The Mirrow

গান্ধী জয়ন্তী দিবসে

Share the Article

সঞ্জীব দেবলস্কর

নামটি শুনে আসছি বোধ হওয়া অবধি। স্কুলের উঁচু ক্লাসে উঠতে না উঠতে  কানে আসতে থাকল, গান্ধী লোকটির জন্য আমাদের দেশ টুকরো হল, লোকটি ভালো না, কারণ তিনি বলেছেন, পট্টভি সীতারামাইয়ার পরাজয় আমার পরাজয়। এরকম কথাই লিখেছেন উদয়ন ঘোষ তাঁর একটি  উপন্যাসে, নাম ‘হরিশ্চন্দ্র’। ঠিক এ কথাটি যে কতবার শুনেছি এর ইয়ত্তা নেই। কলেজে ওঠার পর পর গান্ধী কেচ্ছা আরও কানে আসতে থাকল। একটা সময় অতি প্রগতিশীল ইন্টেলেকচুয়ালদের কাছে গান্ধীকে তাচ্ছিল্য করাটা একটা শখের মতো ব্যাপার। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় ছিল সম্ভবত গান্ধী শতবর্ষ। রাস্তায় রামধুন গেয়ে মিছিলে হেঁটেছি টিচারদের নেতৃত্বে, গান্ধী দর্শন ইত্যাদি নিয়ে জ্ঞানগর্ভ ভাষণও শুনেছি শিক্ষকদের। আর বাড়িতে বাবাকে (যতীন্দ্রমোহন দেবলস্কর) দেখেছি কেমন রশি দিয়ে আঁটো করে বাঁধা কিছু পুরনো বাংলা, ইংরেজি পত্রিকা, আর কিছু  বই নিয়ে নিবিষ্ট চিত্তে পাঠ করছেন, খাতায় কী যেন কী লিখে চলেছেন। এখানে ওখানে আমন্ত্রিত হয়ে বক্তৃতা করতে যাচ্ছেন, এরই প্রস্তুতি। কেমন যেন অদ্ভুত লাগত ব্যাপারটি। বাড়ির বাইরে (ভেতরেও আস্তে আস্তে)  সন্দেহপ্রবণদের মুখে রামধুন নিয়ে ব্যঙ্গ, অর্ধ উলঙ্গ ফকিরের ভোজবাজি নিয়ে বক্রোক্তি, আর এর বিপরীতে বাবার মুখে গান্ধীস্তুতি! পরে যখন বুঝতে পারলাম ওই ছেঁড়া হলদেটে কাগজের বান্ডিল হল ‘হরিজন পত্রিকা’, এবং একটি ইংরেজি কাগজের কাটিং, অনেকগুলো পুরানো ‘উদ্বোধন’ পত্রিকার সংখ্যা ততদিনে ওগুলোর অবস্থা নিতান্তই জরাজীর্ণ। পরিবেশের কুপ্রভাবে ওই মহামূল্যবান সংগ্রহগুলোকে বিনষ্টের হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টাও করা হয়নি। গান্ধী বিষয়ক টুকরো কথার মালা, নিবন্ধ, ডায়েরিতে পড়া বইয়ের উপর নিজস্ব মতামত এগুলোও ক্রমে হারিয়ে গেল। কারণ ষাটের শেষ থেকে নবপর্যায়ে গান্ধী বিরোধিতার একটা ঢেউ এল এদিকে এর কারণটা অনুধাবন করতে অনেক দেরি হয়েছে। কিন্তু প্রবল গান্ধীবাদী আজীবন খদ্দর পরিধান করা, স্বাধীনতা সংগ্রামী পিতৃদেবকে অনেকদিন দেখেছি বড়দের সঙ্গে বিতর্কে নিতান্তই ক্ষুণ্ণ হয়ে নীরব হয়ে থাকতেন। ইংরেজি ‘মাই এক্সপিরিমেন্ট উইথ ট্রুথ’ এবং বাংলা ‘সত্যের সন্ধানে’ বইটি তাঁর নিত্যপাঠ্য ধর্মগ্রন্থের মতোই কাছে থাকত। কলেজে উঠে ওই ইংরেজি বইটি পড়ে অবশ্য চমকিত হয়েছি, চমকিত হয়েছি নেহরুর ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া পড়েও, বাবার কাছে এর একটা বাংলা ভার্সন ছিল। বাবা নিয়মিত ভাবে প্রতি বছর ২ অক্টোবর স্কুলে বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে গান্ধীর উপর ভাষণ দিতে গেলে আমাদেরও সঙ্গে যেতে হত। হিংসায় উন্মত্ত এ পৃথিবীতে গান্ধীর আদর্শ যে শেষ অবলম্বন এটা তিনি আমাদের ভালো করেই বোঝাতে পেরেছিলেন, তাই ভিন্ন মতাবলম্বী বন্ধু-বান্ধব এবং বড়দের বিপরীত কথা শুনেও মহাত্মা গান্ধীর প্রতি শ্রদ্ধা অটুট ছিল। ওই সময় এদিকে অতি সস্তায় বা বিনামূল্যেই আসত কিছু চটি বই যেখানে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর কিঞ্চিত নিন্দাবন্দনা একটু কঠোর ভাষায়ই থাকত। এরকম বইতে স্বাধীনতা সংগ্রামেরও ভিন্নতর চিত্র তুলে ধরা হত। এরকম একটি  বইতে স্বামী বিবেকানন্দ এমনকী ভোলেভালা রামকৃষ্ণ পরমহংসও কঠোর ভাবে নিন্দিত হয়েছেন, মনে আছে, সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথা বলার দোষে। পরে ভালো করে বইগুলো পড়ার ইচ্ছে হলেও এগুলোকে বাবা দূর করেছেন। তবে যতটুকু পড়তে পেরেছি এতেই মাথা ঘুরে গেছিল, এর বেশি যদি পড়তাম কী জানি কী হত। ভাগ্যিস, শুকতারা, স্বপনকুমারের ডিটেকটিভ, আর বিদেশি অনুবাদ সিরিজে মজে গেলাম যথা সময়ে।

    তবে জাতির জনক গান্ধীর কিছুটা ক্ষতি করেছেন তিনি নিজেও। ওই যে আত্মজীবনীতে নিজেকে একেবারে সাদামাটা ভাবে উপস্থাপন করেছেন। পাঠকরা বুঝল ইনি ছাত্র হিসেবে নিতান্ত মাঝারি ছিলেন। আমরা থার্ড ডিভিশনকে বলতাম গান্ধী ডিভিশন। গান্ধীর হাতের লেখা ছিল অপাঠ্য, অভিজাত রেস্তোঁরায় গিয়ে বন্ধুর কাছে হেনস্তা হওয়া, পোশাক-আশাক এবং সাহেবি কেতা আত্মস্হ করে ভদ্র সমাজের উপযুক্ত হবার ব্যর্থ চেষ্টার যে সরস বর্ণনা তিনি দিয়েছেন এতে ফল হয়েছে বিপরীত। সবাই তাঁকে আক্ষরিক অর্থেই গবেট হিসেবে ধরে নিলেন। যাঁরা প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি অনুধাবন করেছিলেন এরাও এ নিয়ে কিছু বলেননি।

সহৃদয় পাঠক! মহাত্মা গান্ধীর পাণ্ডুলিপির কিছু facsimile কপি বিভিন্ন গ্রন্থে সহজ লভ্য, ওয়েবসাইটেও পাওয়া যায়। দেখে নিলেই চক্ষুকর্ণের বিবাদ দূর হবে। আর,  শোনা কথার ওপর নির্ভর না করে ‘লন্ডন যাত্রার প্রস্তুতি’, ‘ব্যারিস্টারি পাঠ’ ইত্যাদি পর্ব তাঁর আত্মজীবনীতে একটু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়লেই বোঝা যাবে সেদিনে ইংলন্ডে নিম্নমেধা বা মধ্যমেধার ছাত্রর স্থান হত না। বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনও গান্ধীকে নিয়ে নিরন্তর গবেষণা ও চর্চা চলছে যা তাঁর নিজ দেশে নেই। ইদানীং পাঠ্যপুস্তকেও গান্ধী সীমিত। জাতির জনক আজ ক্রমে যেন ‘প্রাক্তন জাতীর জনকে’ পরিণত হচ্ছেন। গান্ধী হন্তার নামে যে দেশে মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়, গান্ধীর মর্মর মূর্তির উপর গুলি হয় সে দেশে শান্তির প্রতীক, অহিংসার পূজারী তো ভূমিকাহীন। বিশ্বকে যে দেশ শান্তির বাণী শুনিয়েছে সে দেশে আজ অসহিষ্ণুতার অনুশীলন যেন দেশটিকে জঙ্গিরাষ্ট্রের দিকে নিয়ে চলেছে। নইলে সারা বিশ্ব আজও যাঁর অহিংসার বাণীর জন্য কান পেতে আছে সেই মহাত্মার জন্মদিন কেমন নীরবে এল, এবং নীরবেই বিদায় নেবে। সূচনায় যাঁর কথা বলেছিলাম, আমার পিতৃদেব তিনি গান্ধীর চেয়ে বত্রিশ বছরের ছোট ছিলেন। তাঁর জন্ম হয়েছিল ১৯০১ সালে। আজীবন যাঁর আদর্শকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরেছিলেন সেই ব্যক্তিটি অবশ্য তাঁর শ্রদ্ধার ব্যক্তির চেয়ে আরও বারো বছর বেশি আয়ু লাভ করেছিলেন। যে কথাটি না বললে না হয় তা হল সেই স্বাধীনতা সংগ্রামী গান্ধীবাদী ব্যক্তিটি সৌভাগ্যবান এ-জন্য যে, তাঁর জন্মদিনও  ওই ২রা অক্টোবর। তবে এ শুভদিনে আরও একজন দেশনেতার জন্ম হয়েছিল‌ আজকের দিনে তাঁর প্রতি একটি সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাতে হয় একটি বিশেষ কারণেও। তিনি সেই সেই ব্যক্তি যিনি একষট্টি সালে আমাদের জন্য দিয়ে গেছেন ‘ত্রিভাষা সূত্র’ যাঁর ফলে আজ এখনও আমরা মাতৃভাষার অধিকার ভোগ করছি। তিনি হলেন লাল বাহাদুর শাস্ত্রী।  

1 thought on “গান্ধী জয়ন্তী দিবসে”

  1. আরও বিস্তৃত ও বহুমুখী আলোচনার দাবী জানিয়ে রাখলাম

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!