Share the Article
রজতকান্তি সিংহচৌধুরী
ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে 'পথের পাঁচালি'-র আবির্ভাব ছিল এক বিস্ময়কর বৈশাখী ঝড়, যা ছায়াছবি সম্পর্কে আমাদের এতাবৎ লালিত ধ্যানধারণাকে তছনছ করেই ক্ষান্ত হয়নি, বুকভরে প্রশ্বাস নেবার জন্য এনেছিল অফুরন্ত সুপবন। বাংলা তথা বিশ্বের ছবি পেয়েছিল এক অননুকরণীয় শিল্পীকে। বিশ্ববরেণ্য জাপানি চলচ্চিত্রকার আকিরা কুরোশোয়া তাই বলতে পেরেছিলেন, সত্যজিৎ রায়ের ছবি না দেখা এই গ্রহে বসবাস করে সূর্যকে না চেনার শামিল।
বঙ্গসংস্কৃতির অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রবহমান মানবিক বাস্তবতাকে সংবেদী শিল্পনৈপুণ্যে চলচ্চিত্রের অঙ্গনে সঞ্চার করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। বলা ভালো, এ ঘটনা উত্তর- 'নাগরিক' ঋত্বিক তথা উন্মীলমান মৃণালের বুকে বল জুগিয়েছিল এবং এই পুরোধা ত্রয়ীর উত্তরসূরী পরম্পরায় ভারতীয় ছবিতে নব্যধারার সৃষ্টি হয়েছিল।
প্রথম দশ বছরকার ফসলের সাজিতেই ছিল অপু -ত্রয়ী ছাড়া 'পরশপাথর 'জলসাঘর','দেবী','কাঞ্চনজঙ্ঘা','তিন কন্যা','চারুলতা'-র মতো কাহিনিচিত্র এবং 'রবীন্দ্রনাথ'-এর মতো তথ্যচিত্র।
যে-কোনো শিল্পীর সারা জীবনের কাজ হবার যোগ্য এই ছবিগুলিই যেন যথেষ্ট নয়, এমন শৈলীতে পরবর্তী দশ বছরে তাঁর হাত থেকে পেলাম 'গুপী গাইন বাঘা বাইন','নায়ক', 'প্রতিদ্বন্দ্বী','অরণ্যের দিনরাত্রি', 'সীমাবদ্ধ',''শতরঞ্জ কে খিলাড়ি', 'জন-অরণ্যে'-র মতো মণিমুক্তো। এক অর্থে তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণেরই শেষ উত্তরসূরি। তাঁর প্রিয় উনিশ শতকের পটে একের পর এক পিরিয়ড পিস তৈরি এবং সাহিত্যের ক্লাসিকগুলির চলচ্চিত্রায়ণের পাশাপাশি সমকালীন কলকাতা ও বাংলার পটভূমি তাঁর ছবিতে এ পর্বে উঠে আসছিল।
এই সময়েই বাংলার সবচেয়ে সুপরিচিত শিশুসাহিত্যিক পরিবারের উত্তরসূরি হাত দিলেন ছোটোদের জন্য লেখালেখি ও সম্পাদনায়। 'সন্দেশ'-এর পুনরুজ্জীবন ছাড়াও আমাদের প্রাপ্তি ফেলুদা এবং প্রফেসর শঙ্কু। সহজ সরল আবেগবর্জিত এক বাংলা গদ্যের নির্মাণ তাঁর হাতে।
প্রথম ছটি ছবিতে রবিশঙ্কর,আলি আকবর বা বিলায়েত খাঁর মতো গুণিজনকে ভার দিলেও ইতিমধ্যে নিজের ছবির সংগীতরচনা তিনি নিজের হাতেই তুলে নিয়েছেন;চিত্রশিল্পী হিসেবে ছবির পোস্টার আঁকা বা বইয়ের প্রচ্ছদ, অলংকরণ তো আগাগোড়াই ছিল।[বস্তুত,দিলীপকুমার (ডি কে) গুপ্তের সিগনেট প্রেসের জন্য 'পথের পাঁচালি'-র কিশোরপাঠ্য সংস্করণ 'আম আঁটির ভেঁপু '-র অলংকরণ করতে গিয়েই সত্যজিৎ তাঁর প্রথম সিনেমাটি করবার প্রেরণা পান।]
ক্রমশ 'সোনার কেল্লা','জয় বাবা ফেলুনাথ','হীরক রাজার দেশে','সদগতি','পিকু','ঘরে বাইরে'-র মতো ছবিগুলি একে একে তৈরি হতে থাকে। ছোটোদের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা তাঁর শিশুচলচ্চিত্রগুলিতে মুকুলিত। এ যেন তাঁর পরম্পরাবাহিত ঐতিহ্যেরই বিস্তার। ফি-বছর তাঁর হাত থেকে একটা নতুন ছবি পাবার জন্য মুখিয়ে থাকা অপামর বাঙালি দর্শকের ভেতরে ছিলাম শিশুকিশোর থেকে পরিণততর হতে-থাকা আমাদের প্রজন্মের মানুষেরাও।
এমনকী শেষ পর্বে প্রায়-গৃহবন্দি অবস্থাতেও তাঁর নির্মাণ ইবসেনের কালজয়ী নাটক অবলম্বনে 'গণশত্রু' কিংবা নিজেরই কাহিনি থেকে 'শাখাপ্রশাখা' অথবা 'আগন্তুক'-এ চমৎকারিত্বের উপাদান চোখ এড়াবার নয়।
এই অমর স্রষ্টাকে তাঁর জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য।