The Mirrow

নয়া সরকার, নয়া স্বপ্ন, নয়া বরাক

Share the Article

সঞ্জীব দেবলস্কর

একেই বলে অপরিণামদর্শিতা! ভেবেছিলেন একটু রিস্ক নিয়েই শেষ সামলে নেবেন। কিন্তু এত লোকের মৃত্যু-মিছিলের মধ্যেই ওঁদের ‘খেলা’ সাঙ্গ হল। ভেবেছিলেন,  সামান্য একটু ঝুঁকি নিয়ে, লক্ষ জনতার সমাবেশ, উন্মত্ত রোড শো, কোমর দোলানোর পর্বটি শেষ করে কোন মতে বিজয় উৎসব পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাবেন ক্ষমতা দখলের খেলাটিকে। কিন্তু হায়! কী যে হবে এখন! ঝট করে লক-ডাউনও ঘোষণা করার মুখ কি আর আছে? দু’দিন আগেই কী সব কথা বলে রেখেছিলেন। এখন একটা ভুলের খেসারত দিতে আর কতটা ভুল করতে হয় কে জানে। যাই হোক্‌, ‘খেলা হবে, খেলা হবে’ করে ভোটের বাক্স তো ভর্তি করা হল। আরো একটু ঝুঁকি নিয়ে গণনা পর্বটিও সংঘটিত করে নেওয়া হল। কা’রা বিজয় উৎসব করলেন, শহরে গ্রামেগঞ্জে আবির ছড়ালেন, পটকা পুড়িয়ে কান ঝালাপালা করলেন, গলায় গামছা জড়িয়ে বিজাতীয় গানের সঙ্গে কোমর দোলালেন — এসব নিয়ে এ নিয়ে বরাকবাসীর তেমন উচ্ছ্বাস থাকার কোন কারণ দেখা যাচ্ছে না। বিস্তর উচ্ছ্বাস তো প্রদর্শিত হয়েছিল গত নির্বাচনের  পরও। যাদের ঝুলি ভরে ভোট দিয়ে বরাকবাসী পাঠিয়েছিলেন দিসপুর, এরা তো পুরো পাঁচটি বছর মূক-বধিরের ভূমিকাই পালন করলেন বিধানসভায়। তা সে হোক্‌ না কেন নিজ অঞ্চলের উন্নয়নমূলক কোন ইস্যু, কর্মসম্ভাবনার দাবি, শিল্পপ্রযুক্তি বিষয়ক কোন প্রকল্প কিংবা ইতিপূর্বে গৃহীত প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন, যেমন, দ্বিতীয় মেডিক্যাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপন, শিলচর শহরে ফ্লাইওভার নির্মাণ ইত্যাদি ইস্যু। পাঁচগ্রামের  কাগজকল নিয়ে দুই প্রস্থ প্রতিশ্রুতি, এবং (একটু মৃদুকণ্ঠেই বলি) একদা দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারিত ডিটেনশন ক্যাম্প গুড়িয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি (একজন সমাজকর্মী এক টিভি চ্যানেলে সেদিন বললেন, রামনগরের মাটি নাকি এর সাক্ষী, মাটি তো মিথ্যা বলে না, হিন্দু শাস্ত্রে কী যেন আছে কখন যেন ধরিত্রী কেঁপে ওঠে)—এ নিয়ে কোন বজ্রনির্ঘোষ নয় সামান্য কাইকুঁইই কারও কণ্ঠে ধ্বনিত হল না। যা-ও  এক নিঃসঙ্গ বিধায়ক একাকী রুখে দাঁড়িয়েছেন তাঁকেও স্তব্ধ করার এত আয়োজন!

সত্যি কথা বলতে কি, বিগত কয়েকটি দশক থেকে আমাদের জনপ্রতিনিধিরা ভুলেই গেছেন এরা আসলে কী? এদের মুখ্যকর্মটাই বা কী, আর কোনটাই বা গৌণকর্ম? কথাটা বোকা বোকা ঠেকলেও একটু মনে করিয়ে দিই, এম-এল-এর ফুল ফর্ম হল ‘মেম্বার অব লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি’, সহজ বাংলায় ‘আইনসভার সদস্য’, একটা সময় বলা হত ‘ব্যবস্থাপক পরিষদের’ সদস্য। তো কালক্রমে এই মহামান্য সদস্যরা ভুলেই গেছেন (এরা জানার সুযোগই আর পেলেন কোথায়?) যে, (নামে বেনামে) ঠিকাদারি, কনট্রাকটারি, চাকরি দেওয়া, একে ওঁকে  সরকারি সুযোগ পাইয়ে দেওয়া, সরকারি প্রকল্পে নিজেদের ভাগদখল প্রতিষ্ঠা করা, ওঁদের ভাষায় “সিন্ডিকেট” গড়ে তুলে কয়লা, সুপারি, বালু-পাথরের ব্যবসা সুপরিকল্পিতভাবে পরিচালনা করা, এখানে ওখানে আধারশিলা বসিয়ে উন্নয়নের খাতে আসা সরকারি অর্থ হাপিস করা ইত্যাদি ইত্যাদি যে এদের মুখ্য কর্ম নয়। আইনসভার সদস্য হিসেবে এদের প্রাথমিক কর্ম হল—আইন প্রণয়ন (অবিশ্বাস্য ঠেকছে?), সরকারি নীতিনির্ধারণ এবং এ জন্য সংসদের ভেতর  চিন্তাচর্চা, বিতর্ক, বিশ্লেষণ, নিজস্ব মতামত প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় দলাদলি, লবিবাজি, ঝগড়াকাজিয়া, উত্তেজনা, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ — এসবই এদের মুখ্য কর্ম। বাকি কাজ তো প্রশাসনের। সরকারি প্রশাসন বা আমলাদের মাধ্যমে এই নির্ধারিত আইন, এবং আইনসম্মত গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী প্রকল্পগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না এদিকে সজাগ থাকাটাও এই অইনসভার সদস্যদের অন্যতম কর্ম।

সাম্প্রতিককালীন নেতাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই, অর্থ রোজগারের উদ্দেশ্যে প্রশাসনিক বিষয়ে হস্তক্ষেপের প্রবণতাটি শুরু হয়েছে ষাটের দশকেই। তবে সে আমলে এরকম পুকুরচুরি করতেন হাতে গোনা কতিপয় নেতাই। সেই কংগ্রেস আমলেই জনপ্রতিনিধিদের হাতে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার সংস্থান করে এদের চরিত্রহনন করার বিরুদ্ধে কেউ একটিও বাক্য ব্যয় করেননি। লেজিসলেচারকে কার্যত অ্যাক্সিকিউটিভে রূপান্তরিত করার ফলেই পাঁচটি বছরের সদস্য পদেই কোটিপতি হওয়া আজ এত সহজ হয়ে গেছে, প্রকারান্তরে জনপ্রতিনিধি হওয়া পর্যবশিত হয়েছে একটি ব্যবসায়ে।

এই সেদিনও দলীয় নেতৃত্বের প্রতি অন্ধ-আনুগত্যকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে, কিংবা নিজ-দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে রীতিমত লড়াই করে নিজেদের দাবি আদায় করতেও জনপ্রতিনিধিরা  সচেষ্ট ছিলেন। একষট্টির ভাষা আন্দোলনের উল্লেখ করলে কেউ গোঁসা করবেন না তো? আজকাল ভাষা নিয়ে আবেগকে কারা যেন বিলকুল প্রশ্রয় দিতে নারাজ। তবে এদেরই সতীর্থ,  মানে ওই উপত্যকার সতীর্থরা যে অহর্নিশি ‘মোর চির চেনেহি ভাষা’ বিপন্ন বলে চিৎকারে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তোলেন তখন এরা কি কানে তুলো গুঁজে থাকেন? আমি তো অসমিয়া বন্ধুদের মাতৃভাষা প্রীতিকে শ্রদ্ধা করি, কিন্তু এদের দেখেও আমাদের নেতারা কিছু শিখতে চান না দেখে আশ্চর্য হই। কীসের ভয়ে এরা সর্বক্ষণ চুপ থাকেন, এখন পর্যন্ত চুপ আছেন, জয়ী হলেও যে চুপ থাকবেন এটা তো ভোটাররাও জানেন কে জানে। প্রাণসংশয়ের আশঙ্কা? একটা কথা বলি, এই আসাম বিধান সভায়ই—সেটা শিলঙে থাকাকালীনই হোক আর দিসপুরেই হোক, বরাকের কোনো সদস্যের নাকের উপর কেউ অদ্যাবধি একটা ঘুষিও তো মারেনি, গালাগালি লাঠিপেটা তো দূরের কথা। হ্যাঁ, মন্ত্রী মহীতোষ পুরকায়স্থের দপ্তর কেড়ে নেওয়া হয়েছে, আনুষ্ঠানিক ভাবে তিনি ভর্ৎসিতও হয়েছেন (১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৪), কিন্তু তাঁর প্রতি অসৌজন্যমূলক আচরণ তো কেউ করেনি। আসামে বাংলা সংবাদপত্র, বাংলা সিনেমা নিষিদ্ধ করার প্রয়াস, কলেজের ছাত্রীদের (নওগাঁতে, ১৯৭৩) শাড়ি ছেড়ে মেখলা পরার ফর্মান জারি করার বিষয়টি সদনে উত্থাপন করলে বিধায়ক রেণুকাদেবী বরকটকী উচ্চকণ্ঠে বলেছেন ‘মহীতোষবাবু পাগল হয়ে গেছেন’। এই পর্যন্তই। তবে ১৯৬১ সালে বাড়াবাড়ির একশেষ করেছেন সরকার, এবং এরপর ১৯৮৬ এবং ১৯৯৬ সালের রক্তপাতের কথা অবশ্য ভোলার নয়। এসব ক্ষেত্রে অবশ্য বরাকের প্রতিনিধিরা একযোগে চুপ করেও বসে থাকেননি। এরকম পরিস্থিতি হলে এখন আমাদের প্রতিনিধিরা কী করবেন জানি না।  বলা প্রয়োজন রাজ্যসভার সাংসদ নৃপতি রঞ্জন চৌধুরীও আসামে বাঙালিদের উপর নির্যাতনের কথা বলেছেন মুক্তকণ্ঠে (১৯৭২) — একবারও ভাবেননি সর্বশক্তিমান নেত্রী গোঁসা করবেন কি না, কিংবা দলের হোমড়াচোমড়ারাই বা কী বলবেন। রথীন্দ্রনাথ সেন, তারাপদ ভট্টাচার্য, বিশ্বনাথ উপাধ্যায়, গৌরীশঙ্কর রায়, রণেন্দ্রমোহন দাস, মৌলানা আব্দুল জলিল, আলতাফ হোসেন, গোলাম ওসমানি, নিশীথরঞ্জন দাস, বিমলাংশু রায় – এরা কী করেছেন এসবের খবর না রেখেই কোন আক্কেলে এরা সংসদীয় রাজনীতিতে নামেন? শুধু অর্থ, খ্যাতি, কীর্তির লোভে?  

সে যাই হোক্‌, এই মুহূর্তে আমরা সবাই রাজা, তাই কিছু মন খুলে কথা বলে নিই। কোনও  আগাম দাবি নয়, প্রত্যাশাও নয়, কয়েকটি প্রশ্ন রাখতে চাই — আপনারা যাঁরাই জয়ী হয়েছেন, পারবেন কি পাঁচগ্রামের জন্য নিয়মিতভাবে দাবি উঠাতে? অন্তত যে সম্পদ এখনও  বিনিষ্ট হয়নি, যেমন একটি নতুন কেনা রেলইঞ্জিন, ফ্যাক্টরিতে ব্যারেল ব্যারেল উৎপাদিত কাগজ ইত্যাদি বিক্রি করে ওখানকার শিশুদের দিকে তাকিয়েও অন্তত কর্মীদের কিছু আর্থিক সহায়তার পরামর্শ দিতে?  আশাকরি দলীয় নেতারা চোখ রাঙাবেন না এই মানবিক প্রস্তাবে।

তবে নিজ মাতৃভাষার অধিকার, বরাকবাসীর স্বাভিমানের প্রশ্নে কিছু বলতে হলে একটু ঝুকি অবশ্য নিতে হবে, সেটা কি ওঁরা নেবেন? বিগত দিনের নির্বাক প্রতিনিধিদের হালচাল দেখে চক্ষুলজ্জায়ও কি একটু নড়েচড়ে বসবেন?

নবনির্বাচিত প্রতিনিধিদের আশ্বস্ত করি, নিজের উপত্যকার কথা, নিজ মাতৃভাষার  অধিকারের কথা বললে আর যাই হোক্‌, প্রাণসংশয় হবে না। প্রাণসংশয় হবে না। আসামে এখনও জঙ্গলের রাজত্ব কায়েম হয়নি। বিগত দিনে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ মাত্রাতিরিক্ত চোখ রাঙানিতে বরাকের প্রতিনিধিদের সামলে রেখেছেন ঠিকই, তবে একটু আধটু অবাধ্যতা করলে আখেরে এদেরও লাভ হতেও তো পারত। অতিরিক্ত বাধ্য ছেলের কপালে দলীয় টিকিটও যে জোটে না তাও তো আমরা দেখলাম। এবার পরিস্থিতির যদি কোন নড়চড় না হয়, তবে অবশ্য কোন পরামর্শ দিয়ে আমি আপনাদের সংকট সৃষ্টি করতে চাই না। তবে এই যে রক্তচক্ষু, সরাসরি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, একটা ভাষিকগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের পথ কৌশলে অবরুদ্ধ করে দেওয়া, নিরন্তর ধর্মীয় বিদ্বেষ প্রচার করে সামাজিক ঐক্যের ভিত্তিকে দুর্বল করে রাখা, এটা কিন্তু সমস্ত অসমিয়াভাষীর মনোভাবের প্রতিফলন নয়, এ কথাটা মনে রেখে নিজেকে প্রকৃতই  জনসেবার উপযুক্ত করে তোলার সামান্য একটু প্রচেষ্টা নিতে হবু বিধায়কেরা রাজি আছেন কি না, এটা কি সবিনয়ে জিজ্ঞেস করতে পারি? নির্বাচনে জেতার কৌশল যেমন শিখে নিতে হয়, তেমনি জনসেবার জন্যও কিঞ্চিৎ প্রশিক্ষণেরও প্রয়োজন। চাষীকে যেমন চাষকর্ম শিখে নিতে হয়, মাস্টারমশাইকে যেমন পড়াশুনা করে তাঁদের কর্মটি রপ্ত করতে হয়, তেমনি বিধায়কদের/সাংসদদেরও একটা ন্যুনতম প্রস্তুতির দরকার। এটার অভাবেই এরা ভুলে যান, তাঁদের নির্বাচিত করে পাঠানো হয় জনগণের কাজ করতেই, দলীয় কাজটা কদাপিও তাঁদের প্রধান কর্ম নয়। এটুকু প্রস্তুতি নিয়ে কাজে নামলে কী হতে পারে, এ প্রশ্নটি যাঁরা জয়ী হয়েছেন এবং যাঁরা আগামীতে জয়ের অপেক্ষায় থাকবেন তাদের উভয়ের কাছেই রাখলাম। আর উভয় পক্ষের জন্য  রাখলাম আন্তরিক আগাম অভিনন্দন।  

( এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত সম্পূর্ণ লেখকের। )

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!