The Mirrow

কোভিডকালে করিমগঞ্জ রামকৃষ্ণ মিশনের দরিদ্রসেবা

Share the Article

বিশেষ প্রতিবেদন

‘কৃত কর্মফল ভূঞ্জিতে হইবে’

বলে লোকে, ‘হেতু কার্য প্রসবিবে,

শুভ কর্মে-শুভ, মন্দ- মন্দফল,

এ নিয়ম রোধে নাই কারো বল …।

কর্মের ফলাফলের হাত থেকে নিস্কৃতি কীভাবে পাওয়া যায়? শ্রীমদ্ভাগবদ  গীতায় তাই শ্রীভগবানের মুখ নিঃসৃত বাণী —

“কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন, …..” কর্মে তোমার অধিকার, ফলে নয়। কর্মের যাঁতাকলরূপ জন্মচক্রের হাত থেকে রেহাই পেতে হলে একমাত্র নিস্কাম কর্মযোগের সামিল হতে হবে। এই কথাই সমস্ত ধর্মে ও শাস্ত্রের একটা নির্যাস সুত্র। কিন্তু মনুষ্য হৃদয়ের ছোট্ট মনের মধ্যে কর্মযোগে কখন যে ‘ক্ষুদ্র আমিত্ব’ রূপ বস্তুটি মাথাচাড়া দিয়ে অহং-এর প্রকাশ করে ফেলে তা বড় বড় কর্মবীরের কাছেও হতাশার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ‘ক্ষুদ্র আমির’ গণ্ডি পেরিয়ে বৃহত্তর ‘আমি’র দিকে অগ্রসর হতে শিখলে তবেই নিস্কাম কর্মযোগে ব্রতী হতে পারব। তাই নববেদান্তের জনক যুগাচার্য স্বামী বিবেকানন্দের ভাষায় “জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর”। প্রত্যেক জীবের বিশেষ করে মানুষের পূজা-সেবা করলে ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করা যায়। এই সেবাযজ্ঞ শুরু করেছেন ভগবান রামকৃষ্ণ স্বয়ং। মথুরবাবুর সঙ্গে কাশী বৃন্দাবনাদি তীর্থদর্শনে স্বর্গীয় বৈদ্যনাথের নিকটবর্তী কোনও গ্রামের ভিতর দিয়ে যাবার সময় গ্রামবাসীর দুঃখ-দারিদ্র্য দেখে শ্রীরামকৃষ্ণের হৃদয় একেবারে করুণায় পূর্ণ হয়ে যায়। পরে মথুরবাবুর সহযোগীতায় সেই সমস্ত গরীর মানুষদের পেট ভরে খেতে দেওয়া ও কাপড় দেওয়ার মধ্যে দিয়ে সেবা কাজ সমাধা করেন।

 ‘পিতৃদেব ভব, মাতৃদেব ভব, আচার্যদেব ভব, অতিথিদেব ভব’ স্বামী বিবেকানন্দের নতুন ধর্মে-‘মূর্খ দেব ভব, দরিদ্র দেব ভব।’ তাই রামকৃষ্ণ মিশন শুরু থেকেই এই সেবাকাজ সচ্ছন্দ গতিতে এবং নিঃশব্দে করে চলেছেন। শুধুমাত্র ত্রাণকার্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। রামকৃষ্ণ মিশন শিক্ষা, চিকিৎসা এবং বিভিন্ন উন্নতিমূলক কাজের অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে চলেছে। সেই কর্মের ধারাবাহিকতা হিসাবে রামকৃষ্ণ মিশন, করিমগঞ্জ শাখা কেন্দ্রও সেবা কাজে অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলেছে। তাঁরা বস্তি এলাকায় ও গ্রামের ২০০ জন গরীব ছাত্র-ছাত্রীদের সম্পূর্ণভাবে শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও নৈতিক চরিত্র গড়ে তোলার দায়িত্ব তুলে নিয়ে নিঃশব্দে কাজ করে চলেছেন। গরীব মানুষদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থাও আছে। সর্বোপরি ত্রাণকাজেও তাঁদের অতুলনীয় উদাহরণের জুড়ি পাওয়া ভার।

২০২০ খ্রিস্টাব্দে যখন ভয়ংকর ছোঁয়াচে রোগের প্রকোপ ভারতবর্ষ তথা সমগ্র পৃথিবীকে আক্রমণ করল এবং সেই প্রকোপ আসাম প্রদেশেও আছড়ে পড়ল, তখন আসাম সরকার তথা ভারত সরকারও সমস্ত মানুষকে গৃহবন্দি করেছিল। জীবন বাঁচাতে গিয়ে বহু মানুষ জীবিকা হারিয়ে বসল। করোনার ভয়ে প্রতিষ্ঠিত ভদ্র সমাজ যখন গৃহদ্বার বন্ধ করে মুখ ঢেকে নিশ্চিন্তে দিনযাপন করছেন, তখন জীবিকাহীন নিরন্ন মানুষের দিকে তাকাবার সময় কারো হয়ে ওঠেনি। সেই সমস্ত মানুষের পাশে রামকৃষ্ণ মিশন সহমর্মী হয়ে সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেন সতস্ফূর্তভাবে। তাঁদের এই নিষ্কাম কর্মযোগে ভয়ঙ্কর ছোঁয়াচে রোগের মৃত্যু ভয়কে উপেক্ষা করে বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবক এগিয়ে এসেছেন। করিমগঞ্জ শহরের বস্তি এলাকায় এবং প্রত্যন্ত গ্রামে অবহেলিত মানুষের খোঁজে এই সকল স্বেচ্ছাসেবী-দল অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। ঐ সমস্ত নিরন্ন মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে স্বেচ্ছাসেবির দল রামকৃষ্ণ মিশন প্রেরিত ত্রাণের কার্ড বিলি করেছেন। ত্রাণ বিলি করার শুকনো সামগ্রীগুলো খুবই নিষ্ঠার সঙ্গে দিনরাত পরিশ্রম করে সেগুলো প্যাকেটিং করেছেন। ত্রাণে ছিল – চাল, ডাল, চিনি, আলু, পিঁয়াজ, তেল, দুখ, চা, বিস্কুট, লবণ, মশলা, সাবান ও মাস্ক বিতরণের ব্যবস্থা সম্পূর্ণ নিয়ম শৃঙ্খলাযুক্ত যা দর্শনীয় এবং শিক্ষনীয়। মিশনের প্রাচীরের বহির্ভাগে পথচারী রাস্তায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য তা চিহ্নিত সীমার মধ্যে একজন করে দাঁড়ায় এবং সেই দূরত্ব বজায় রেখে এক এক করে মহারাজদের হাত থেকে শ্রীভগবানের প্রসাদি সামগ্রী হিসাবে গ্রহণ করেন।

সত্যিকারের পূজার ডালি সাজিয়ে নারায়ণ জ্ঞানে মানুষের পূজার ভাব, এখানেই বিরাটের পূজার যথার্থতা এবং শিবজ্ঞানে জীব সেবা। যজ্ঞে অংশগ্রহণকারী সেবকদের ক্ষুদ্র অহং-এর গণ্ডি পেরিয়ে একটা মনে বিরাট তৃপ্তির ছোঁয়া নিয়ে ফিরতে পারে এবং জীবনের কিছুটা সার্থকতা ফিরে পায়।

কোভিড-১৯ এর প্রথম লকডাউনে করিমগঞ্জ এলাকায় রামকৃষ্ণ মিশন প্রায় দু’মাস ধরে ৭৮টি বস্তি এলাকায় সার্ভে করে ৬১২৪ টি পরিবারের হাতে শুকনো খাবার সামগ্রী তুলে দিয়েছেন। দ্বিতীয়বারের অর্থাৎ ২০২১ সালের দ্বিতীয় প্রকোপের সময়ও ২৯টি এলাকায় সার্ভে করে ২৭৬৫ টি দুঃস্থ পরিবারের হাতে শুকনো সামগ্রী তুলে দিতে সমর্থ হয়েছেন। এই কাজে মিশন প্রায় ৩২ লক্ষ টাকার সামগ্রী বিতরণ করতে সমর্থ হয়েছেন।  

কোভিডের সেবাকাজের জন্য আসাম সরকার করিমগঞ্জ রামকৃষ্ণ মিশনকে সর্বোচ্চ আসনে ভূষিত করেছেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!