তমোজিৎ সাহা
“আমি মনে করি স্বদেশবাসীর কাছে আমার কিছু কৈফিয়ত দেবার আছে। দুর্ভাগ্যক্রমে এমন অনেকেই আছেন যারা এ কথা জেনে আঘাত পেতে পারেন যে ভারতীয় নারীত্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ঐতিহ্যের মধ্যে লালিত পালিত একজন মহিলা কী করে নরহত্যার মতো একটা বীভৎস কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে। আমি ভেবে বিস্মিত হই দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নারী পুরুষের মধ্যে পার্থক্য থাকবে কেন ? যদি দেশমাতৃকার জন্য ভাইয়েরা ভাবতে পারে এবং লড়াইয়ে সামিল হতে পারে তবে বোনেরা নয় কেন ? রাজপুত রমণীরা যুদ্ধক্ষেত্রে অসীম বীরত্বের সঙ্গে লড়ে দেশের শত্রুদের বধ করতে দ্বিধা কলেন নি, ইতিহাসে এর উদাহরণ একেবারে কম নয়।… তাহলে আমরা, আধুনিক ভারতের নারীরা, কেন বিদেশি শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করার মহাসংগ্রাম থেকে বিরত থাকব ? যদি সত্যাগ্রহ আন্দোলনে বোনেরা ভাইদের পাশে দাঁড়াতে পারে তাহলে বিপ্লবী আন্দোলনে নয় কেন ? এটা কী এইজন্য যে পদ্ধতিটা ভিন্ন, না কী এই কাজে অংশগ্রহণের পক্ষে মহিলারা অনুপযুক্ত ? … যত কঠিন এবং বিপদসঙ্কুলই হোক না কেন মেয়েরা আজ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তারা আর পিছিয়ে না থেকে ভাইদের পাশে দাঁড়াবে। আমি আন্তরিকভাবে আশা করি আমার বোনেরা আর নিজেদের দুর্বল ভাববে না। সমস্তরকম বিপদের মোকাবিলার জন্য তারা নিজেদের তৈরি রাখবে এবং বিপ্লবী আন্দোলনে হাজারে হাজারে সামিল হবে।”
বিপ্লবী আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী, আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেনের ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি-র চট্টগ্রাম শাখার অন্যতম প্রধান বিপ্লবী প্রথম মহিলা শহিদ প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদার আত্মাহুতির আগে শেষ ইচ্ছাপত্রে বলিষ্ঠ ভাষায় ইংরেজিতে উক্ত বক্তব্য লিখে গিয়েছিলেন। বিপ্লবী আন্দোলনে মহিলাদের যোগদান সম্পর্কে তাঁর লেখায় মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। বিপ্লবী জীবন যে শুধুমাত্র আবেগ বা হুজুগের দ্বারা পরিচালিত জীবন নয়, যুক্তিশৃঙ্খলার পারম্পর্যে গঠিত ত্যাগের জীবন, প্রতিটি মহান বিপ্লবীর জীবনের মধ্যে এই সত্য নিহিত আছে। প্রীতিলতার মাত্র একুশ বছরের ছোট্ট কিন্তু মহান জীবন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন তথা বিপ্লবী আন্দোলনের অসংখ্য সংগ্রামীর কাছে প্রেরণা ও দৃষ্টান্ত স্বরূপ।
#
১৯১১ সালের ৫ মে অবিভক্ত বাংলার চট্টগ্রাম জেলার ধলঘাট গ্রামে প্রীতিলতার জন্ম হয়। পিতা পুরসভার করণিক জগবন্ধু ওয়াদ্দাদার ও মা প্রতিভা ওয়াদ্দাদার। ১৯২৮ সালে চট্টগ্রামের ডাঃ খাস্তগীর গার্লস স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯৩০ সালে ঢাকার ইডেন বালিকা মহাবিদ্যালয় থেকে আইএ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে মেয়েদের মধ্যে প্রথম ও সাধারণ ছাত্রছাত্রীর মধ্যে পঞ্চম স্হান অধিকার করেন। এই কৃতিত্বের জন্য তিনি ২০ টাকা বৃত্তিও লাভ করেন। এরপর কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে ১৯৩২ সালে ইংরেজি অনার্স সহ ডিস্টিংশন পেয়ে বিএ পাশ করেন।
মেধাবী ছাত্রী প্রীতিলতা ছাত্রাবস্হায় ঢাকার বিপ্লবী সংগঠন দিপালী সংঘের সঙ্গে যুক্ত হন এবং তারপর কলকাতায় এসে বিপ্লবী দলের চারজন মেয়ে ও কয়েকজন ছাত্রীকে নিয়ে একটি চক্র গঠন করেন। ১৯৩০ সালে সুভাষচন্দ্র বসুর সভাপতিত্বে চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেস সম্মেলনের পাশাপাশি চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যক্ষ নৃপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে ছাত্রী সম্মেলনে প্রীতিলতা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ছাত্রী অবস্হাতেই তিনি মাস্টারদা সূর্য সেন এবং তাঁর অনুগামীদের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের প্রতি আকৃষ্ট হন। ১৯৩২ সালে বিএ পাশ করার পরেই তিনি চট্টগ্রামের নন্দন কাননে অপর্ণাচরণ দে হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষিকা পদে নিযুক্ত হন।
নব্বই বছর আগের কথা। বিপ্লবী প্রীতিলতা ফাঁসির আসামি রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে নিয়মিত দেখা করতে যেতেন। সেখানে উভয়ের দেখা হয়েছিল চল্লিশ দিন। শহিদ রামকৃষ্ণের কাছেই তিনি বিপ্লবী অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা পেয়েছিলেন । তাই তাঁর ফাঁসির পর প্রীতিলতা আর কলকাতা থাকেননি, মাস্টারদার কাছে চট্টগ্রাম ফিরে গিয়েছিলেন। ১৯৩২ সালের বিখ্যাত ঐতিহাসিক ধলঘাটের সংঘর্ষের সময় তিনি মাস্টারদার কাছেই ছিলেন। সেই সময় মাস্টারদা, নির্মল সেন, অপূর্ব সেন ও প্রীতিলতা আত্মগোপন করে ছিলেন সাবিত্রী দেবীর আস্তানায়। ক্যাপ্টেন ক্যামরনের নেতৃত্বে বিরাট গোর্খা বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে শহিদ হলেন নির্মল সেন ও অপূর্ব সেন। মাস্টারদা ও প্রীতিলতা অন্যত্র আত্মগোপন করলেন। ওই গোপন ডেরা থেকেই চট্টগ্রামবাসীদের ওপর ইউরোপীয়ানদের অত্যাচারের সংবাদ পেতেন মাস্টারদা। তখন তিনি ঠিক করলেন ইউরোপীয়ানদের ঘাঁটি ইউরোপীয়ান ক্লাবকে আক্রমণ করতে হবে। তিনি এই ঐতিহাসিক অভিযানের রূপরেখা তৈরি করে প্রীতিলতাকে এই নেতৃত্বের দায়িত্ব দিলেন।
১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর। আজ থেকে ঠিক নব্বই বছর আগের কথা। সহযোদ্ধাদের নিয়ে এগিয়ে চলেছেন প্রীতিলতা। অন্ধকার রাতে কর্ণফুলি নদীর খরস্রোতকে উপেক্ষা করে মহেন্দ্র চৌধুরী, শান্তি চক্রবর্তী, কালীকিঙ্কর দে, সুশীল দে, বীরেশ্বর রায়, প্রফুল্ল দাস, পান্না সেন প্রমুখ বিপ্লবীর দল তরুণী প্রীতিলতার নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছেন মাস্টারদার ঠিক করে দেওয়া পরিকল্পনাকে সফল করার লক্ষ্যে। সঙ্গে ছিল আগ্নেয়াস্ত্র, বোমা ও বিপ্লবীদের শেষ রক্ষাকবচ পটাসিয়াম সাইনাইট। চট্টগ্রামের শহরতলির ইউরোপীয়ান ক্লাবে তখন সবাই পান-আহার, নাচ-গানে ডুবে আছে। মিলিটারির কড়া পাহারা ভেদ করে আনুমানিক রাত সাড়ে দশটায় দেশি গাড়োয়ানের বেশে বিপ্লবীদের একাংশ প্রবেশ করলেন ক্লাবের ভেতর, প্রীতিলতা ও অন্যরা এলেন পেছনের দরজা দিয়ে। প্রীতিলতার সামরিক পোশাক একটা সাদা চাদরে ঢাকা ছিল। অপারেশনের শুরুতে হঠাৎ গুলিবর্ষণ ও বোমা বিস্ফোরণে হতভম্ব ইউরোপীয়ানদের কেউ মারা গেল, কেউ আহত হল আর কেউ কেউ প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে গেল। এইভাবে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেওয়ার মাস্টারদার পরিকল্পনাকে সফল করলেন প্রীতিলতা।
সফল আক্রমণের পর ফেরার পথে মহেন্দ্র চৌধুরীর খেয়াল হল প্রীতিলতা সঙ্গে নেই। মহেন্দ্র প্রীতিলতার কাছে গিয়ে তাদের সঙ্গে চলে আসতে বলেন। প্রীতিলতা নিজের রিভলবারটা মহেন্দ্রের হাতে দিয়ে দিয়ে বললেন, তোমরা মাস্টারদার কাছে ফিরে যাও, আমি সাইনাইড নিয়েছি। চললাম যেখানে আছে শহিদ নির্মলদা, ভোলা, রামকৃষ্ণদা ও আর সবাই— বিদায়। পূর্ব শপথ অনুযায়ী প্রীতিলতা আত্মত্যাগ করেছিলেন। নেত্রীর নির্দেশে সবাই ভাঙা মন নিয়ে ফিরে গেলেন। পুলিশ এসে পেল প্রীতিলতার নিথর প্রাণহীন দেহ। তল্লাসি করে পাওয়া গেল শ্রীকৃষ্ণের একটা ছবি, শহিদ রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ছবি, পাহাড়তলির ইনস্টিটিউট নামে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের ইউরোপীয়ান ক্লাবের একটা প্ল্যান, একটা চামড়ার বেল্ট, ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির নোটিশ, রিভলভারের কার্তুজ, একটা হুইসেল ও তাঁর নিজের হাতে লেখা পূর্বে উল্লিখিত সেই শেষ ইচ্ছাপত্র।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম মহিলা শহিদ প্রীতিলতা নিজের প্রাণ উৎসর্গ করে দেশবাসীকে ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে যোগদান করার জন্য উদ্বুদ্ধ করলেন। তাঁর আত্মত্যাগ নারী জাতি সহ আপামর দেশবাসীকে পরাধীনতার অচেতন ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলেছিল, অন্তরে সাহস প্রদান করেছিল। পরাধীনতা এবং অন্যায় অবিচারের রাজনৈতিক ও আত্মিক দাসত্ব থেকে মুক্তির সংগ্রামে শহিদ প্রীতিলতা যুগে যুগে আমাদের দিশারী হয়ে থাকবেন।
আত্মবলিদান দিবসে শহিদ প্রীতিলতাকে আজ আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করলাম।
সুন্দর লেখা।