The Mirrow

বিচ্ছিন্ন শারদীয় কথামালা

Share the Article

শিঞ্জিনী সৌহার্দ্য

আশ্বিনের মাঝামাঝি         উঠিল বাজনা বাজি,

পূজার সময় এল কাছে।

মধু বিধু দুই ভাই            ছুটাছুটি করে তাই,

আনন্দে দু-হাত তুলি নাচে।

“আসছে বছর আবার হবে” কথাটা ফুরোতে না ফুরোতেই এ বছর মা ফিরে আসছেন। এই একটা বছর কেমন করে কাটলো ঠিক ঠাহর করতে পারলাম না। কিছুটা পাওয়া আর অনেকটা হারানোর মধ্যে দিয়ে যেন ফুড়ুৎ করে কেটে গেলো সময়। তেমনি সময়ের চাকায় মা ফিরে আসেন প্রত্যেক বছর। তাকে ঘিরে, এই পুজোকে নিয়ে কত হৈ হুল্লোড়, নাচ – গান, বৈঠক, আড্ডা, ঘোরাঘুরি, নস্টালজিয়া যুগ যুগান্তর ধরে চলে আসছে আর চলবে।

হ্যাঁ, এটা মনে হতেই পারে যে গেলো বছরের মত হয়তো এবছরের পুজোটাও খুব একটা আনন্দে কাটবে না। তবে এই আসে পাশের সব অশুভকে শুভ করতেই তো মায়ের ফিরে আসা।

তবে কি জানেন, আমাদের জীবনের মন খারাপ করা পুজোর সময়কাল খুব কম (সেটাই হওয়া উচিত)। তবে এমন অনেক “আমি”রা আছে, যারা নিষ্পাপ চোখে আমাদের হাসি মুখ দেখতে দেখতে নিজেদের দুঃখ ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে। হাঁসের মত তাদের নিজের জীবনের কাদা সরিয়ে সেই এক চিমটি সুখ হাতড়ে বেড়ায়।

আমি না খুব একটা ভনিতা করতে পারি না, তাই সোজা কথায় চলে আসছি। ছোটবেলায় শারদোৎসব এর আগমনী প্রহরে “ও……. আয় রে ছুটে আয় পুজোর গন্ধ এসেছে” গানটা বহুবার শুনেছি। তালে তালে কোমর দুলিয়েছি, আধো আধো কথায় গলা মিলিয়েছি। গানের কথায় লুকিয়ে থাকা “কাঁদছো কেন আজ!ময়না পাড়ার মেয়ে! নতুন জামা ফ্রক পাও নি বুঝি চেয়ে?” শুনেছি। ময়না পাড়ার মেয়েটি যে কাঁদছে তা জেনেছি। কান্নার কারণটা হয়তো পুরোপুরি বোধগম্য হয়নি তবে তাকে নতুন ফ্রক উপহার দিয়ে মন ভুলিয়ে খুশি করার চেষ্টাও করেছি। কিন্তু যত বড় হচ্ছি তত সেই গান, গানের কথা, তার পেছনে লুকিয়ে থাকা নিষ্পাপ ভাবনা সব কেমন যেন নতুন জটিল চিন্তাভাবনার ভারে চাপা পড়ে গেছে। পুজোয় বন্ধুদের সঙ্গে যখন খেতে যাই, তখন অনেক খাবার এমনি নষ্ট হয়। তবু কেন সেই দোকানের বাইরে বসে থাকা এক ভাইয়ের তার বোনকে দু মুঠো খাওয়ানোর জন্য হাত পেতে বসে থাকা কে অদেখা করি? কেন বার বার ভুলে যাই “আজ হাসি খুশি মিথ্যে হবে তোমাকে বাদ দিয়ে”?

আমি দেখেছি মিষ্টির দোকানে যখন একটা বাচ্চাকে তার মা বাবা জোর করে মিষ্টি খাওয়ায় আর অনিচ্ছায় সে মিষ্টিটা ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তখন এক কোণে দাঁড়িয়ে দুটি চোখ, চোখের কোণে জল নিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা আরেকজনের ঘৃণার বস্তুকে তার একমাত্র সম্বল বলে মনে করে। টাকা নেই। সে কিনতে পারবে না। আর চুরি করতে গেলে পিঠে পাঁচ ঘা খেতে হবে। তবুও সেই সম্বল সে আঁকড়ে ধরতে পারবে না। কেন? কারণ সে পাঁকের ফোটা কলি। আর পাঁক আমরা মাড়াই না। শেষে তার সম্বলকে সে নালায় ভেসে যেতে দেখে।

এবার একটা ছোট্ট গল্প বলি। জানি না কার কেমন লাগবে। পছন্দ হলে হবে, নাহলে সেরকমই অদেখা করে পাশ কাটিয়ে চলে যাবেন। কেউ আটকাবে না। গল্পটি শুরু হয় শিলচরের কুমোরটুলির অলি গলিতে। জানিনা সেই গলির কি নাম। শুধু এটুকু জানি মা দুর্গা সবার মা হয়ে ওঠার আগে সেখানে থাকা এক সামান্যের মেয়ে। তার হাতেই মায়ের গড়ন, বসন। তার হাত ধরেই মা বড় হয়ে ওঠেন। মেয়ে থেকে নারী। নারী থেকে মা হয়ে ওঠেন। এবার যে মানুষটির জন্যে আমরা এতগুলো সন্তানেরা প্রত্যেক বছর নতুন করে নতুন রূপে মাকে পাই তার ঘরের মেয়ের কেন ঠোঁটের কোণে হাসি দেখিনা? যাকগে। গল্পে ফিরে আসা যাক। এমনই এক শারদোৎসব এর হিমেল বিকেলে এক দলছুটের দলবল সেই কুমোরটুলি তে গিয়ে হাজির হলেন। কাঁধে ঝোলা আর তাতে ক্যামেরা নিয়ে। সঙ্গে এক সুন্দরী মায়ের সাজে সজ্জিত। উদ্দেশ্য – মৃন্ময়ীর ছায়ায় চিন্ময়ীর ছবি তোলা হবে। তারপর তা সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়া হবে। সঙ্গে “আমার দুর্গা ত্রিশূল ধরেছে স্বর্গে এবং মর্তে, আমার দুর্গা বাঁচতে শিখেছে নিজেই নিজের শর্তে” গোছের একটা সোশ্যাল মেসেজ মার্কা ক্যাপশন দিয়ে পোস্ট। তাতে কত লাইক কত কমেন্ট। তা ফটো তোলা হচ্ছে এমন সময়ে গুটি গুটি পায়ে এক ছোট্ট দুর্গা কোথা থেকে বেরিয়ে এলো। না ঠিক বেরিয়ে আসেনি, ওই পেছনে আরেকটি মৃন্ময়ীর ছায়ায় সে দাঁড়িয়ে। এমন গুটিশুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে যে সেই মিনি চিন্ময়ীর দিকে কারোর নজরই পড়লো না। তবে সে সব দেখছে। তার ছোট্ট দেহের মস্ত চোখ দুটো দিয়ে সে হাঁ করে তাকিয়ে দেখছে তারই দিদির বয়সী আরেকটা মেয়ের দিকে। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে ফ্ল্যাশের চোখ ঝলসানো আলোর দিকে। দেখলো কেমন করে সেই আলোটা সুন্দরীর সৌন্দর্য্য আরো কত গুণ বাড়িয়ে দিল।  বুঝতে পারছে না এই দুজনের সাজপোশাকে এত তফাৎ কেন! তবে মেয়ে এটাও বুঝতে পারে না এই ঘেঁচাং ফু মার্কা শব্দ শুনেও সেই চিন্ময়ী একচুলও নড়লো না! ঘাড় ঘুরিয়ে আরেকবার দেখে নিল তার দিদিকে। দিদি ওদিক থেকে হাসছে। হাসি এমন যেন বলছে “কি রে! দেখছিস ওরা কত সুন্দর। তুইও একদিন অমন সুন্দর হবি।” সে আবার মাথা ঘুরিয়ে নেয়। এবার মেয়ের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটেছে। সুখের না দুঃখের বোঝা দায়। ফটো তোলা শেষ হলে দলছুট ফিরে আসে। মেয়েটিকে দেখতেও পায় না তারা। তবে দেখলেও বা কি লাভ হতো জানি না। হয়তো কয়েকটা ফটো তোলা হতো ব্যাস। তাতে কি পেটের ক্ষিধে মেটে?

এমন অনেক মিনি চিন্ময়ী আছে যারা তাদের অতি ছোট্ট জীবনকালে অনেক কিছু দেখেছে, বুঝতে হয়েছে যা “আমরা” সেই বয়সে কেন এখনও বোঝার ক্ষমতা রাখি না। কবি বলেছেন “আমার দুর্গা বাঁচতে শিখেছে নিজেই নিজের শর্তে”। কিন্তু কেন। কেন ওই ছোট্ট দুর্গাকে এই কঠিন পথ ধরতে হবে। কেন তাকে সময়ের আগেই বড় হয়ে যেতে হবে। কেন তার চোখ সারল্য হারিয়ে ফেলবে পৃথিবীর জটিলতার তোড়ে?

এটা রুখতে পারি। খুব কঠিন কোন বিষয় না। এখন আর অন্যের দিকে আঙুল তোলার সময় নয়। এই আমাদের উঠতি প্রজন্মের ঘাড়েই নিতে হবে দায়িত্ব। আমরা এই আজকের প্রজন্ম অনেক সোশ্যাল ইস্যু নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া তে গলা তুলতে জানি, সেভাবেই সেই ছোট্ট দুর্গার জীবনে এক রত্তি খুশি ছড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা করতে পারি না! তাকে আর তার অপুকে রেললাইনের ধারে ভিক্ষে করতে বাধ্য না করে কাশফুল দেখার আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারি না!

শুধু বলতে ইচ্ছে করছে- এসব পদ্য এবার বন্ধ হোক।

“তোমার দুর্গা মহালয়া ভোরে শরত মাখছে গায়।

আমার দুর্গা এখনো দেখছি ফুটপাথে জন্মায়।।

তোমার দুর্গা অকালবোধন একশো আটটা ফুল।

আমার দুর্গা দূর থেকে দেখে খিচুড়ির ইস্কুল।।”

3 thoughts on “বিচ্ছিন্ন শারদীয় কথামালা”

  1. VIVEKANANDA MOHANTA

    Excellent!!অন্তরের গভীরে জেগে উঠা অনভূতিকে কী সাবলীলভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন! আপনাকে নমস্কার জানাই।—-বিবেকানন্দ মোহন্ত।

  2. দীপমালা

    অনায়াসে কঠিন সত্যটা সবার মুখের উপর বলে ফেললেন। ধন্যবাদ আপনাকে

  3. মঞ্জরী হীরামণি

    ভীষণ ভালো লিখেছ শিঞ্জিনী। তোমার এই খোলা চোখকে কুর্ণিশ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!