধবা বিবাহের সেই স্মৃতি তাঁর জীবনে চিরউজ্জ্বল হয়ে ছিল৷ সে যুগের জ্ঞান-পিপাসু এক বাঙালি যিনি নিজের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন ‘আমার জীবনে সর্বপ্রথম যে বিরাট ব্যক্তিত্বশালী পুরুষের সংস্পর্শে আসিয়াছিলাম তিনি পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর৷’
শাস্ত্রী মহাশয় যখন সংস্কৃত কলেজের ছাত্র তখন বিদ্যাসাগর মহাশয় সেখানে অধ্যক্ষ৷ প্রথম থেকে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সমর্থক হিসেবে সমাজে নানা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন৷ এর নেপথ্যে হয়তো অনেক কারণের একটি শাস্ত্রী মহাশয়ের মাতুল দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সহপাঠী এবং পিতৃদেব হরানন্দ বিদ্যাসাগরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সতীর্থ ছিলেন৷ শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয় রাজকৃষ্ণ ব্যানার্জির সুকিয়া স্ট্রিটের ভবনে প্রথম বিধবা বিবাহের সাক্ষী৷ তিনি বলেছেন সেই স্মৃতি তাঁর জীবনে চির উজ্জ্বল হয়ে থাকবে৷
সেই কথা বরং শুনি শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয়ের নিজের লেখায় — ‘সকলের সঙ্গে আমিও বিবাহের অনুষ্ঠান দেখিতে গেলাম৷ বিবাহের দ্বারদেশে এক বিরাট শোভাযাত্রীদল আসিয়া পৌঁছিয়াছে৷ ইহার পুরোভাগে বিদ্যাসাগর মহাশয়, তাঁহার বন্ধুবান্ধব ও বিবাহের বরসহ বিরাজমান৷ অগণিত উৎসাহী দর্শকদের ভীড়ে তিল ধারণের স্থান নাই৷ তখনকার দিনে রাস্তার দুই পাশে গভীর নর্দমার খাদ দেখা যাইত৷ সেই রাত্রিতে কৌতূহলী জনতার চাপে তাহার মধ্যেও অনেক কে পতিত হইতে দেখা গিয়েছে’৷ অনুষ্ঠান শেষে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কলকাতায় উত্তেজনাপূর্ণ বিতর্ক নতুন করে শুরু হল। রাস্তাঘাট, পার্ক, বাজার, বৈঠকখানা সর্বত্র নারী-পুরুষের মুখে বিধবা বিবাহ বিষয়ের গল্প৷ শান্তিপুরের তাঁতীরা তৈরি করল শাড়ি, যে শাড়ির পাড়ে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দীর্ঘজীবন কামনা করে গানের কলি থাকত৷
বিখ্যাত সাপ্তাহিক পত্র ‘সোমপ্রকাশের’ সম্পাদকমণ্ডলীতে বিদ্যাসাগর মহাশয় আছেন। সেই কারণে শিবনাথ শাস্ত্রীদের বাসায় নিয়মিত আসতেন৷ তারপরেও দু’জনের যতবার দেখা হয়েছে বিদ্যাসাগরের অকৃত্রিম অফুরন্ত স্নেহ থেকে বঞ্চিত হননি তিনি৷ ১৮৬৮ সালে শিবনাথ শাস্ত্রীর সহপাঠী পণ্ডিত যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণের প্রথম পত্নীর বিয়োগের পর তিনি মানসিকভাবে কিছুটা বিপর্যস্ত, যোগেন্দ্রের আত্মীয় স্বজনদের ইচ্ছা তিনি আবার বিবাহ করুন৷ সর্বোপরি বিধবাবিবাহের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে উদার, শিক্ষিত তরুণদের মনে তখন একপ্রকার আলোড়ন উঠেছে৷ যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ সিদ্ধান্ত নিলেন তিনিও বিধবা বিবাহ করবেন৷ সৌভাগ্যক্রমে তাঁর মনের মত হিন্দু বিধবা কন্যার সন্ধান পাওয়া গেল, কিন্তু রক্ষণশীল সমাজ তখনও উদার হতে পারেনি। স্বাধীনভাবে এই বিবাহের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার সাহস দেখাতে পারলেন না বিদ্যাভূষণ, না পারলেন শিবনাথ শাস্ত্রী সহ অন্যরা৷ অবশেষে বিপন্নের বন্ধু ঈশ্বরচন্দ্রের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া উপায় থাকল না৷ সব শুনে বিদ্যাসাগর মহাশয় খুব আনন্দিত হলেন, বিবাহে আমন্ত্রিতদের ভূরিভোজন, পুরোহিত জোগাড় থেকে নবদম্পত্তির প্রয়োজনীয় সব দ্রব্যের উপহার সহ বিয়ের সব ব্যয়ভার সানন্দে গ্রহণ করলেন৷ বিয়ের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে এমন ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন দেখে সবার মনে হল কন্যাদায় যেন তাঁর৷ মজার বিষয় হল যে বিবাহ অনুষ্ঠান রক্ষণশীলদের ভয়ে সম্পন্ন করতে সাহস হয়নি শিবনাথ শাস্ত্রী বা তাঁর বন্ধু পণ্ডিত যোগেন্দ্রভূষণ বিদ্যাভূষণের সেই বিধবা বিবাহ বিনা বাধায় সম্পন্ন করলেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। রক্ষণশীলদের সেদিন সাহস হয়নি তাঁর সামনে সামাজিক প্রাচীর তোলার৷ শাস্ত্রী লিখেছেন ‘আমার ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা গ্রহণের অল্প কিছুকাল পরে পিতৃদেব মনোদুঃখে অবশিষ্ট জীবন যাপনের জন্য কাশীতে যান৷ কাশীবাসের প্রাক্বালে একবার তিনি কলকাতায় আগমন করেন৷ সেই সময় পণ্ডিত বিদ্যাসাগরের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হয়৷ কাশীবাস করিয়া অধিক পুণ্য সঞ্চয়ের আকাঙ্খাকে পণ্ডিতপ্রবর গোঁড়ামির নামান্তর বলিয়াই মনে করতেন।’
শিবনাথ শাস্ত্রী’র ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণকে নিজের বাবা ক্ষমা করেন নি। বাধ্য হয়ে তিনি কলকাতায় আলাদা বাসায় বাস করতে বাধ্য হলেন। নিজে তখন ছাত্র, অথচ স্ত্রী, কন্যার ভরণপোষণের দায়িত্ব, সংসার প্রতিপালন কি কঠিন অনুভব করছেন। তাঁর সেই দুর্দিনে পণ্ডিত বিদ্যাসাগরের যে সহায়তা ও সহানুভূতি তিনি লাভ করেছেন সেকথা ভাষায় প্রকাশ আসলে ধৃষ্টতা বলে শিবনাথ শাস্ত্রী মনে করতেন। সবরকমের বিপদে বিদ্যাসাগর নিজের সন্তানের মতো তাঁকে আশ্রয় দিয়েছেন৷
গ্রন্থঋণ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ
- মহাপুরুষদের সান্নিধ্যে (‘Men I have seen’ থেকে অনূদিত) শিবনাথ শাস্ত্রী, অনুবাদিকা মায়া রায়।
- রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, শিবনাথ শাস্ত্রী।
( লেখক কলকাতার বাংলা দৈনিকের প্রাক্তন সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ৷ )
ঝরঝরে লেখা, তথ্য সমৃদ্ধ। সুপাঠ্য।