বিবেকানন্দ মোহন্ত
এক
আমাদের গ্রাম কিংবা সন্নিহিত অঞ্চলে নেতাজির প্রভাবটা একটু বেশীই ছিল, তাই হয়ত বিভাগোত্তর পর্বে গড়ে ওঠা এক একটি মহল্লার নামকরণ করা হয়েছিল নেতাজিনগর, সুভাষপল্লী কিংবা নেতাজিবাগ ইত্যাদি। সেজন্যই বোধহয় কোনো কিছুতেই ‘হার না মানা’ মানসিকতা গড়ে উঠেছিল সেই শৈশব-কৈশোর বয়স থেকে এবং বলাবাহুল্য এর প্রভাবটি গিয়ে পড়েছিল আমাদের ‘সুহৃদ সংঘেও’। নিয়ম মেনেই প্রতি বছর নেতাজি জয়ন্তী আমরা মহাসমারোহে পালন করতাম, পায়ে পা মেলাতাম প্রভাতফেরিতে — হাতে থাকত মানানসই লম্বা লম্বা টিনের চোঙ্গা। বড়রা এর সাহায্যে স্লোগান দিতেন আমরা ক্ষুদেরা গলা ছেড়ে দোহারে যোগ দিতাম। এভাবেই এপাড়া-ওপাড়া পরিক্রমা করে ‘সুহৃদে’ এসে জমায়েত হতাম। এখানে বড়রা নেতাজি সম্পর্কে বক্তব্য রাখতেন — আমরা তন্ময় হয়ে সেটা শুনতাম, মাঝে মধ্যে হায়ারি বক্তাও আমন্ত্রিত হয়ে আসতেন। এই পর্ব চুকে যাওয়ার পর সবাই এসে জড়ো হতাম আমাদের বাড়ির লাগোয়া গোচারণ ভূমিতে, এটাই ছিল হেমন্তকালীন ফুটবল মাঠ এবং ঘোড়দৌড়ের মাঠও। নেতাজি জয়ন্তীতে এখানে দিনভর খেলাধুলা হত, থাকত অঙ্কদৌড়ও, কখনও গুটিকয়েক পদক নিয়েও ঘরে ফিরতাম।
আমাদের বাড়ির চারদিকেই রয়েছে এরূপ গোচারণভূমি, যেগুলো বর্ষায় পাঁচ-ছয় ফুট জলের তলায় তলিয়ে যায়, যার সাথে পাল্লা দিয়ে ঘাসও মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়, ক্ষেত্রবিশেষে জলস্তর থেকে দু’তিন ফুট উপর অবধি। সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চলের ধান ক্ষেতের মতনই আমাদের এই গোচারণ ভূমি — যেটিকে আজও আমরা বাঁচিয়ে রেখেছি স্থানীয় ভাষায় ‘ঘাসউরা’ হিসেবেই, কিন্তু ধানক্ষেতে রূপান্তরিত করিনি। শীত-গ্রীষ্মে এই গোচারণভূমিতে অবারিত দ্বার থাকত এপাড়া-ওপাড়ার তৃণভোজিদের জন্য এবং থাকত হাট-ব্যবসায়ী রমাবাবুর গুটিকয়েক ঘোড়ার জন্যও। সম্ভবত মৌলভীবাজার-শ্রীমঙ্গলের চা-বাগিচা সংলগ্ন অঞ্চল থেকে রমাবাবু বিভাগোত্তর পর্বে এপাড়ায় এসে বসতি করেছিলেন, সাথে নিয়ে এসেছিলেন ভ্রাম্যমান হাট-সংস্কৃতিও — যেখানে ভারবাহী ঘোড়া অপরিহার্য ছিল। এপারে এসেও পড়শী এলাকার বাগানহাটে পসরা সাজিয়ে বসতেন এবং রাতে ফিরে এসে ঘোড়াগুলিকে ছেড়ে দিতেন। গতানুগতিক পৃষ্ঠদেশে হাটসামগ্রী বয়ে নিয়ে যেতে অভ্যস্ত অশ্বকুল ভোরবেলায় প্রসন্নচিত্তে আমাদের জন্যও খানিক ঘোরাঘুরির সময় দিতে কোনো কার্পণ্য করত না, আমরাও বাড়ির চারদিক ঘেরা বিস্তীর্ণ গোচারণ ভূমিতে ঘোড়দৌড়ের মহড়ায় মেতে উঠতাম।
শৈশব-কৈশোরে পাড়ার অমলদা ছিল আমাদের ম্যাটিনি আইডল, ক্লাশ টেন-এ পড়ত। সে যেমন খেলাধুলায় চৌখস ছিল, তেমনি আবৃত্তি-নাটকে ছিল সমান পারদর্শী। ছিল একজন সফল প্রোম্টারও। মূলত তার হাতে গড়ে ওঠা সুহৃদ সংঘে আমরা ছিলাম ক্ষুদে সদস্য। সদ্য বাতাবিলেবুর পর্ব পেরিয়ে যখন আমরা রাবারের বল পায়ে তুলছি, তখন ওরা, টি- মার্কা’ চামড়ার গোলক নিয়ে মাঠ কাঁপাচ্ছিল। তাদের সেই বলটি আজকের মত অটোমেটিক বল ছিলনা, সেটার ভিতরকার রাবারের ব্লাডারটি ছিল পরিবর্তনীয় এবং মেরামত-উপযোগী। আমাদের ওষ্ঠদ্বয়ের মতনই ছিল বলটির উপরিভাগ যেদিক দিয়ে ব্লাডারটি ঢুকিয়ে দেওয়া হত বলের ভিতর। দন্ত বিকশিত না করে আমরা যেমন মুচকি হাসি দিতে পারি ঠিক তেমনি ব্লাডারের নিপ্লটিও শোয়ে পড়ে গা-ঢাকা দিত বলের ভিতর। পরে গোলকের দরজায় লেইচ বেঁধে রাখা হত এবং এ- কাজে ব্যবহার করা হত বাঁকানো আঁকশি। এই রাবারের নিপ্লের মাধ্যমেই পাম্প করা হত।
এতক্ষণ পাশে বসে তন্ময় হয়ে অমলদার জারিজুরি দেখছিলাম, আর তর সইছিল না। একসময় মেরামতের কাজটি সমাধা হয়ে গেলে বলটি তুলে সে শক্ত মাটিতে বার দু’এক ড্রপ দিয়ে পরখ করে নিল রিংগিং সাউণ্ড হচ্ছে কিনা, পরে হাসিমুখে সেটি আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল – ‘নে শুট মেরে দেখ’। বাতাবিলেবুর দৌলতে ইতিমধ্যেই মজবুত করে ফেলেছি পদযুগল, তাই জোরসে উপর দিকে কিক মারলাম — এটাই ছিল আমার পুরষ্কার, যে মোক্ষম সময়টির জন্য এতক্ষণ ধরে বসে থেকেছিলাম! গোচারণভূমিতে ওরা যখন চামড়ার গোলক নিয়ে দাপাদাপি করত, আমরা তখন গোলপোস্টের বাইরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম কখন এটিকে কুড়িয়ে আনার সুযোগ পাব — সেটা ঝোপ-ঝাড় জঙ্গল হলেও কুচ পরোয়া নেই। সুযোগ খুঁজতাম দু’একটি কিক মারার। যে বরাতটি সচরাচর জুটত আমারই অনুকূলে, সেটি সমবয়সী অন্যদের কাছে ঈর্ষণীয় হয়ে দাঁড়াতো অনেকসময়।
দুই
এপাড়া-ওপাড়া কিংবা দূর গাঁয়ের প্রতিটি ফুটবল ম্যাচে অংশগ্রহণ করত আমাদের সুহৃদ সংঘ, তাই জোরদার মহড়াপর্ব চলত গোচারণভূমিতে, সাথে অন্যান্য কসরতও। হার-না-মানা মানসিকতার প্রস্তুতিপর্ব সেরে রীতিমতো এন্টার ফিস (এন্ট্রি-ফি) জমা পড়ত সময়মত। ঐসব ম্যাচ থেকে চ্যাম্পিয়নের শিরোপা ছিনিয়ে আনাই ছিল আমাদের ক্লাবের ক্ষুদে-মাঝারি-সিনিয়রদের একমাত্র লক্ষ্য।
সেবছর পড়শী গাঁয়ের সন্দীপ শিলচরের বাটু দাসগুপ্ত’র বিপণী থেকে নিয়ে এসেছিল ছয় ইঞ্চি মাপের বেশ নাদুস-নুদুস একটি কাপ, ডিসপ্লে করেছিল দু’এক জায়গায়। এই টুর্নামেন্টে সে একাধারে কমিটি, সভাপতি, সম্পাদক, বিচারক, রেফারি মায় পুরষ্কারদাতাও, তাই যথারীতি হাতে লিখে বিজ্ঞাপন সেঁটে দিয়েছিল এখানে-ওখানে। একে বড় মাপের কাপ, তায় সাথে থাকছে নানা রকমের পদক, এছাড়াও ফাইনালে বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে রয়েছে ব্যাণ্ডপার্টির আয়োজন, তাই এন্টারফিসের (অ্যান্ট্রি-ফি) দরটি হেঁকেছিল দশ টাকা। আমাদের সুহৃদ পরিবার চারআনা-আটআনা হিসেবে চাঁদা কালেকশন করে যথারীতি ফিজটি জমা দিয়েছিল। স্থানীয় সন্ন্যাসীটিলার সামনের ত্রিকোনাকৃতি গোচারণভূমিতেই খেলার স্থানটি নির্ধারিত হয়েছিল। সমতল ক্ষেত্রটির তিনদিকেই রয়েছে টিলাবেষ্টিত ন্যাচারেল গ্যালারি, রয়েছে গাছতলায় বসে খেলা উপভোগ করার সুবন্দোবস্তও।
এই ম্যাচে অংশগ্রহণ করতে যাওয়া প্লেয়ারদের যোগ্যতার মাপকাঠি ছিল ৪৮” অর্থাৎ ৪ ফুট, সে মাপটি ছিল পায়ের গোড়ালি থেকে কানের লতি পর্যন্ত। এই কঠিন পরীক্ষা পাশ করতে গিয়ে শরীরকে যথাসম্ভব কুঁজো করে রাখতে হচ্ছে। কিন্তু বিপত্তি এখানেই, প্রতিপক্ষ জুড়ে দিচ্ছে তুমুল হৈ-হট্টগোল – ‘শরীর বাঁকা করছে, সোজা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না, এইসব চোরামি চলবেনা — মানছি না-মানব না—- ‘ ইত্যাদি। তা সত্বেও সুহৃদের এক একটি প্লেয়ার নির্ধারিত মাপের চেয়ে ছ’ইঞ্চি অধিক দৈর্ঘ্যকেও কসরতের মাধ্যমে যোগ্যতার মাপকাঠির (Qualifying parameter) ভিতরে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল।
এভাবে প্রবেশিকা পর্বে উত্তীর্ণ হয়ে ধাপে ধাপে ফাইনাল অবধি পৌঁছেছিল সুহৃদ সংঘ। এবার চরম পরীক্ষার পালা। কমিটি মশায় প্রস্তুতির জন্য দু’দিন সময় দিয়েছেন। তার নিজেরও প্রয়োজন রয়েছে, ব্যাণ্ডপার্টির বায়না-টায়না তো আছেই — তাছাড়া আমন্ত্রিত অতিথি-অভ্যাগতদের ব্যাপার-স্যাপারও তো আছে !
এদিকে আমাদেরও কাজ পড়ে রয়েছে, মাঝারিগোছের সদস্যরা যোগাড় করছে বিছুটি পাতার (চুতরা পাতা) আটি — তো ক্ষুদেরা নিয়ে আসছে শুকনো সুপারীর পাতা সমেত আস্ত খোল (স্থানীয় ভাষায় সুপারীর বাউগড়া) ইত্যাদি। ফাইনালের দিন পুরো প্রস্তুতি নিয়েই আমরা ছোট-বড়-মাঝারি মায় আস্ত সুহৃদ পরিবার গিয়ে হাজির হলাম কুরুক্ষেত্রের সমরাঙ্গনে।
খেলা শুরু হল নির্ধারিত সময়েই, হাফ্-টাইম পর্যন্ত গোলশূণ্য। বিরতির সময় প্লেয়াররা দু’টুকরো দু’ টুকরো করে আস্ত-আস্ত লেবুর রস পান করে শরীরটাকে চাঙ্গা করে নিল (এটাই দস্তুর ছিল)। তুমুল হর্ষোল্লাসের মধ্য দিয়ে খেলা আবার শুরু হল, ওপাশে পাহাড়ের ঢালু গায়ে বসে ব্যাণ্ডপার্টির নহবত পুরোদমে চলছে, এর মধ্যে ম্যাচের একেবারে অন্তিম মুহুর্তে একটি গোল খেয়ে বসল সুহৃদ সংঘ। এটাতো আমাদের প্রাপ্য নয়! মাঝারিরা ধরে আনল গায়ে-গতরে তাগড়া সাইজের এক গো-শাবক, যেটি ইতি-উতি ঘাস খেয়ে চরছিল। তার লেজে এবার শক্ত করে বেঁধে দেওয়া হল সুপারীর আস্ত খোল। এতে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বেচারা প্রাণপণে ছুটোছুটি শুরু করে দিল সারা মাঠ জুড়ে। এই সুযোগে বড় থেকে মাঝারি সাপোর্টাররা ‘ফটেশ-ফটেশ’ চিৎকার জুড়ে মাঠে নেমে পড়ল। বিপক্ষরাও কম যায়না, মাঠে লেগে গেল ধুন্ধুমার কাণ্ড — হাতাহাতি। ভাগলপুরের শ্রীকান্তের দমাদম ছাতার বাড়ির অভিজ্ঞতা হয়েছিল, ইন্দ্র এসে সে-যাত্রায় তাকে উদ্ধার করেছিল, আমরা কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম! এমনটা হবে জেনে যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে তবেই মাঠে এসেছিলাম। এবং যথাসময়ে আমরা ক্ষুদে সমর্থকরা বিছুটি অস্ত্র হাতে নেমে পড়লাম মাঠে। এই মোক্ষম অস্ত্রের সামনে খালি হাতে বিপক্ষরা দাঁড়াবার কোনো কূল-কিনারা পেলনা, বরং হাত-পা-সর্বাঙ্গ চুলকোতে চুলকোতে পালিয়ে বেঁচেছিল সেদিন। অবস্থা সঙ্গীন বুঝতে পেরে রেফারি তথা কমিটি মশায় বন-বাদাড় ভেদ করে নিপাত্তা!
যথারীতি দু’তরফ থেকেই প্রতিবাদপত্র জমা পড়েছিল কমিটির দরবারে। তবে, দিন দুই পর অনেক চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ, বিবেচনা করে কমিটি মশায় রায় দিলেন যে, আমাদের ” ‘ফটেশটি’ একান্তই যুক্তিসঙ্গত, গো-শাবকটির তৃণমমতায় মাঠে ঢোকাটা ঠিক হয়নি, অতএব রি-ম্যাচ”। ফটেশটির আভিধানিক অর্থ যে প্রটেস্ট এবং এর যে কী মাহাত্ম্য সেটিও আমরা ক্ষুদে সমর্থকরা অনুধাবন করতে পেরেছিলাম সেদিন!
এখানে বলাবাহুল্য যে, পরবর্তী ফাইনালে আমরাই জিতেছিলাম নগরের ‘হঠাৎ ক’জন’ ক্লাবের দুর্দান্ত সব হায়ারি প্লেয়ারের সৌজন্যে। তাছাড়া ম্যাচ সেরার পুরষ্কারটিও জুটেছিল আমাদের সতীর্থের গলায়। শৃঙ্খলাপরায়ণ টিমের পদকটি আমাদের অনুকূলে গিয়েছিল কী না, সেটি এই মুহুর্তে ঠিক মনে পড়ছেনা। তবে, না পাওয়ার তেমন কোনো সম্ভাবনা দেখছিনা – কেননা কমিটি মশায়ের নিত্যদিনের স্কুলে যাওয়া-আসার রাস্তায়ই তো পড়ে আমাদের সুহৃদ সংঘ।
তিন
প্রতি বছর দুর্গাপুজো উপলক্ষে নাট্যাভিনয় নিয়ে মেতে উঠত আমাদের সুহৃদ সংঘ। সে উদ্দেশ্যে রীতিমত রিহার্সেল পর্ব চলত রোজ সন্ধ্যায়। পরিচালক, সঞ্চালক, নির্দেশক সহ প্রোম্টারের গুরুদায়িত্ব সামলাতো সেই অমলদা, সে তখন ক্লাশ ইলেভেন/টুয়েলভে পড়ত। অভিনয়ে সামিল হত মাঝারি থেকে বড় মাপের ক্লাব সদস্যরা। প্রত্যেকের নিজ নিজ সংলাপ কন্ঠস্থ হওয়া চাই, সেরকমই নির্দেশ থাকত প্রোমটারের। সুহৃদ সদস্য মন্টুদার গাইয়ে হিসেবে বেশ নামডাক ছিল। স্থানীয় সাবরেজিস্ট্রার অফিস লাগোয়া মাঠে গত মরশুমে পালা করতে এসেছিল কলকাতার কোনো এক নামী যাত্রাকোম্পানী, ভলান্টিয়ার হওয়ার সুবাদে মন্টুদার অবাধ যাতায়াত ছিল তাদের গ্রীনরুম পর্যন্ত। এই অবসরে নাটক, যাত্রাপালার গানের কিছুটা তালিমও নিতে পেরেছিল সে। আমাদের এই অ্যাসেট মন্টুদা ক্লাবের নাটক-যাত্রা পালায় বিবেকের ভূমিকা নিয়ে বোদ্ধা মহলে দস্তুরমত সাড়া জাগিয়েছিল।
যাই হোক, সেবছর আমরা ‘গলি থেকে রাজপথ’ নাটকটি নিয়ে দিন-পনেরো জোর রিহার্সেলে মেতে উঠেছিলাম। পুজো উপলক্ষে সফল মঞ্চস্থ হয়েছিল আশপাশ এলাকার দু’তিনটি মঞ্চে এবং বেশ সাধুবাদও জুটেছিল। খবরটি যথাসময়েই গিয়ে পৌঁছেছিল নিকটবর্তী চা-বাগান ম্যানেজার ত্রিবেদী সাহেবের কানেও। ইতিপূর্বে দু’একবার তাঁদের নাচঘরের মঞ্চ কাঁপিয়ে এসেছিল সুহৃদ পরিবার, তবে সেসব ছিল ঐতিহাসিক পালা। তাই এবারের আমন্ত্রণ আমাদের বিরাট ধন্দে ফেলে দিল, বারকয়েক বুঝিয়েও তাঁকে টলানো গেলনা। অগত্যা ‘গলি থেকে রাজপথ’ নিয়েই চা- বাগিচার পথ ধরেছিলাম। সেখানে ত্রিবেদী সাহেবের প্রণোদনমূলক স্বাগতিক ভাষণ আমাদেরকে আশ্বস্ত করেছিল। মঞ্চে উঠে তিনি বলেছিলেন – ‘হামি দেখেছে এই যাত্রা, ও বহুত বহুত আচ্ছে আছে, তুমহারে ভি আচ্ছে লাগেগা —— ” ইত্যাদি। তারপর তুমুল হাততালির মধ্য দিয়ে পালাটি শুরু হল। অমলদা খানিক প্রোমটারের দায়িত্ব পালন করে ডুব দিলেন কোথায় কী-জানে! পালাটি যথারীতি চলতে লাগল, অমলদার কড়া শাসনে সংলাপ সবারই ঠোটস্থ কিনা। খুঁজতে গিয়ে অমলদাকে আবিষ্কার করলাম ঝাণ্ডিমুণ্ডার আসরে, সেখানে রয়েছে অন্যান্য আনুষঙ্গিক আয়োজনও, তবে সেসব ক্ষেত্রে তার তেমন কোনো আগ্রহ দেখতে পেলাম না। তবে, হরিণ যেভাবে অ্যারিয়েল উঁচিয়ে পরিবেশ-পরিস্থিতির বুঝ নেয় অমলদাও সেভাবে পরিস্থিতির খেয়াল রেখে চলছে, আবার পরক্ষণেই ‘লাগ ঝাণ্ডি লাগ মুণ্ডায়’ মেতে উঠছে। ভুরু কুচকে একসময় বলে উঠল – ‘চল্ চল্, ওদিকে লেগে গেছে —–।’ অকূস্থলে গিয়ে দেখা গেল সত্যি সত্যিই লেগে গেছে! ম্যানেজার মশাই মঞ্চে উঠে চেঁচিয়ে যাচ্ছেন — “ইয়ে সব নেহি চলেগা, যুদ্ধ কিউ নেহি হ্যাঁয়, বন্ধ্ কিজিয়ে আপলোগকা ইয়ে নৌটঙ্কি ——-।” তাঁর হুলস্থুলে গোটা বাগিচা নেমে পড়ল মঞ্চে। আমরা হতবাক, কিংকর্তব্যবিমূঢ় !
অবস্থা বেগতিক বুঝে ওপাশে ডেকে নিয়ে অমলদা আমার হাতে গোঁজে দিল চাবির গোছা, বলল – ‘দীপুর সাইকেলটি নিয়ে এক্ষুণি ক্লাবে যা।’ তার ইঙ্গিত বুঝতে কোনো অসুবিধা হয়নি, এবড়ো-থেবড়ো রাস্তা ধরে ছুটে চললাম ক্লাবে, হাতে সময় নেই। আলমিরা খুলে যা পেলাম তাই নিয়েই ছোটে এলাম রণক্ষেত্রে। ওখানে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল অমলদা, বলল ‘এনেছিস সবকিছু?’ দেখলাম তলোয়ার দু’টো এনেছি ঠিকই, তবে পুটলির মধ্যে ড্রেস রয়েছে শুধু একপ্রস্ত! ‘ওতেই হয়ে যাবে, চল্ চল্ ‘ বলে সে ছুটল গ্রীণরুমের দিকে। আমি হতভম্ব, আজ কপালে যে কী রয়েছে কে জানে!
এখানে বলে রাখা ভাল, আমাকে ক্লাবে পাঠিয়ে নাচঘরের দিকটা সামলেছিল অমল, নিমাই, দেবু, নন্দু, দীপু, মন্টু সহ অন্যরা। যাই হোক, সাময়িক বিরতি নিয়ে নতুন আঙ্গিকে পালাটি আবার শুরু হল। এবার মিনমিনে সামাজিক পর্ব নয়, দস্তুরমত মঞ্চ কাঁপানো সংলাপ নিয়ে হাজির ‘আমি সিরাজের বেগম’ যাত্রাপালার মারমুখো কুশীলবরা, সাথে রণহুঙ্কার, তলোয়ারের ঝনঝনানি। কখনও বা মোগলবাদশা শাহজাহান, দারা-শিকো-আওরঙ্গজেব, তো কখনও চন্দ্রগুপ্তের কি বিচিত্র এই দেশ নিয়ে মঞ্চে উদয় বীর আলেকজান্ডার-সেলুকাসও, কি নেই পালাটিতে! মুহুর্মূহ হাততালি চলতে লাগল। এসবের ফাঁকে ফাঁকে মন্টুদার কন্ঠনিসৃত এক একটি হৃদয় নিংড়ানো গান আসরটাকে পৌঁছিয়ে দিল শীর্ষস্তরে। সমঝদার দর্শক-শ্রুতা ম্যানেজার মশাই আর বসে থাকতে পারেননি, বারে বারে মঞ্চে অবতীর্ণ হয়ে নোটের তোড়া সেঁটে দিয়ে চলছেন কুশীলবদের বুকে । এক বাক্যে ছোটবাবু, বড়বাবু থেকে শুরু করে মায় গোটা বাগিচায় ধন্য ধন্য রব উঠল। এভাবেই একসময় নাটকের যবনিকা পতন হল। এবং আমরাও আসছে পুজোয় পুনর্বার যুদ্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাড়ির পথ ধরলাম।
তুমি সারা জীবন আমাদের কে বাশ দিয়ে এখন লেখক হচ্ছ???