শান্তশ্রী সোম
গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়,
তাতে জাতের কি ক্ষতি হয়।
লালন বলে জাত কারে কয়,
সে ভ্রম ও তো গেল না’—-
সব জাত ধর্মের আধার নিরাকার সাঁই লালন ফকিরের ভাবনা খোঁজার পরিসর এটা নয় । এখন- “তোমার সঙ্গে আমার পেশী শক্তির লড়াই। আমার দাপট, দম্ভ, দাদাগিরি প্রতিফলিত করার সোপান সামনে। শিয়রে সংক্রান্তি।”
তবে ধর্মের এই বেসাতি, জাতের নামে বজ্জাতি যে নতুন নয়, তা আমরা সবাই জানি। ইজরায়েল থেকে গাজা, ফিলিপিন্স থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা, মায়ানমার থেকে বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র থেকে কানাডা, ভারতের আরব সাগর থেকে বঙ্গোপসাগর, সবখানেই মাথার গুণতিতে বেশি যারা, তাদেরই রমরমা। তা শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ, ইহুদি-খ্রিস্টান, শিয়া-সুন্নি, হিন্দু-মুসলমান, উচ্চ বর্ণ-নিম্ন বর্ণ, দলিত অচ্ছুত- ঠাকুর ইত্যাদি সব বিষয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠদের রমরমা।
বিগত ক’টা দিন ধরে বাঙালির সম্বৎসরের উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যে অসহ অসূয়ার প্রকাশ দেখা গেছে, তা দেখে প্রতিটি মানবতাময় প্রাণ গর্জে উঠবে। সে গর্জন আমরা দেখতে পাচ্ছি দেশ কালের সীমা টপকে ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশ, ভারত সহ অন্যান্য দেশের মানবতামুখী মানুষের মনে, বিবেকে, চিন্তায়, চেতনায় ।
এখন গল্পটা কিন্তু আর ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র গণ্ডিতে আটকে নেই । ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে নোয়াখালির দাঙ্গা, পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার সময়ে বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের উপর সংঘটিত নির্যাতন ইত্যাদি বহু কথিত বিষয়গুলো অবশ্যই নতুন করে ভাবার অবকাশ করে দেয়।
এদিকে, এদেশে ‘জয় সিয়ারাম’ থেকে সীতা মাইয়াকে রামেশ্বরমের সমুদ্রের নীল জলে বিসর্জন দিয়ে আসমুদ্রহিমাচল ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’এর শ্লোগান তুলে আমরা পথে প্রান্তরে এখন শুধুই ‘জয় শ্রীরাম’এর জয়ধ্বনি দিচ্ছি। ‘সিয়া’ অর্থাৎ সীতা মা এখন আর আমাদের রামচন্দ্রর পাশে বিশেষ একটা স্থান করে নিতে পারেন না।
বাবরি মসজিদ ইস্যু নিয়ে দিল্লি তথা সমগ্র উত্তর ভারতে যে নরমেধ যজ্ঞ সংঘটিত হল, গুজরাটের ‘পানীয় জলের পাইপ দিয়ে কোনো এক সম্প্রদায়ের মানুষের রক্ত বয়ে যাওয়া’র ঘটনাবলি সবই কিন্তু বিষবৃক্ষে জলসিঞ্চনের ফসল।
সবকিছুর উপরে যে বিষয়টা এই উদ্ভট মশালের সলতে পাকায়, তা হচ্ছে সর্বস্তরের প্রশাসন যন্ত্র । আন্তর্জাতিক, জাতীয়, রাজ্যিক, আঞ্চলিক এমনকি স্থানীয় স্তরে বিভিন্ন গাণিতিক সমীকরণ সমাধানের ভাবনা থেকে সিদ্ধান্ত নির্ধারিত হয়। সেই সমীকরণগুলি ‘ভারি বহুমত’, পরবর্তী দফার আসন দখলের পরিকল্পনাকে কখনোই ছাড়িয়ে যেতে পারে না।
তাই সুকুমার রায়ের মত ‘যদি কিন্তু তবু বটে বাঃ’ এই জাঁতাকলের গেরোয় পড়লে আর যাই হোক, মানবতার যে জেরবার অবস্থা হবে তা বলাই বাহুল্য।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে যে অসহনীয়তা প্রতিটি মানবতাবাদী মনকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে, তাদের সব্বাইকে তার পাশের সংখ্যালঘু মানুষটির অপমান, অবজ্ঞা, অবমাননার সময় সমানভাবে সক্রিয় হতে হবে। এভাবেই হয়তো আমরা একটা বার্তা ছড়িয়ে দিতে পারব। তবে তা কোনো একটা বিশেষ দিন বা ঘটনাকে কেন্দ্র করে মোটেই নয় । সেটা হতে হবে আমাদের নৈমিত্তিক চর্যার বিষয়। আমাদের প্রতিদিনের যাপনের নির্যাস।