The Mirrow

ডাক্তারি ব্যবসার নেপথ্য কাহিনি

Share the Article

সঞ্জয় কুমার 

সম্প্রতি একটি টেলিফোনের বার্তালাপের অডিও সামাজিক মিডিয়াতে খুব ভাইরাল হয়েছে। সেই বার্তালাপে শুনা গেল করিমগঞ্জ অসামরিক হাসপাতালের জনৈক ডাক্তার  একজন গরিব প্রসুতি রোগিনীকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করার বিনিময়ে তিন হাজার টাকা উৎকোচ দাবি করছেন রোগিনীর পরিজনদের কাছে।

ডাক্তার। একটা সময়ে এই পেশার ব্যক্তিরা সাধারণ মানুষের কাছে ঈশ্বরেরই এক রূপ ছিলেন। রুগ্ন-অসহায় মানুষ তাঁদের কাছেই নিজেদের সমর্পণ করে দেন একটি সুস্থ জীবনের কামনায়। নিজের আত্মজ আত্মীয়ের রোগ নিরসনে ডাক্তার হয়ে উঠেন অসহায় মানুষের ত্রাতা ও ঈশ্বরের রূপ। সেই ডাক্তারাই আজ হয়ে উঠেছেন সাধারণ মানুষের কাছে যমরাজের জীবন্ত এক প্রতিমূর্তি। নার্সিংহোম জাতীয় সেবা প্রতিষ্টান পরিণত হয়েছে কসাইখানায়।

অথচ এক সময়ে এমনটা ছিল না। নিজের চোখে দেখেছি ডাক্তাররা সামান্য এক্সরে প্লেটের উপর নির্ভর করে অনেক কঠিন অস্ত্রপোচার করে রুগীকে সুস্থ করে তুলেছেন। খবর দিলেই তাঁরা রোগীর বাসায় চলে আসতেন। স্টেথো দিকে বুক পিঠ পরীক্ষা করে নিতান্ত অল্প খরচেই রুগীকে সারিয়ে তুলতেন। তখন এতো টেস্টের কোন বালাই ছিলো না আর এই ব্যয় বহুল চিকিৎসাভার বহন করারও সামর্থ্য মানুষের ছিল না।

বিগত ২৫/৩০ বছরে অবস্থার এত পরিবর্তন ঘটেছে যে সাধারণ মানুষ আজ ডাক্তার দেখাবার নাম শুনলে আতকে উঠছে। চিকিৎসা তো পরে। প্রথমে ২৫/৩০ হাজার টাকার নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার ঠেলা সামলে উঠতে হবে। আবার সেই পরীক্ষা করাতে হবে ডাক্তারের নির্দেশিত পরীক্ষাগারে। নইলে ডাক্তার সেই রিপোর্ট দেখবেন না, বলে দেবে এসব ল্যাব-এ শুদ্ধ রিপোর্ট আসে না। বছর খানেক আগে অভিনেতা আমির খান একটা টিভি শো তে এসব টেষ্টের পেছনে ডাক্তারদের ব্যবসায়িক স্বার্থ বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে প্রমানসহ বলেছিলেন যে ডাক্তাররা রোগীদের আশি শতাংশ টেষ্ট করান শুধুমাত্র নিজেরদের ব্যবসার স্বার্থে। প্যাথোলোজি ল্যাবগুলোর সাথে ডাক্তারদের কমিশনের লেনদেন থাকে। ল্যাবগুলোতে বেসিন টেষ্ট বলে একটা ব্যাপার থাকে। তা হলো রোগীর রক্ত বেশিনে ঢেলে দিয়ে নরম্যাল রিপোর্ট পেশ করে রোগীর কাছ থেকে অর্থ উপার্জন করা।

একটা রোগী যখন নার্সিং হোমে ভর্তি হন, তখন দেখা যায় ডাক্তার রোগী বা তার পরিজনদের সম্পূর্ন অজ্ঞাত রেখে রোগীর নানা রকম টেষ্ট করিয়ে নেন যার আর্থিক মূল্য অনেক হয়ে থাকে। কোভিড কেসে কোনো কোনো রোগীকে নার্সিং হোম কর্তৃপক্ষ ৩০/৩৫ লক্ষ টাকার মেডিক্যাল বিল রোগীর হাতে ধরিয়ে দিয়েছে, যেখানে কোভিডের কোন দাওয়াই বের হয় নি। অথচ এই সব টেষ্ট করিয়ে রোগীর শরীরে কী প্রতিকূলতা বা কী বিশেষ রোগের সন্ধান পাওয়া গেছে সে সম্পর্কে রোগী ও তার পরিজন থাকেন সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। নার্সিং হোমের বিল মিটিয়ে আসার সময় রোগীর হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় একটি মোটা ফাইল।

আসলে সরকারি চিকিৎসালয়ের দুরবস্থার জন্যই মানুষ নার্সিং হোমের স্মরণাপন্ন হন আর নার্সিং হোম তার ষোল ফায়দা উঠিয়ে নেয়। নার্সিং হোমে ভর্তি হওয়া রোগী ও তার পরিজনরা থাকে অসহায় ও ডাক্তার নির্ভর। ফলে তারা নার্সিং হোমের হাতের ক্রীড়নকে পরিণত হয়ে সর্বসান্ত হয়ে নার্সিং হোম থেকে ফিরে আসে। নার্সিং হোমে দেখা যায়, সকাল বেলা ডাক্তারবাবু গলায় স্টেথো ঝুলিয়ে দুই/তিন জন জুনিয়র ডাক্তার আর নার্স সাথে নিয়ে এসে বেডে শায়িত রোগীকে স্পর্শ না করেই শুধু জিজ্ঞেস করলেন, কি আজ কেমন বোধ করছেন। শুধুমাত্র এই সামান্য কুশল বিনিময়ের বিনিময়ে রোগীর খাতায় Doctor’s Consultation Fees হিসেবে রোজ অনেক টাকা চার্জ হয়ে যাচ্ছে।

আজকের পটভূমিতে কেন এমনটা হল? এটা নিয়ে মোটামুটি একটা ধারণা উপস্থাপনের প্রয়াস করছি। আগে ভারতের প্রায় সব বেসরকারি হাসপাতালের পরিচালন বিভাগের শীর্ষ পদে থাকতেন চিকিৎসকেরা।  মানুষের আর্থিক দুর্দশা ছিলো তখন মানুষের নিত্যসঙ্গী। ডাক্তারদের মধ্যে ছিল সেবাসুলভ মানসিকতা। ডাক্তাররা তখন স্যাম্পল ফাইলের ঔষধ দিয়েও আর্থিকভাবে দুর্বল রোগীদের সহায়তা করতেন। তখনও চিকিৎসাকে তাঁরা বাণিজ্যে পরিনত করেন নি।  চিকিৎসকেরা সাধারণ মানুষের কাছে ছিলেন ঈশ্বরের অবতার স্বরূপ। ডাক্তাররা রোগীর আর্থিক অবস্থা মাথায় রেখে চিকিৎসা প্রণালী স্থির করতেন।

তারপর  স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বিনিয়োগকারী নার্সিং হোম ব্যবসায়ীরা বুঝতে পারলেন চিকিৎসকদের দিয়ে সত্যিকারের ব্যবসা হবে না। তখনই MBA, MHA (masters in hospital administration) এই সব কোর্স জনপ্রিয়তা পেল। এবং মানুষের জীবন ও যন্ত্রণা সম্বন্ধে কোনও ধারণা না থাকা এসমস্ত ব্যবসায়ী মানসিকতার মানুষগুলোকে চিকিৎসা পরিচলন ব্যবস্থার শীর্ষ স্থানে বসিয়ে পুরো পরিষেবা ব্যবস্থাকে একটা ব্যবসা কেন্দ্রে পরিণত করা  হল। 

আজকাল MBA, MHA কোর্সগুলি ডিস্টান্স এডুকেশন সিস্টেম  বা অনলাইনে সহজলভ্য। কোনও রোগী, হাসপাতাল বা চিকিৎসকের সংস্পর্শে থেকে এই বিদ্যা আয়ত্ত করতে হয় না।  ফলে  রোগী, হাসপাতাল বা ডাক্তারের মানসিকতার সাথে এদের কোন পরিচয় থাকে না। এদের শিক্ষার গুণগত মান অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে যতটুকু কার্য্যকরী পরিষেবার প্রতি তাদের দায় ততটুকুই নিষ্ক্রিয়। এইসব MBA, MHA রা কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই  চিকিৎসক নন বা পরিষেবার সাথে এদের কোন সংস্রব নেই। চিকিৎসকদের মত তাদের রোজ ষোলো-সতেরো  ঘন্টা পড়াশুনো করতে হয়না। করতে হয় না টানা ৩৬ ঘণ্টা থেকে ৪৮ ঘণ্টা ডিউটি।  রোগী বা তাঁর আত্মীয়দের সাথে তাঁদের কোনও রকম আত্মিক যোগাযোগ স্থাপিত হয়না। অসহায় রোগীর আত্মীয়দের চোখের দিকে তাকিয়ে তাঁরা তারা অনায়াসে বলতে পারেন – রোগীকে বাঁচাতে হলে আরও টাকার জোগাড় করো।  তাঁরা শুধু জানে টাকা আর  হাসপাতালের লাভের অঙ্ক। 

চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যয়নের সময় একজন ছাত্রকে মানুষকে জীবন বাঁচানোর সাথে সাথে দেওয়া হয় মানবতা, পরিষেবা ও সহমর্মিতার শিক্ষা। ব্যবসার শিক্ষা তারা সেখানে অর্জন করেন নি। ফলে ডাক্তাররা একটা সময়ে ছিলেন সেবা-নিবেদিত প্রাণ। তারা সেই সময় সামান্য ভিজিটের বিনিময়ে ডাক্তারি ব্যাগ নিয়ে গ্রামে-গঞ্জে রোগীদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেরিয়েছেন।

অন্যদিকে MBA বা MHA জাতীয় কোর্সে ব্যবসায়িক লাভ ক্ষতি, টার্গেট, ক্যাপিটেল ইত্যাদি ছাড়া সেবা বা মানবধর্মের বিন্দুবিসর্গ শিক্ষা তারা লাভ করে না। ফলে এরা যখন থেকেই চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারের চেয়ারে বসেছেন সেদিন থেকে প্রাইভেট চিকিৎসা কেন্দ্রগুলি কসাইখানায় পরিণত হয়েছে।

এইসব MBA/MHA ডিগ্রীধারীরা তাদের ব্যবসার খাতিরে  চিকিৎসকদের উপর নানারকম নিয়ম কানুন চাপিয়ে তাঁদের বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পরাধীন দাস বানিয়ে ছেড়েছে, এদের  মানবিক মূল্যবোধের মৃত্যু ঘটিয়েছে। তাঁদেরকে বারবার মনে করিয়ে দেওয়া হয় যে তারা হাসপাতালের একজন কর্মচারী এবং হাসপাতালের আর্থিক লাভকেই তাদের প্রাধান্য দিতে হবে। এভাবেই ডাক্তারদের কাছ থেকে পরিষেবা, মানবতা, সহিষ্ণুতা নামক মানবিক গুণগুলো হরণ করা হয়েছে শুধুমাত্র ব্যবসায়িক স্বার্থে।

ক্রমে অধিকাংশ ডাক্তাররা সেই ধারায় অভ্যস্ত হয়ে গেছেন এই প্রতিযোগিতার দুনিয়ায় নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য। একজন আদর্শবান, রোগী-দরদী মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন চিকিৎসকের সঙ্কটের মুল কারণই হচ্ছে  হাসপাতালের তহবিলে উপযুক্ত অর্থ তুলে দিতে না পারার ব্যর্থতা। বাকি চিকিৎসকেরা আস্তে আস্তে অভিযোজন ঘটিয়ে নিজেদের কর্পোরেটের হাতে টাকা তুলে দেওয়ার মেশিনে পরিণত হয়ে গেছেন। এবং তারাই এই সমস্ত MBA, MHA ডিগ্রীধারী কর্ণধারদের প্রিয়পাত্র হয়ে  বিপদসীমার বাইরে রয়েছেন।

প্রায় সব চিকিৎসকই পেশার শুরুতে অনেক আদর্শ নিয়ে কাজ করেন। কিন্তু আস্তে আস্তে সরকারি নিয়মকানুন, সামাজিক নিয়মকানুন, এবং বেসরকারি হাসপাতালের ম্যানেজারদের নিয়মকানুন তাঁদের চামড়া মোটা করে দেয়। যারা মেরুদণ্ড সোজা রাখেন, তাঁরা এই ব্যবস্থার অনুপযুক্ত বলে বিবেচিত হন।

স্বাস্থ্য পরিষেবার শীর্ষ পদগুলি থেকে এই সমস্ত MBA, MHA দের সরিয়ে চিকিৎসকদের সেই পদে পূর্বাসন না দিলে রোগী এবং চিকিৎসক উভয়ের দুর্ভোগ বাড়বে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মত বিষয় পুরোপুরি পুঁজি বানাবার একটা যন্ত্র হয়ে উঠবে যেখানে কোন মানবিক মূল্যবোধ থাকবে না।

(এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত সম্পূর্ণ লেখকের।)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!