The Mirrow

শিলচর সিভিল হাসপাতাল — অতীতের করাল ছায়া

Share the Article

রাহুল রায়

নাগরিকদের প্রতি প্রকারভেদে একটি রাষ্ট্রের যে কয়েকটি বিষয়ে দায়িত্ব নিতে হয় তার মধ্যে স্বাস্থ্য অন্যতম প্রধান। সেই দায়িত্ব যদি যথাযথ ভাবে পালন করা না হয় তাহলে কি হতে পারে গত দু’বছরে সেই শিক্ষা পৃথিবী জুড়েই হয়েছে। এই শিক্ষা থেকে ভারতের এই প্রত্যন্ত কাছাড় জেলার মানুষও বাদ যান নি। শতবর্ষেরও অধিক সময় থেকে শহরের কেন্দ্রে স্থিত সতীন্দ্র মোহন দেব সিভিল হাসপাতাল মানুষের স্বাস্থ্যরক্ষার কাজ করে চলেছে। এই দীর্ঘ সময়ে প্রতিষ্ঠানটি এই অঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্যরক্ষার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখলেও এর স্বাস্থ্যরক্ষা নিয়ে কেউ বিশেষ মাথা ঘামাননি। সেখানে কোনো এক অজানা কারণে শাসকদের মধ্যে বরাবরই একটা অনীহা কাজ করে গেছে। অথচ শহরের বুকে এত বড় জায়গা নিয়ে সিভিল হাসপাতাল আসাম কেন সমগ্র উত্তর-পুর্ব ভারতেই খুব কম আছে। যথাযথ পরিকল্পনা করে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পরিচালনা করা গেলে হাসপাতালটি আজ শুধু অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষই নয় সকল শ্রেণির মানুষের জন্যই অত্যন্ত কার্যকর একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে পারত। স্বাস্থ্য পরিষেবার মূল্য দিনে দিনে আকাশছোঁয়া হয়ে যাচ্ছে। এমনতর অবস্থাতে প্রায় নিরখরচায় পরিষেবা দেওয়া সিভিল হাসপাতাল একটি উপযুক্ত বিকল্প হয়ে পারত। কিন্তু রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক ব্যর্থতা তথা পেশাদারি মনোভাবের অভাবে সিভিল হাসপাতাল দিনে দিনে একটি ‘অসুস্থ’ প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠছে।

গত বছর তথ্য জানার অধিকারের অধীনে প্রশ্ন করলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে হাসপাতাল ভবনটি প্রায় ছয় দশক পুরানো। ১৯৬৮ সনের পর থেকে সরকারের পক্ষ থেকে এটাকে আধুনিকীকরণের কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। এমনকি বড় ধরনের কোনো মেরামতির জন্যও সরকারি কোনো অনুদান আসেনি। করোনার সময়ে দেশের চিকিৎসা পরিকাঠামোকে ঢেলে সাজানোর দাবি করা হলেও সিভিল হাসপাতালের জন্য কিছুই করা হয়নি। ২০১৯ সালে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী তথা বর্তমান রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন যে হাসপাতালটি আধুনিকীকরণে ৩০-৪০ কোটি টাকা খরচ করা হবে। বর্তমানে থাকা ৫০ শয্যা বাড়িয়ে ৩০০ শয্যা বিশিষ্ট একটি আধুনিক হাসপাতাল এখানে গড়ে তোলা হবে। সেই প্রতিশ্রুতি খবরের কাগজেই থেকে গেছে। সিভিল হাসপাতালে কোনো আইসিইউ না থাকায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে কোনো রোগী আসলে তাঁকে চিকিৎসা করার ব্যবস্থা নেই। ২০২০ সনের নভেম্বর মাসে কুড়ি শয্যা বিশিষ্ট একটি আইসিইউ ইউনিট তৈরি করার কাজ শুরু হলেও রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে নতুন বিল্ডিং তৈরি করা হবে বলে সব যন্ত্রপাতি শিলচর মেডিক্যাল কলেজে পাঠানো হয়। এরপর প্রায় দশ মাস সময় চলে গেলেও আইসিইউ ইউনিট বা নতুন অট্টালিকা — কোনোটাই হয় নি। শিলচরের মতো জনবহুল শহরের মধ্যে মাত্র ৫০ শয্যার হাসপাতাল যে প্রয়োজনের তুলনায় কত ছোট এবং এর ফলে রোগীদের অবস্থা যে কি দাঁড়ায় তা সিভিলে না গেলে দেখা সম্ভব নয়। এখানে অস্ত্রোপচার প্রয়োজনীয় কোনো পরিকাঠামো নেই । গত ক’দিন আগে এখানে সার্জারি ও হাড়ের রোগের জন্য চিকিৎসক নিয়োগ করা হলেও পরিকাঠামোর অভাবে তাঁরা প্রায় কিছুই করতে পারছেন না। রোগীর অবস্থা যত খারাপই হোক না কেন, সিভিলের পক্ষে তার অস্ত্রোপচার করা সম্ভব নয়। অত্যন্ত মূল্যবান সময় নষ্ট করে তখন তাঁকে মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যেতে হয়।

এখানে চোখ বা দাঁতের চিকিৎসাও সম্ভব নয় কারণ এখানে কোনো দন্ত বা চক্ষু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। দুই বছর আগে ব্লাড ব্যাঙ্ক খোলা হলেও কর্মী ও পরিকাঠামোর অভাবে সেটা এখন পূর্ণরূপ পায়নি। সন্ধ্যার পর প্রায় সময়ই ব্লাড ব্যাঙ্ক অকেজো হয়ে থাকে। সরকারি উদ্যোগে ‘অমৃত’ বিভাগ থাকলেও প্রয়োজনের তুলনায় অধিকাংশ ওষুধ এখানে পাওয়া যায় না। বাধ্য হয়েই রোগীদের হাসপাতালের বাইরে থেকে চড়া দামে ওষুধ কিনে খেতে হয়। সময় বিশেষে সেই ওষুধ কিনে খাওয়ার ক্ষমতা না থাকলে অসুস্থ অবস্থাতেই রোগীকে ছেড়ে দেওয়া হয়। রাষ্ট্রের মালিকানায় ও পরিচালনায় থাকা একটি স্বাস্থ্যপ্রতিষ্ঠান থেকে যখন মুমুর্ষ রোগীকে মরার জন্য ছেড়ে দিতে হয় তখন তার থেকে বড় লজ্জা  রাষ্ট্রের কাছে আর কিছু হতে পারে বলে মনে হয় না।

( রাহুল রায় একজন সমাজকর্মী ও লেখক। )

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!