বিবেকানন্দ মোহন্ত
-এক-
গেছোভূত
চাকুরীজীবনে বিভিন্ন বয়সের আমরা পাঁচজন ঘর বেঁধেছিলাম হাইলাকান্দির এক মেসবাড়িতে। দিনভর হাঁড়খাটুনির পর রাতের খাওয়া-দাওয়ার আগে মাঝেমধ্যে একটু আধটু গল্পগুজবে মশগুল হতাম। তবে বৃষ্টিস্নাত রাতবিরেতে মজলিশি বৈঠকটি জমতো একটু বেশীই। এরকমই এক সান্ধ্যআসরে সবার পীড়াপীড়িতে, ফেলে আসা দিনগুলির দু’একটি অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছিলাম মেসমেটদের।
আমাদের সুরমা-বরাকের জনজীবনে মরশুমি ফল হিসেবে আম-কাঁঠালের কোনো জুড়ি নেই। বিষয়টি যেমন কাব্য-সাহিত্য-গীতিবাদ্যের ভাণ্ডারের এক বড় অংশ জুড়ে রয়েছে -ঠিক তেমনি রাজা-মহারাজাদের ভূমিদান বিষয়ক রাজসনদ, দলিল- দস্তাবেজ, প্রাচীন তাম্রশাসনেও সগৌরবে এবং স্বমহিমায় বিরাজ করেছিল।( সাম্রপনসাঃ। সগুবানালিকেরাঃ–সূত্র: ৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের পুণ্ড্রবর্ধনের মহারাজাধিরাজ শ্রীচন্দ্র প্রদত্ত পশ্চিমভাগ তাম্রশাসন, চন্দ্রপুরি বিষয়, শ্রীহট্টমণ্ডল। এই শাসন উল্লেখিত সুবিশাল ভূখণ্ডের অন্তর্গত ছিল দক্ষিণশ্রীহট্ট, করিমগঞ্জ সহ উত্তর ত্রিপুরার ধর্মনগর-কৈলাশহর বিভাগ)। এই গোটা এলাকার পাহাড় তথা টিলাবেষ্টিত অঞ্চলে কাঁঠালের প্রাচুর্যতা হাজার বছর আগেও যেমন ছিল -আজও তেমনই আছে। অনন্তকাল থেকে এই রসসাগরে যেমন মজে রয়েছে মানবকূল ঠিক তেমনি অশরীরী-অতৃপ্ত আত্মারাও হয়তো রসনালুলোপ দৃষ্টিকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। তাই হয়তো কাঁঠালের মোহে হানা দেয় ভরদুপুরে কিংবা নিঝুম রাতনিশিতে।
পাঠশালা পর্ব অবধি বাৎসরিক আম-কাঁঠালের বন্ধে পিসিমণির হাতধরে বেড়াতে বেরোতাম বর্তমান বরাকের পিতৃকুল সম্পর্কিত বিভিন্ন আত্মীয় পরিসরে। কিন্তু মাইনার শ্রেণীতে পৌঁছার পর আমার বেড়ানোর পরিধি রাজগী ত্রিপুরা ( রাজন্য শাসিত অঞ্চল ) অবধি বিস্তৃত হয়েছিল। সেখানে রয়েছে মাতৃকুলের বাড়বাড়ন্ত। রয়েছে সাম্র-পনসার তরুবীথিমালা। সেই ছোট্ট বয়স থেকেই গেছোভূত হিসেবে যথেষ্ট নামডাক রয়েছে আমার, গাছের মগডালে বসে বসে শুধু আম নয়-আস্ত কাঁঠালই সাবাড় করে দিতে পারতাম।
সেবছর গিয়েছিলাম বড়মাসীদের আমটিলার বাড়িতে। গ্রামটি উত্তরত্রিপুরার কদমতলার লাগোয়া টিলাবেষ্টিত অঞ্চলে, সেখানে আমের চেয়ে কাঁঠালেরই বাড়বাড়ন্ত।। মাসীমা বাবলুদাকে ডেকে পই পই করে বলে দিয়েছেন –”এদিক-ওদিক সব টিলাতেই ওকে নিয়ে যাবি, কিন্তু খবরদার পশ্চিমের টিলার দিকে ভুলেও পা-বাড়াবি না।” বিষয়টির কোনো গুরুত্ব দিইনি, গিয়েছিলাম সেখানেও। বেশ ডাকাবুকো সাইজের এক কাঁঠাল গাছে তরতরিয়ে উঠে একে একে আঙ্গুলের ঠোকা দিয়ে দিয়ে পরখ করে নিয়ে অবশেষে বেশ উঁচুতে পাকা কাঁঠালের হদিশ পেলাম। সেটাকে পেড়ে নিয়ে তিন-ডালের সন্ধিতে বসে দু’জনে মিলে ওটিকে সাবাড় করছিলাম। এই অবসরে এক্কেবারে মগডালের দিকে চোখ পড়েছিল আমার। হায় কপাল! সেখানে ফুট দেড়েক দৈর্ঘ্যের এক ছোট্ট বালক গাছের ডালে ভর করে দাঁড়িয়ে পাম্প করছিল পেট্রোমাক্সে। আমার দিকে চেয়ে চেয়ে মাঝে মাঝে নব ঘুরিয়ে মেনথেলটির আলো আরও উজ্জ্বল করে দিচ্ছিল। আমি অবাক দৃষ্টিতে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে রয়েছিলাম, সেও মিটমিট করে হাসছিল এবং পাম্প করে যাচ্ছিল। কিন্তু ভেবে কোনো সদুত্তর খুঁজে পাচ্ছিলাম না। একসময় বাবলুদার দিকে চোখ ফিরিয়ে বললাম – “দেখো দেখো, ছেলেটি পেট্রোমাক্স জ্বালাচ্ছে।” কিন্তু কপাল মন্দ, আমি কিংবা বাবলুদা ওকে আর দেখতে পেলামই না।
দামাল ছেলে বাবলুদা প্রাণপণে ভূ–উ–ত, ভূ–উ–ত, চিৎকার জুড়ে দিয়ে পাগলের মত গাছ বেয়ে নীচে নামতে লাগল। আমিও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে তাকেই অনুসরণ করলাম।
বাড়িতে ফিরে এসে কিল-চড় জুটলো বাবলুদার কপালে। বড়মাসী কান্না জুড়ে দিলেন – “উমাকে আমি কী জবাব দেব!”
সত্যি বলতে কি, আমি সেদিন তেমন কোনো ভয় পাইনি, তবে উত্তরও খুঁজে পাইনি। যথারীতি বদ্যি, কবিরাজ, ঝাড়ফুঁক, কবচ-তাবিজে সুশোভিত হয়েছিলাম, এই যা।
মেসবাড়িতে বসে এই গেছোভূতের আখ্যান শুনে যুক্তিবাদী মৃন্ময়দা বিস্তর অ্যানালাইসিস করলেন, তবে কোনো সমাধান সূত্রের হদিশ দিতে পারেননি। তেরোজুড়ির কর্তা মাণিক দিনভর হিসেবের খাতায় গরমিল খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত হয়ে সান্ধ্য আসরে বসে স্বভাবসুলভ নাসিকা গর্জনেই মগ্ন ছিল, তবে বার দু’য়েক আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে নিজের অস্তিত্বকে সুরক্ষিত রাখছিল । বিদ্যুৎবাবুর অন্তর্ধানে জোর করেও যুবসংগঠনের কর্মকর্তা শেখরকে পাশের ঘরে গিয়ে চার্জার লাইটটি আনানো গেল না। এসবের মধ্যে সহপাঠী তথা সহকর্মী পার্থ গুপ্ত মুখে যথাসম্ভব গাম্ভীর্য এনে বলল – ‘Hallucination, Hallucination…’
–দুই-
আমাদের গ্রামের বাড়ির উঠোনের চারপাশ জুড়েই বেড়ে উঠেছিল একান্নবর্তী পরিবারের বাস্তুভিটে। একেবারে পশ্চিমপ্রান্তের কোণার ঘরে থাকতেন জ্যাঠামশায়। এক ভোররাতে তাঁর জোরে জোরে হরেকৃষ্ণ হরেরাম -হরেকৃষ্ণ হরেরাম জপ শুনে আমাদের ঘুম ভেঙ্গে গেল। যথারীতি তাঁর সুরে সুর মেলালেন বাড়িশুদ্ধ সবাই। কানে ভেসে আসছিল সদ্যোজাত শিশুর ক্ষীণস্বরে কান্না যেটি বাড়ি থেকে একটু দূরের পথ বেয়ে ক্রমান্বয়ে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে বাতাসে বিলীন হচ্ছে।
কথার মাঝপথে আমায় থামিয়ে দিল শেখর। বলল –“ব্যাটা, থাকছি ভূতর ঘাটের পাশাপাশি, এমনিতেই রাত-বিরেতে গা ছম ছম করে, তুমি আবার কীসব বলে রাতের ঘুমটাকেই মাটি করে দিলে। বলে রাখলাম, আজ কিন্তু ও- ঘরে আমি একা শুতে যাবনা -তোমার সাথেই শেয়ার করব।”
আরে রাখো রাখো বলে শেখরকে থামিয়ে দিলেন মৃন্ময়দা, গজ গজ করে বললেন- “এক একজন ভীতুর বাদশা।”
তাঁর সায় পেয়ে বলতে লাগলাম – “সেদিন মা-কাকীমারা বলাবলি করছিলেন — ওপাড়ার এদেরই কোনো দুষ্কর্মের ফল, রোজ রোজ আমাদেরই ভুগতে হচ্ছে।”
মাণিক একটু গলাঝেড়ে রায় দিল – “সমাজটা এভাবেই উচ্ছন্নে যাচ্ছে।”
যাই হোক্, আমি আবার বলতে শুরু করলাম। তখন হায়ার সেকেণ্ডারীর উপরের ক্লাশে পড়ি, বিষয়টির সত্যাসত্য নিরূপনে লেগে গেলাম।
সময়টি বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাসের বৃষ্টিবাদলের মরশুম -আবার আম-কাঁঠালেরও মরশুম বটে। আমাদের বসতবাড়ির লাগোয়া অনুচ্ছ টিলায় রয়েছে গোটাকয়েক আম্র-পনসের গাছ গাছালি, পাশেই রয়েছে উঁচু বটগাছ এবং রয়েছে পাখিদের বসতবাড়িও। মরশুমি পরিযায়ীরাও মাঝেমধ্যে এখানে এসে ভীড় জমায়।
রসাল গাছটির দুর্বিনীত একটি শাখাও ফলসমেত পরম নিশ্চিন্তে ঠাঁই নিয়েছে বটগাছটির কোলে। এই শাখা থেকে আম পাড়তে গেলে বটগাছ বেয়ে উঠতে হয়। কিন্তু ঠাকুর-দেবতাদের রুষ্ট হওয়ার ভয়ে ওপথে কেউ বড় একটা পা মাড়ায় না। এক ভরদুপুরে সাহসে ভর করে পৌঁছেছিলাম আমগাছটির ঐ শাখায়। যখন বেছে বেছে পাকা আমগুলোকে ব্যাগে পুরছিলাম, তখন মগডালের দিক থেকে যেন থেমে থেমে ক্ষীণস্বরে গোঙ্গানীর আওয়াজ কানে ভেসে আসছিল – ঠিক যেন সদ্যোজাত শিশুর কান্না। কৌতুহল বশত ওদিকে এগোলাম এবং দেখতে পেলাম খড়-কুটো, শুকনো ডালপালা দিয়ে গড়ে তোলা আস্তানায় রয়েছে দুটো শকুনের বাচ্চা। এদের কান্নার স্বর উচ্চগ্রাম থেকে ধীরে ধীরে নিম্নগ্রামে নেমে এসে বিলীন হচ্ছিল বাতাসে। এদের অভিভাবকরা নিশ্চয়ই খাবারের সন্ধানে গেছে কোথাও, সম্ভবত কিলোমিটার খানেক দূরে হাওরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া নদিতীরের ভাগাড়ে।
এবার বুঝতে পারলাম নিঝুম-নিশুতি রাতে ঐ কান্নাই আমাদের বাড়ির সদস্যদের কর্ণ-কুহরে গিয়ে পৌঁছেছিল এবং ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছিল বাতাসে।
সেদিনের সান্ধ্য-আসরে উপস্থিত সবাই এমনকি তেরোজুড়ির অধিকারী সাহেবও তার স্বভাবসুলভ দৃষ্টি নিয়ে অঙ্ক কষে আমার অনুসন্ধান এবং সিদ্ধান্তে একশোয় একশ নম্বর দিতে কোনো কার্পণ্য করেনি।
-তিন-
বিভিন্ন ছুটি-ছাটা, ট্রনিং-ফেনিং এর পর্ব সেরে, মাসদেড়েক পর মেসবাড়িটি আবার সরগরম হয়ে উঠেছিল।সবাই উপস্থিত ছিল, হাজির ছিল খাদ্যরসিক তথা রন্ধনপটু মাণিকও। ক’দিন ধরে নাগাড়ে ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছিল, সাথে কনকনে ঠাণ্ডা। সিদ্ধান্ত হল রাতে খিচুড়ি হবে, সাথে গরম গরম ইলিশ ভাজা। যথারীতি সদলবলে হানা দিলাম হারবার্টগঞ্জ বাজারে। দেখেশুনে নাদুস-নুদুস কেজি দেড়েক সাইজের রূপোলি ইলিশ কিনে আনা হল। পাচকের ভূমিকায় মাণিক, সহকারী শেখর। প্রচণ্ড স্বাস্থ্যসচেতন মৃন্ময়দা বার দু’য়েক শাসিয়ে গেলেন-ঝাল-টাল, মশলা-টশলা বেশী হলে চলবেনা –ইত্যাদি। এখানে উল্লেখ্য যে, রোজ ভোররাতে উঠে রামদেবজীর নীতি-নির্দেশিকা মেনে তাঁর প্রাণায়াম, অনুলোম – বিলোম, হু-স-স-স্, হা-স-স -স্ এর দাক্ষিণ্যে আমরা ঘুম-কাতুরেদের অবস্থা একরকম সঙ্গীন, প্রাণান্তকর করে ছেড়েছিলেন মৃন্ময়দা। এবং গোদের উপর বিষফোড়া হিসেবে তিনি আমারই রুমমেট !! বুঝুন কী অবস্থা !
যাই হোক্, সতীর্থদের অনুরোধে শরীরী-অশরীরী নিয়ে মাঠে নেমে পড়লাম। ভীতুর বাদশা শেখর বার দু’য়েক পাকশাল থেকে এসে শাসানি দিয়ে গেল — “ব্যাটা, রাতের ঘুমটা যদি পণ্ড হয়, তবে তোমার একদিন – কি আমার একদিন।”
আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। শিলচরের চেংকুড়ি রোড-ন্যাশনেল হাইওয়ের এলাকা তখন শুনশান, একরকম জনবিরলই বলা যেতে পারে। রাস্তার দু’পাশে ধানক্ষেতের ফাঁকে ফাঁকে সবেমাত্র হাতে গোনা দু’একটি ঘর মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। আমার বড়দাও বিঘাখানেক জমি কিনেছিলেন চেংকুড়ি রোডের পাশেই। বিল্ডিং তোলার দায়িত্বে ছিলাম আমি। যথারীতি একতলায় ড্রয়িং রুম সহ আরও দুটি রুম কমপ্লিট করে আমি থাকতে শুরু করলাম এই RCC বিল্ডিংয়ে। তখন চাকরী করতাম শিলচর ফ্লাডকন্ট্রোলে। এভাবেই একা একা মাসছয়েক থেকেছিলাম এই ঘরটিতে। প্রতিবেশী সিনহা বাবু রোজ রাতে এসে গল্পগুজব করে যেতেন।
তখন শীতকাল, প্রচণ্ড ঠাণ্ডা জাঁকিয়ে বসেছে হাওর ঘেষা এই প্রান্তরে। সিনহাবাবু নিত্যদিনের বৈঠক শেষে তাঁর ঘরে ফিরে যাওয়ার পর আমি খেয়েদেয়ে শোয়ে পড়লাম। কিছু একটা শব্দে মাঝরাতের ঘুম ভেঙ্গে গেল। তড়িৎ গতিতে বিছানায় উঠে বসলাম। আবারও সেই “ঠক- ঠক- চড়াৎ” শব্দ ! ভেসে আসছে সামনের দরজা থেকে। ঘরে লাইটেরও তখন সংযোগ হয়নি, হাতে ছিল পাঁচ ব্যাটারির টর্চ, শিয়রের পাশে থাকত হাত দুয়েক মাপের পাঁচসুতি রড, এটাই সম্বল। বিছানা ছেড়ে সোজা চলে গেলাম দরজার সামনে। এবার দেখলাম সেই একই শব্দ হচ্ছে পিছনের দরজা থেকে। ভেবে পাচ্ছিলাম না এত অল্প সময়ে বারান্দার সিড়ি বেয়ে নেমে ঘরের ওপাশ ঘুরে পিছনের দরজায় গিয়ে ঠোকা দেওয়া কীভাবে সম্ভব ! তাও আবার হেঁটে যাওয়ার কোনো শব্দই পেলাম না। ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়লাম। এবার দুটো দরজা থেকেই প্রায় একই সময়ে শব্দ হল। নিশ্চিত হলাম যে, দু’দিক থেকেই আক্রমণের মুখোমুখী হয়ত চলেছি । আমি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লাম, চিৎকার করার শক্তিটুকুও হারিয়ে বসেছি। নিরুপায় হয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম – ওরা আসে আসুক, নেবার মত কিছুই নেই, আছে শুধু দুই কুইন্টলের মত রড এবং গোটা পাঁচেক সিমেন্টের ব্যাগ। এসব হাতাতে গিয়ে তাদের তেমন কোনো প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হবেনা। এবার চুপচাপ বিছানায় বসে বসে হানাদার বাহিনীর অপেক্ষা করতে লাগলাম। আবার শব্দ হল — “চড়—চড়—চড়াৎ।” এবার ঘাড় থেকে ভয় ডর নামিয়ে দিয়ে একটু ভাবতে লাগলাম বহিরাগত ছাড়া আর কী উৎস থাকতে পারে ঐ ধরণের শব্দে! মনে হল ফেভিকল জাতীয় আঠার বাঁধন ছেড়ে ধীরে ধীরে আলগা হচ্ছে দরজার কাঠের প্যানেল। খেয়াল হল দরজার ফ্রেমটি সুন্দি কাঠের এবং প্যানেল/ঢিপটি হল গামারির। দরজা তেরী করতে গিয়ে সুন্দির ফ্রেমের ভিতর গামারির প্যানেল ঢুকিয়ে ফেভিকল দিয়ে জোড়া দেয়া হয়েছিল। শীত-গ্রীষ্মের মরশুমে ঠাণ্ডা-গরমের তারতম্যে প্রতিটি বস্তুরই সংকোচন-প্রসারণ হয়ে থাকে এবং সেটি নির্ভর করে তাদের নির্দিষ্ট এককের উপর (ইংরেজিতে যাকে বলে Coefficient of linear and volumetric expansion and contractions)। এক এক জাতীয় কাঠের কিয়রিং ফ্যাক্টার ছাড়াও সুন্দি-গামারির স্থিতাবস্থায় থাকা-না থাকার একক এক না ও তো হতে পারে। এখানে তাইই প্রতীয়মান হয়েছিল। নিশ্চিন্ত হয়ে এবার ঘাম বেয়ে জ্বরটি নেমেছিল।
যথারীতি বাইরে গিয়ে ঘুরে ফিরে এসে আবার শোয়ে পড়লাম। ঘড়িতে তখন রাত প্রায় দুটো বাজে।
নিশ্চিন্তমনে ঘুমিয়েছিলাম ঠিকই তবে সেটি আর স্থায়ী হলনা। এবার নতুন উপসর্গ দেখা দিল পাশের বেডরুমের পেছনদিকের খালি পড়ে থাকা রুম থেকে। “গুম —–গুম —–গুম —-গু—ম—গু———ম”, এই গুরুগম্ভীর শব্দে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। হাতিয়ারপত্র নিয়ে ওঘরে ছুটে গেলাম। মনে পড়ল সিনহাবাবুও ঐজাতীয় শব্দের মুখোমুখী হয়ে যথারীতি কীর্তন-টির্তনও দিয়েছিলেন, কিন্তু তেমন কোনো সুরাহা হয়নি। তিনি একথাও বলেছিলেন যে, এই খালি মাঠে অনেক অশরীরীর চলাফেরার খবর শোনা যায় লোকমুখে। মনটা একেবারে ভেঙ্গে গেল। অনেক হাঁড়খাটুনী এবং বিস্তর খরচা-পাতি করে বাড়িটি বানানো হয়েছিল, কিন্তু নিশ্চিন্তমনে থাকার জো নেই ! ঐঘরে দাঁড়িয়ে সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে আবারও শুরু হল সেই ভয়বিহ্বল গুম গুম আওয়াজ। প্রতিধ্বনিত হতে হতে একসময় মিলিয়ে গেল মিনিট কয়েকের মধ্যে। ঠিক করলাম আবার শব্দ হলেই সোজা বাইরে গিয়ে রাস্তায় দাঁড়াবো, ওখানে বাকী রাতটুকু কাটিয়ে দেব আর ভুলেও ঘরমুখো হবনা। এবং ঠিক তাইই করলাম, আওয়াজ শুরু হতেই টর্চ-রড নিয়ে প্রাণপণে ঘর ছেড়ে সঠান রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালাম।
ভয়বিহ্বল দৃষ্টি নিয়ে ঘরের দিকে চেয়ে থাকলাম, একসময় চোখে পড়ল গোটা দু’য়েক ফিঙ্গে ( স্থানীয় ভাষায় পেছকোন্দা পাখী ) বসে রয়েছে ছাদের উপরে পিলারের এক্সটেন্সন রডে, ফড়িং শিকার করার জন্য সময় সময় “ছিঁ –ছিঁউ -ছিঁউ” সুর তুলে উড়ে যাচ্ছে এদিক- ওদিক, পরক্ষণেই আবার এসে বসছে সেই রডে। তাদের এই কর্মকাণ্ডের জন্য পিলারের রডগুলো পরস্পর ঠুকাঠুকি করে আওয়াজের সৃষ্টি করছে। এই চিন্তা মাথায় আসতেই আবার যখন ওরা উড়ে গেল তখন এক দৌড়ে সেই রুমে গিয়ে ঢুকলাম এবং যথারীতি আওয়াজটিও পেলাম। এই রুমের পিলারের রডগুলো একটু বেশীই এক্সটেণ্ডেড ছিল, তদুপরি রুমটি খালি থাকাতে শব্দ শোষণের জন্য আনুষঙ্গিক কোনো বস্তু এ ঘরে ছিলনা , তাই চার দেয়ালে শব্দটি রিফ্লেকশন হতে হতে একসময় বাতাসে মিলিয়ে যেত এবং সেকারণে গুম গুম আওয়াজের স্থিতিকাল থাকত মিনিট পাঁচেক।
অবশেষে পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে বাকি রাতটুকু কাটিয়েছিলাম এই বাড়িতেই।
আমার এই শরীরী-অশরীরী বৃত্তান্ত সেদিন হৃদস্পন্দন থামিয়ে দিয়েছিল মেসমেটদের। বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন যুক্তিবাদী ব্যক্তিত্ব, ঘুমকাতুরে তেরোজুড়ী অধিকারী, ভীতুর বাদশা যুবসংযোজক। এবং বাকরুদ্ধ হয়েছিল সেই Hallucinations এর প্রবক্তাও।
(শিরোনামটি দেওয়ার জন্য অশেষ কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি বিশিষ্ট কথাশিল্পী শ্রদ্ধেয়া শান্তশ্রী সোমের প্রতি।)
অসাধারণ লেখা! অনবদ্য analysis. The Mirrow কে অনেক ধন্যবাদ এমন লেখা প্রকাশের জন্য। শেয়ার করছি যথাসম্ভব।