The Mirrow

সময়ের প্রয়োজনেই তৈরি হয় সুভাষ

Share the Article

রাহুল রায়

মানুষের হাতেই ইতিহাস তৈরী হয় । গতানুগতিক ধারার পরিবর্তন করে একজন রক্তমাংসের মানুষই হয়ে ওঠে ইতিহাসপুরুষ। সেই হয়ে ওঠার পেছনে প্রধান ভূমিকা নেয় পারিপার্শ্বিক অবস্থা । একটু অন্যভাবে বলতে গেলে সময় তার প্রয়োজনেই মানুষকে মহামানুষ, ইতিহাসপুরুষ করে তোলে । তাহলে কি ব্যক্তির জন্মজাত প্রতিভার গুরুত্ব বলতে কিছু হয় না , সবই পারিপার্শ্বিক উপাদানের অবদান ! না, সেটা নয় অবশ্যই । ব্যক্তির জন্মজাত প্রতিভার গুরুত্ব অবশ্যই আছে, পারিপার্শ্বিক উপাদান সেই প্রতিভার সর্বাঙ্গীন বিকাশে সহায়ক হয় । যে বিকাশই মানুষকে সঙ্গের আরো পাঁচজন মানুষ থেকে আলাদা করে দেয় । দেশ এই বছর নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর ১২৫ তম বর্ষপূর্তি পালন করছে । কটকের আইনজীবি জানকীনাথ বসু ও প্রভাবতী দেবীর নবম সন্তান ছোট্ট ‘সুবি’র ভারতগৌরব নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু হওয়ার পেছনেও সেই ছোটোবেলা থেকেই পারিপার্শ্বিক অবস্থা আপন কাজ নীরবে করে গেছে ।

পিতা জানকীনাথ বসু কোনো দিনই প্রকাশ্যে অহিংস বা বিপ্লবী আন্দোলনে যোগদান করেননি, কিন্তু তিনি কোনোদিনই দেশের মানুষের স্বাধীনতা স্পৃহার বিরোধীতা করেননি । একসময় কংগ্রেসের সভায় নিয়মিত যাওয়া আসাও ছিল । মাতা প্রভাবতী দেবী ছিলেন অত্যন্ত ব্যক্তিত্বময়ী মহিলা । সন্তানদের সুস্থ ভাবে চরিত্রগঠনে যতটুকু স্নেহ, শাসন, স্বাধীনতার প্রয়োজন হয় তিনি তা যথাযথ ভাবেই দিতে পারতেন । ঘরের বাইরে স্কুলে গিয়ে সুভাষ পেয়েছিলেন শিক্ষক বেণীমাধব দাসকে । তিনি ছোট্ট সুভাষকে সবচেয়ে আগে যে শিক্ষা দিয়েছিলেন তা ছিল প্রকৃতির প্রতি প্রেম । সুভাষের পরবর্তী জীবনে বেণীমাধব দাসের প্রভাব পড়েছিল অপরিসীম । তাঁর প্রিয় শিক্ষক বেণীমাধব দাস তাঁর শিক্ষাকে শুধু ক্লাসের গণ্ডিতে আবদ্ধ রাখেন নি বা শুধু নিজের ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা দিয়ে ক্ষান্ত হননি, সর্বাগ্রে তিনি তৈরী করেছিলেন নিজেরই কন্যাকে। তাঁর একমাত্র কন্যা বাণী দাস বিপ্লবী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন এবং দীর্ঘদিন কারাবদ্ধ ছিলেন । ক্ষুদিরাম স্মরণে কলেজিয়েট স্কুলে সুভাষের নেতৃত্বে ছাত্ররা অনশন করলে শাস্তিস্বরূপ প্রধান শিক্ষক বেণীমাধব দাসকে বদলী করে দেওয়া হয়েছিল । কৈশোরে সুভাষের জীবনে আসেন বিবেকানন্দ। তাঁর সঙ্গে বিবেকানন্দের সাক্ষাৎ দেখা না হলেও রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ সাহিত্যের মাধ্যমে সেই মিলন হয়েছিল।  শুরু হয় চরিত্রগঠনের আরো এক অধ্যায় । পনেরো বছরের সুভাষ পেয়ে যান তাঁর মনের খোরাক । একে একে বিবেকানন্দের লেখা সবগুলো বই পড়ে নেন । বিবেকানন্দের বাণী ‘জন্মলগ্ন থেকেই মায়ের জন্য বলিপ্রদত্ত’ হয়ে উঠতে থাকে সুভাষের জীবনমন্ত্র। যে মন্ত্র পরবর্তীতে হয়ে উঠেছিল তাঁর জীবনপথের সারাক্ষণের সঙ্গী।

আই.সি.এস. পরীক্ষা পাশ করেও লোভনীয় সরকারী চাকরী থেকে পদত্যাগ করে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদান করে তরুণ সুভাষ গুরুরূপে পেয়েছিলেন ‘দেশবন্ধু’ চিত্তরঞ্জন দাশকে । মহাত্মা গান্ধীর অনুসৃত নীতিতে স্বচ্ছতা ও দূরদর্শিতার অভাব তাঁর তরুণ উৎসাহী মননে যে হতাশার সৃষ্টি করেছিল চিত্তরঞ্জন দাশের ত্যাগসর্বস্ব আদর্শ, দূরদর্শী চিন্তা, ধর্মনিরেপেক্ষ রাজনৈতিক দর্শন সেখানে আশার আলো হয়ে আসে। শুরু হয় তাঁর রাজনৈতিক পথচলা। তবে যে শুধু ভালো, ইতিবাচক উপাদানই তাঁর পাথেয় হয়েছিল তা কিন্তু নয়। সমসাময়িক ভারতীয় রাজনীতির মুকুটহীন সম্রাট মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে প্রথম থেকেই তাঁর মতের বিরোধ ছিল। গান্ধীজীর পক্ষে নেহেরু, প্যাটেল সহ একাংশ রাজনৈতিক নেতাদের সমর্থন যেমন ছিল, সুভাষের পক্ষে ছিল সাধারণ কর্মীদের সমর্থন। এই টানাপোড়নের রাজনীতির মধ্যে থাকার ফলে দেশীয় রাজনীতি সম্পর্কে তাঁর স্পষ্ট ধারণা হয়ে উঠেছিল যা সম্ভবতঃ তাঁর সময়ের অন্য কারোর আর ছিল না।  দেশে তাঁর রাজনৈতিক জীবন প্রায় দুই দশকের হলেও তখন অধিকাংশ সময়ই তাঁকে ব্রিটিশ বিরোধীতার জন্য কারাগারে থাকতে হয়েছে । অসুস্থ হওয়ায় হাওয়া বদলের জন্য বন্দী থাকা অবস্থাতেই তাঁকে ইউরোপে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে তিনি ব্রিটেন সহ জার্মানী, ইটালী সহ বিভিন্ন দেশ ঘুরে সেখানকার রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন যা পরবর্তীতে তাঁকে তুখোড় কূটনৈতিক হয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল।

আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রখর জ্ঞান, দেশীয় রাজনীতি সম্পর্কে গভীর জ্ঞান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন দেশের বাইরে পাড়ি দিতে উৎসাহী করে তুলেছিল । তিনি ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলেন যে এই বিশ্বযুদ্ধে আর যাই হোক, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শেষ ঘনিয়ে আসছে । আবার একই সঙ্গে এটাও বুঝতে পেরেছিলেন যে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতোই সেবারও আন্দোলনবিমুখ হয়েই থাকবে যার ফলে দেশের স্বাধীনতা আরো কয়েক দশক পিছিয়ে পড়বে। এই পরিস্থিতিই তাঁকে বিদেশে নিয়ে যায়, এই পরিস্থিতিই তাঁকে অস্থায়ী স্বাধীন ভারত সরকারের সর্বাধিনায়ক করে তোলে। সমসাময়িক অবস্থাই শৈশবের লাজুক ‘সুবি’কে পরিবর্তিত করে দেয় অগ্নিপুরুষ ‘নেতাজী’ রূপে, যাঁর জ্বলন্ত আদর্শ, উদাত্ত আহ্বানকে অস্বীকার করার ক্ষমতা মানুষ কেন পাষাণেরও ছিল না ।  

সময়ের প্রয়োজনেই সেদিন সুভাষ এসেছিলেন যদি বলা যায় তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসে, আজ কি তাহলে সমাজে সুভাষের প্রয়োজন ফুরিয়েছে? তাহলে আজ কেন কোনো সুভাষ নেই আমাদের মধ্যে? দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে দেশের সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে তা তো নয়। আজ স্বাধীনতার সাড়ে সাত দশক পরও দেশের অধিকাংশ মানুষই পূর্ণাঙ্গীন স্বাধীনতার স্বাদ নিতে পারেননি, তবু আজ কেন আমরা আমাদের সামনে কোনো সুভাষকে দেখি না। সেই প্রশ্নের উত্তরটা হবে সুভাষদের পরিচয় সমাজে কোনোদিনই শেষ হয় না। এঁরা সমাজের চালিকাশক্তি। যুগ যুগ থেকেই এই ধারা চলে আসছে, আগামীতেও চলবে। সেই ধারা থেমে গেলে সমাজের গতিই থেমে যাবে। প্রাণস্রোত হারিয়ে সেদিন সমগ্র সমাজব্যবস্থাটাই আবদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হবে। অতীতে যথাসময়েই সুভাষ এসেছিলেন, আগামীতেও আসবেন, সময় তার নিজের প্রয়োজনেই সুভাষকে আনবে। এই নিয়মের অন্যথা হওয়ার নয় ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!