সুনীল কুমার সরকার
এসো প্রশ্ন করি, বার বার করি। প্রশ্ন করার মধ্যদিয়ে প্রকৃত সত্যে উপনীত হই। তুমি নিজের চোখে যা দেখছো বা নিজের কানে যা শুনছো, সব সময় তা সত্য নয় – পরীক্ষা বা গবেষণায় এটা প্রমাণিত। বার বার প্রশ্ন, পর্যবেক্ষণ, নিরীক্ষণে অস্বচ্ছতা দূর হয়, প্রশ্নের সঠিক উত্তর পাওয়া যায়।
আমাদের এলাকার আশেপাশে কখনও কখনও দেখা যায় অশুভ আত্মার আবির্ভাব ঘটেছে , মানুষ যজ্ঞ শুরু করেছে। কোথাও গাছ পুজো হচ্ছে , কখনও কখনও নদীকে হঠাৎ করে ব্যাপকভাবে পুজো করা হচ্ছে , সন্তান-সন্ততির কল্যাণে। আবার কোথাও খাজা-বাবা বা পীর-বাবারা জলপড়া , তেল পড়া দিচ্ছে, ক্যান্সারসহ কঠিন কঠিন অসুখ সেরে যাচ্ছে নাকি! পিছিয়ে পড়া সমাজে কোথাও কোথাও ডাইনি হত্যার নামে অসহায় মানুষকে স্বার্থন্বেষীরা খুন করছে, কায়েমিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য , কখনো সম্পত্তির লোভে তো কখনও অন্য বদ-উদ্দেশ্যে। প্রয়োজনে ডাইনি অপবাদ দিয়ে খুন করা হয়, জানগুরু ও ওঝারা সক্রিয় হয়ে ওঠে ডাইনি প্রথাকে টিকিয়ে রাখার জন্য।
এদিকে দৈনিক পত্রিকাগুলির দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় আগে দেখা যেত ‘হারানো-প্রাপ্তিস্বীকার’ , ‘নিরুদ্দিষ্টের প্রতি পত্র’ , ‘কর্মখালি’ , ‘কিডনি চাই’ , ‘চক্ষুদানে আগ্রহী’ ‘রক্তদান শিবির’সহ অন্যান্য দৈনিক প্রয়োজনীয় মানবিক বিজ্ঞাপন। এখন সেখানে বিজ্ঞাপন থাকে জ্যোতিষ চর্চা, ফেংসুই, তথাকথিত বাস্তুবিজ্ঞানসহ আজগুবি কিছু পদ্ধতির, ছবিসহ। এই জ্যোতিষ-বুজরুকি এখন পেশা হিসেবে উঠে এসেছে দারুণভাবে। ছবিগুলিতে দেখা যায়, কপালে সিঁদুরের লম্বা টিপ, কারো কপালে ফেট্টি , গলায় বিভিন্ন মাপের রুদ্রাক্ষের মালা , চোখেমুখে কারো তেজ আবার কারও প্রশান্তিভাব, সমস্ত ছবিগুলিই সুন্দর যুবক-যুবতীদের, এরা নতুন পেশা ও প্রাক্টিসে শামিল হয়েছে। বেশিরভাগের পদবী শাস্ত্রী, আচার্য, মহাপীর, বড়পীর। থাকছে পূজাপাঠ-এ প্রতিকার, বশীকরণ। এক দিনে বশীকরণ, এক ঘন্টায় বশীকরণ, তিন মিনিটে বশীকরণ – দক্ষিণা কোথাও ৪০১ তো কোথাও ১০০১, বিফলে মূল্য ফেরত। আবার ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে সেই বাবা ও আধুনিক পীরদের বক্তৃতা, বিভিন্ন সাজেশন। তাবিজ কবজ থেকে দ্রব্য সামগ্রী কেনার প্রেসক্রিপশন – বিভিন্ন সাইজের মূর্তি, ভোঁতা ব্যাঙ আবার পেঁচাও।
অপরদিকে ধর্মগ্রন্থের কথা , অলৌকিক গল্প-কাহিনী যে বিজ্ঞানের চেয়েও শক্তিশালী তারও ওকালতি চলছে। পরিকল্পিতভাবেই অপবিজ্ঞান, মন্দবিজ্ঞান, কুশিক্ষা, কুসংস্কার ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সমাজকে পেছনদিকে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াস নতুন করে শুরু হয়েছে। গণেশের মাথায় হাতির মাথা বসানো নাকি প্রাচীন ভারতে প্রথম প্লাস্টিক সার্জারির উদাহরণ । ইন্টারনেট, টিভি, স্টেম সেল এগুলি মহাভারতের যুগে আবিষ্কৃত হয়েছিল। স্টেম সেল প্রযুক্তি ব্যবহারে নাকি কৌরবদের জন্ম। যুদ্ধবিমান, পারমাণবিক অস্ত্র এগুলি রামায়ণ ও মহাভারতের সময়কার। রামায়ণের সীতা প্রথম টেস্টটিউব বেবি। ডারউইনের বিবর্তনবাদ ভুল, তাই তাকে পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেওয়া উচিত। কথাগুলি রীতিমতো শিক্ষিত মানুষ এবং দেশের তথাকথিত বিশিষ্টজনেরা বলছেন, নিদান দিচ্ছেন। বিশ্বের যা কিছু আবিষ্কার সবই বৈদিক ভারতে হয়েছে অর্থাৎ ‘সবই ব্যাদে আছে।’ এগুলি সত্য এবং চূড়ান্ত সত্য, সুতরাং নতুন করে সত্যতা যাচাই, গবেষণা বা জানার দরকার নেই! সুতরাং পরীক্ষা-নিরীক্ষা-অনুসন্ধিৎসার আর প্রয়োজন নেই, যা বলছি তাই শোনো, মেনে নাও !
জ্যোতিষীরা মঙ্গল গ্রহের কু-দশা কাটানোর জন্য লাল রঙের গোমেদ পাথর পরতে বলেন। মঙ্গল গ্রহের মাটিতে লোহার পরিমাণ বেশি থাকায় মাটির রং লাল আর সেই মঙ্গলের দশা কাটানোর জন্য লাল পাথর! প্রশ্ন জাগে, নীল পাথর বা সাদা পাথর নয় কেন। আমরা তো জানি রাতের কালো অন্ধকার তো সবচেয়ে বিপদসংকুল, তবে তার দশা কাটানোর জন্য তো কালো স্টোন চিপস প্রেসক্রাইব করা উচিত জ্যোতিষীদের। সস্তা বা প্রায় বিনে পয়সার স্টোন চিপস সহজেই মানুষের অন্ধকারের অমঙ্গল দূর করতে পারে! অপরদিকে জ্যোতিষীরা বেকারদের চাকরি দেয়, গরীবকে বড়লোক করে, বিবাহযোগ্যা মেয়ের বিবাহের ব্যবস্থা করে। কিন্তু একটা চিরকালীন সহজ প্রশ্ন বরাবর উঠে এসেছে, সাধারণত জ্যোতিষীদের আর্থিক অবস্থা খারাপ হয় কেন!
সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা, অশিক্ষা, অন্ধবিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে কিছু দুষ্ট পেশাদারেরা এই সব কাজকর্ম চিরাচরিতভাবে করে আসছে। সম্প্রতি এই অন্ধচিন্তা , অপবিজ্ঞানকে যেন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রমোট করা হচ্ছে! অন্ধবিশ্বাস , কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের জেহাদ আজীবন। ধর্ম ও বাইবেলের গোঁড়ামি ও ভ্রান্ত ধারণার বিরুদ্ধে যুক্তি দেওয়ায় ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারা হয়, গ্যালিলিওর চোখ উপড়ে নেওয়া হয়। তবে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শেষে বিজ্ঞান এবং সত্যেরই জয় হয়েছে, পরিশেষে কুসংস্কারই পরাজিত হয়েছে বিজ্ঞানচিন্তা, অনুসন্ধান, নিরন্তর গবেষণার কাছে। এভাবেই যুক্তিবাদী মনন তৈরি হতে হতে যুক্তিবাদই প্রতিষ্ঠিত হয়। কিছু বছর আগে ভ্যাটিকানের পোপ স্বীকার করেন , ব্রুনো ও গ্যালিলিওদের হত্যা ও অত্যাচারে তখনকার গোঁড়া সমাজ অন্যায়ই করেছিল!
দেশের বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সংগঠনগুলির ধারাবাহিক প্রচারের ফলে সাধারণ জনমানসে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার অনেকটাই কমেছে সত্যি কথা। দুশো বছর আগে থেকেই রামমোহন, ডিরোজিও, বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে কুসংস্কার-ভাবনার বিরুদ্ধে যুক্তিবাদী মনন গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়েছে । ভারতের সংবিধানের ৫১এ (এইচ) ধারায় পরিষ্কারভাবেই বলা আছে – বিজ্ঞানমনস্কতা, মানবতাবাদ, অনুসন্ধিৎসু মন ও সংস্কারের (reform) মানসিকতার বিকাশ ঘটানোর জন্য সচেষ্ট থাকা দেশের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
কিন্তু অন্ধবিশ্বাসে বিশ্বাসী কিছু সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান পরিকল্পিত ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য এই গোঁড়ামিকে হাতিয়ার ক’রে শিক্ষিত, যুক্তিবাদী, প্রগতিশীল মানুষদের ওপর আক্রমণ নামিয়ে আনছে। এক মহান যুক্তিবাদী মানুষ খুব সুন্দরভাবে বিজ্ঞানমনস্কতার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে – কোনও তথ্য, বার্তা বা ঘটনা সত্যি কিনা তা বোঝার জন্য বার বার অনুভব-অভিজ্ঞতা দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে হবে, যাচাই করতে হবে, অন্ধভাবে কোনও কিছুকেই গ্রহণ করা যাবে না। তাঁর মতে – “শুধুমাত্র ততটুকুই গ্রহণ করা উচিত যতটুকুর পেছনে পরিষ্কার তথ্যপ্রমাণ রয়েছে।” যুক্তি, বুদ্ধি, সুচেতনা, মানবতা আর মুক্তচিন্তার এই দিশারী তাঁর সারাটা জীবন অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, অলৌকিকতা, বুজরুকি আর অতিপ্রাকৃত ধ্যান ধারণার বিরুদ্ধে যুক্তিবাদের পক্ষে জনমত গড়ে তুলেছেন । মানুষটি ডাঃ নরেন্দ্র অচ্চুৎ দাভোলকার। মহারাষ্ট্রজুড়ে তিনি গড়ে তুলেছিলেন ‘মহারাষ্ট্র অন্ধ শ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতি (MANS)’ নামে যুক্তিবাদী সংগঠন। মহারাষ্ট্র সরকারের কাছে অলৌকিকতা ও কুসংস্কারবিরোধী বিল আনার জন্য আন্দোলন করছিলেন দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু ২০১৩ সালের ২০শে আগস্ট উগ্র সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসবাদীরা তাঁকে হত্যা করে। প্রসঙ্গত ডাঃ দাভোলকার খুন হওয়ার কিছুদিন পর মহারাষ্ট্র বিধানসভায় কুসংস্কার ও অলৌকিকতা বিরোধী বিল পাস হয়। ডাঃ দাভোলকারকে স্মরণে রেখে, তাঁর অধুরা কাজ জারি রাখার প্রতিজ্ঞায় দেশের বিজ্ঞান সংগঠনগুলি প্রত্যেক বছর ২০শে আগস্ট দিনটিকে ‘জাতীয় বিজ্ঞান মনস্কতা দিবস(National Scientific Temper Day)’ হিসেবে উদযাপন করে আসছে ২০১৮ সাল থেকে । পরবর্তীতে বিখ্যাত লেখক গোবিন্দ পানসারেকে খুন হতে হয় ২০১৫ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি, আবার সাহিত্য একাডেমী প্রাপ্ত কর্ণাটক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর এমএম কালবুর্গিকেও হত্যা করা হয় ২০১৫ সালের ৩০শে আগস্ট, খুন হন স্বাধীনচেতা সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ ২০১৭ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর, খুন হয়েই চলছেন স্বাধীনচেতা সাংবাদিক ও ব্লগাররা।
আসলে এই হত্যাগুলি শুধু হত্যা নয়, এর মধ্যদিয়ে আক্রমণ করা হচ্ছে যুক্তিবোধের ওপর, বিজ্ঞান মানসিকতার ওপর, সহিষ্ণুতা ও আমাদের দেশের বহুত্ববাদী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর। তবে দেশের সংবিধানের ওপর মানুষের সম্পূর্ণ আস্থা ও ভরসা রয়েছে। সংবিধানের ৫১ এ (এইচ) ধারার ওপর ভিত্তি করেই দেশে গৃহীত উন্নয়ন পরিকল্পনায় বিজ্ঞানভাবনা লাগু হোক আর আজকের দিনে অপবিজ্ঞান-মন্দবিজ্ঞানের আরাধনা বন্ধ ক’রে এখনই সামাজিক ব্যাধিসহ করোনা ও বিভিন্ন অসুখের চিকিৎসায় আধুনিক বিজ্ঞাননির্ভর ভাবনাই জারি থাকুক।
—————————-
( লেখক পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ’র কর্মী। এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত সম্পূর্ণ লেখকের। )