সঞ্জীব দেবলস্কর
সচরাচর বাঙালিরা পঁচিশে বৈশাখ কিংবা বাইশে শ্রাবণে আবেগে মোড়া লিখিতভাবে বা মৌখিক বাচনিক কিছু বাক্য বলেন — কবিগুরু আমাদের আত্মার আত্মীয়, তিনি আছেন আমাদের মননে চিন্তনে ধ্যানে ইত্যাদি। সরকারি উদ্যোগে পণ্ডিত, গবেষকদের এদিন মঞ্চে এনে গলায় গামোছা পরিয়ে দিয়ে ভাষণের জন্য হাজির করাও হয়, প্রচু্র যন্ত্রানুষঙ্গ-সহ জনপ্রিয় শিল্পীরাও মঞ্চে গানের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা এক অপার্থিব সত্তার উদ্দেশে কিছু সুরমাখা বাক্যও ভাসিয়ে দেন প্রেক্ষাঘরের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। সমস্কৃতিমনস্ক নেতা, মন্ত্রী, তস্য সাগরেদ এবং জনগণ এর প্রসাদ পেয়ে নতমস্তকে বাড়ি ফিরে যান।
সমস্ত মিথ্যার আবরণ সরিয়ে যদি বলি, এ মুহূর্তে বাঙালি জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা যেন ফুরিয়ে আসছে। যে-বাঙালি একসময় রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিতে নিজের মুখেরভাষা খুঁজে পেত, রবীন্দ্রনাথের গানের ভিতর খুঁজে পেত নিজের হৃদয়ের সংগীতের উৎস, যে-বাঙালির জীবনচর্যায় একসময় মিশে ছিল রবীন্দ্রভাবানুষঙ্গ সেই বাঙালির ভাষা তাঁর আভিজাত্য হারাতে বসেছে, বাঙালির সংগীত হারিয়ে ফেলছে তার মাধুর্য; এই বাঙালির দেশচেতনা, সমাজভাবনা, জাতীয় গৌরবও আজ প্রায় নিঃশেষ। আসমুদ্র হিমাচল সর্বত্রই বাঙালি আজ যেন কৃপার ভিখারী।
বাঙালির অন্যতম ভূমি পশ্চিমবঙ্গ কিংবা ভারিতীয় রাষ্ট্রসীমার ভিতর ক্ষুদ্র, মাঝারি অপর-বঙ্গ — আসাম-ত্রিপুরা-বিহার-ঝাড়খণ্ড কিংবা রবীন্দ্রসম্পর্কধন্য মেঘালয় ( স্মর্তব্য ‘শেষের কবিতা’র পটভূমি হিসেবেও শিলং আজ বিশ্বজনের কাছে পরিচিত) এমনকী মণিপুরেও (‘চিত্রাঙ্গদা’ নাটিকা বা মণিপুরি নৃত্যকালাকে জগতের কাছে তিনিই হাজর করেছেন) বাঙালি আজ খুব সম্মানের জায়গায় নেই, নিরাপত্তায়ও নেই।
অনেকে কথঞ্চিত উচ্চকণ্ঠেই বলেন আমাদের রাজ্যে নাকি রবীন্দ্রনাথ খুব শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত। তাঁর নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন আছে, কিছুদিন হল তাঁর নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে (শুধু এতে আনুষ্ঠানিক ভাবে তাঁর ‘মাতৃমন্দির পুণ্য অঙ্গন করো মহোজ্জ্বল আজ হে’ গীতটি পরিবেশিত হলে ভ্রূকুঞ্চনের খবরও আসে)। হ্যাঁ, প্রতি বছরে অন্তত একটি দিন নিয়ম মেনে সরকারি উদ্যোগে কবিগুরুর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদিত হয়। আর তা হবে না-ই বা কেন? আসাম সহ সমগ্র উত্তর-পূর্বে বিশ্বকবির বিচরণ, তাঁর রচনাকৃতিতে এখানকার মনুষ্য, নিসর্গ প্রকৃতির প্রচ্ছায়া, কবিসম্পর্কধন্য বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, লেখক কবি সাহিত্যিক, ইতিহাসবিদ (এদের মধ্যে একাধিক বিদূষী নারীও আছেন) এদের বিচরণের চুলচেরা বিবরণ নিয়ে কত কত নিবন্ধ, প্রবন্ধ, গ্রন্থও রচিত হয়েছে যা রাজ্যের বিজ্ঞজনের তো বটেই নেতামন্ত্রীরও দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি।
তবু হায়, কবির স্বভাষীদের প্রতি রাজ্যের ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের বিবমিষা ছাড়াও মাঝে মাঝে তাঁর রচিত জাতীয় সংগীত নিয়েও অনেকের ক্ষোভের শেষ নেই। ভারতের জাতীয়সংগীতে নাকি কবিগুরু আসামের প্রতি অন্যায় করেছেন। একটি গানে এ অভিমান ধ্বনিত হয়েছে—
এইখন দেশ মোর মরমর দেশ
রাষ্ট্রীয় সংগীতত নাই উল্লেখ।
আমাদেরও অভিমান হয় কবি কেন আরও একটু সচেতন হতে পারলেন না। পাঞ্জাব-সিন্ধু-গুজরাট-মারাঠা-দ্রাবিঢ়-উৎকল আর বঙ্গ — এই নিয়ে কবি নির্মিত ভারতের অবয়ব নিয়ে তাঁদের ক্ষোভ।
মহাভারত কথিত অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গ শব্দগুচ্ছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ‘বঙ্গ’ শব্দটির ভৌগোলিক ব্যাপ্তি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করে কেউ কেউ আরও বিড়ম্বনা করেছেন। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের অভিযোগ তো এ পথ দিয়েই আসছে। বঙ্গ, অর্থাৎ বৃহৎ বঙ্গ, মানে আসাম সহ উত্তর-পূর্বের সমগ্র ভূখণ্ড — এসব কথা একসময় অগ্নিতে ঘৃতাহূতি দিয়েছিল তা কি ভোলা যায়? ইতিহাসবিদ স্বয়ং দীনেশচন্দ্র সেনও কম নিন্দিত হননি এ জন্য।
তৎসত্বেও রবীন্দ্রজন্ম শতবর্ষে আসাম রাজ্য কবিগুরুর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনে কোন কার্পণ্য করেনি। রাজধানী শহরে নির্মিত হল সুদৃশ্য রবীন্দ্রভবন। তবে এ মহালগনে আসামের বাঙালির প্রতি সরকারের সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার হল উনিশে মে। গভীর দুঃখের স্মৃতি বিজড়িত এ দিনটিই যে সারা বিশ্বের মানুষকে জানিয়ে দিল, বাঙালিও নিজ মাতৃভাষার জন্য রক্ত দিতে পারে। অবশ্য বাঙালির কতিপয় সুসন্তানের কাছে আজ এসব গুরুত্বহীন মনে হলেও আমাদের মহান কবি আসাম-মেঘালয়, মণিপুর, ত্রিপুরায় আজও সমাদৃত।
তবে সমস্যা হল তাঁর ভাষায় যাঁরা কথা বলেন এদের নিয়ে। এরা যে আজও বাঙালির খণ্ডিত জাতিসত্তায় আস্থাশীল হতে পারেন না। এদের রক্তে যে আজও পূর্বপুরুষের উদারনৈতিক জাতীয়তাবাদের টান রয়েছে, এরা যে আজও হিংসার দর্শন, সাম্প্রদায়িকতার মন্ত্রকে আত্মস্থ করতে রাজি নয়। কারণ তাঁদের পেছনে আলোকবর্তিকা হিসেবে রয়েছেন যে ব্যক্তিটি তাঁকে যে তুচ্ছ জাতপাত, সংকীর্ণ ধর্মীয় গণ্ডিতে বাঁধা যাচ্ছে না।