হে মা দুর্গতিনাশিনী,
মর্ত্য সফর শেষে এবারের মতো তোমার কৈলাশে ফিরে যাওয়ার সময় সমাগত। যাওয়ার বেলায় পিছু থেকে ডাক দেব না, ফি বছর তো আসছই। গেলবার করোনার ভয়ে আমরা মর্ত্যবাসী তোমার সঙ্গে সময় কাটাতে পারিনি। এবার সেই করোনাভীতি বেশ খানিকটা কম থাকলেও এবার অসুবিধাটা অন্যধরণের, এবারের বাজার যে খুবই মন্দা সেটাতো তুমি দেখেই গেলে মা। বিগত বছরগুলোর মতো এবার আমরা ঠিক সেভাবে তোমাকে আপ্যায়ন করতে পারলাম না, তোমার মর্ত্যে আগমনকে উপলক্ষ্য করে যেভাবে আমরাও চারটি দিন নিখাদ আনন্দে নিজেদেরকে ভাসিয়ে দেই সেটাতেও এবার কিছুটা ভাটা ছিল, এর জন্য মনে কিছুটা খচখচানি রয়ে গেছে।
মা, তুমি তোমার অন্তরর্দৃষ্টিতে সবকিছুই দেখতে পারো। আর, পারো বলেই যাওয়ার বেলায় এই দাবিসম্বলিত চিরকুটটি তোমার হাতে ধরিয়ে দিচ্ছি। সন্তানদের ক্লেশ, জীবন-যন্ত্রনা উপশমে তুমি কৈলাশে পৌঁছে যথাবিহিত পদক্ষেপ নেবে, এই আশা।
১) মাগো, নিত্যদিনের সংসার চালনো আজ দায় হয়ে পড়েছে। জিনিষপত্রের দাম আকাশছোঁয়া। শষ্যের তেল ২৫০/- প্রতি লিটার, রান্নার গ্যাস হাজার। এই তো তুমি আসার দু’দিন আগে আটার দাম ৩.২০/- প্রতি কিলো বাড়ল। পেট্রল ১০০/- পেরিয়ে গেছে। এদিকে যেমন গাড়ি চড়া ভীষণ কঠিন হয়ে গেছে, তেমনি এই জ্বালানির দাম বাড়ায় আনুসঙ্গিক সকল জিনিষের দামও চড়েছে। সংসার প্রতিপালনে প্রাণ হাসফাস।
২) একেতো প্রায় সব জিনিষেই ভেজাল, তাই নিয়মিত ওষুধ খেয়ে শরীরটা চলনসই রাখতে হচ্ছে। তা আবার সেই ওষুধের দামও গত এক বছরে গুনোত্তর হারে বেড়েছে।
এই দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধির কিছুটা সুরাহা তুমি না করলে আগামী বছর এসে সন্তানদের বড়ই করুণ হাল দেখতে হবে তোমাকে।
৩) রোজগারে টান, ব্যবসায় ভাটা, নেই চাকরি –- সার্বিক অর্থনীতি বিপাকে। আমরা সাধারণ নাগরিক জিডিপি কী আর বুঝব! ৫ ট্রিলিওন অর্থনীতির গেরোয় সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য আজ তলানিতে, এই দিকটাও তুমি একটু দেখবে মা।
৪) এই জীবন-যন্ত্রণা সইতে সইতে তোমার সন্তানদের হ্যাপিন্যাস অনেক কমে গেছে, বিশ্বের হ্যাপিন্যাস ইন্ডেস্ক-এ আমাদের দেশ আশপাশের অনেক ছোটো দেশগুলো থেকেও এখন অনেক পেছনে। একইরকম, হাঙার ইন্ডেস্ক-এও আমরা ১০১ ক্রমাঙ্কে নেমে গেছি। এগুলো দেশের লজ্জা, দশের লজ্জা। দেশের লোকদের জীবন-আনন্দের মান বাড়িয়ে দাও মা মঙ্গলকারিণী।
মা, তুমি সর্বজনীন – জাতি-ধর্ম-ভাষা নির্বিশেষে সকলের দুর্গতিনাশিনী। কিন্তু, আজকের দিনে তোমার বঙ্গসন্তানদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়াটা প্রয়োজন, এটা সময়ের দাবি।
৫) এই যে দেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তের বাঙালি তাদের আজ বড়ই মনোকষ্ট। তারা নিজেদের পরিচয়-সংকটে ভুগছেন আজ। কোনও রাজ্যে এরা ভূমিহীন, কোনও রাজ্যে নাগরিকত্বহীন। কারোর কারোর পিঠে তো আবার ‘সন্দেহভাজন নাগরিক’-এর তকমা। অনেকেই অভিবাসী, বহিরাগত, বিদেশি ভূষণে আখ্যায়িত হয়ে যেন নাগরিকত্বের ‘দামোক্লিস সোর্ডের’ নীচে কালযাপন করছেন। এনারসি-র সুবাদে আসামে ১৯ লাখ বঙ্গসন্তানের ভবিষ্যৎ আজ অনিশ্চিত। তুমি গতবছর জেনে গেছিলে সেই খবর। এখনও এর সুরাহা হয়নি কিন্তু। নাগরিকের ফর্দ অর্থাৎ সেই নাগরিকপঞ্জি থেকে এই ১৯ লাখের নাম কী কারণে কর্তন করা হয়েছে সেটাও এই বঙ্গসন্তানেরা আজ অবধি জানতে পারলেন না! নাগরিকত্ব ঝুলে থাকার জন্য তাদের আধার কার্ডও হচ্ছে না, বিভিন্ন সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকতে হচ্ছে।
৬) সেই কবে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাশ হয়েছে, কিন্তু এর রুল বা নিয়ম তৈরি করা হয়নি বিগত দেড় বছরেও। এই আইনের সুবিধা আজ অবধি উত্তর-পূর্বের মানুষ পেল না মা।
৭) জগৎ-জননী, তুমি হয়তো খবর পাওনি, উত্তর-পূর্ব ভারতের আসাম রাজ্যে যে ৩০ শতাংশ বাঙালি থাকেন তাদের সামাজিক অবস্থান খুব একটা ভালো না। করদাতা এই বঙ্গসন্তানেরা নিজেদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত। এই তো, গত দু’বছর করের টাকা থেকে রাজ্যের বাকি সকল ভাষাগোষ্ঠীর বিশেষ বিশেষ সংস্থাগুলোকে কর্পাস ফান্ডের নামে আর্থিক সাহায্য দেওয়া হয়েছে, কিন্তু বাঙালি সংগঠনগুলোকে ব্রাত্য রাখা হয়েছে।
৮) ৩০ শতাংশ এই বাঙালির বুলি বাংলা ভাষাকে আসাম রাজ্যে সহযোগী সরকারি ভাষার স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত করে রাখা হচ্ছে। বরাক উপত্যকা নামের একটি অঞ্চলে যদিও সরকারি ভাষা বাংলা, সেখানেও আজ বঙ্গসন্তানদের মাতৃভাষা সংকটের মুখে। এখানের সন্তানদের অভিযোগ — অহরহ হরণ হচ্ছে তাদের ভাষাগত অধিকার, জাতিগত অধিকার, সাংবিধানিক অধিকার।
ভেদাভেদের রাজনীতি ভুলে মানবিক ধর্ম দিয়ে বিচারের নোটিফিকেশানটি দয়া করে তুমি কৈলাশ থেকে পাঠিয়ে দেবে মা।
৯) মাগো, সেই কবে থেকে করিমগঞ্জবাসী মেডিক্যাল কলেজের দাবি নিয়ে হল্লা করছেন। তুমি নিশ্চয়ই তোমার পুজোর প্যান্ডেলগুলোতে এই দাবির ব্যানার দেখেছ। হবে/দিচ্ছি/দেব – এই কথাগুলোর বাইরে এর কোনো সুরাহা হচ্ছে না বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে। ‘আশার ছলনে ভুলি কী ফল লভিনু হায়’ এর মর্মার্থ তোমাকে কী আর বলব মা!
১০) মাগো, প্রায়ই শোনা যায়, এই নেতা হোটেল খুলেছেন ওই নেতা নার্সিং হোম খুলেছেন, এই নেতা বিরাট স্যাটেলাইট চ্যানেচলের সত্বাধিকারী তো সেই নেতা দৈনিক সংবাদপত্রের মালিক। এদেরকেই আবার গামছা গলায় করের টাকায় সরকারি প্রকল্প উন্মোচনে ‘জিরো টলারেন্সের’ বুলি কপচাতে দেখা যায়। তুমি বরং একটা ‘মা দুর্গা ভিজিলেন্স’ গঠন করে নেতাদের সম্পদ আহরণের ব্যাপারটি খতিয়ে দেখো, প্রয়োজনে অতিরিক্ত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে দেশের কোষাগারে জমা করে দাও। জনপ্রতি ১৫ লাখ না হলেও এতে তোমার সন্তানদের ওপর করের বোঝা কিছুটা কমবে বৈকি।
পরিশেষে, আশ্বিনের এই শেষবেলায় গরমের দাবদাহে তোমার সন্তানেরা অতিষ্ট। ‘শরতের শিশির-সিক্ত পৃথিবী’ কথাটি এবার আর অনুভব করা গেল না গো মা। কৈলাশে পৌঁছে শীতবুড়িকে চটজলদি পাঠিয়ে দাও। শরতের হিমের পরশ থেকে এবার বঞ্চিত হলেও শীতের প্রাথমিক কোমল পরশ পেতে আর যেন দেরী না হয় সেই নির্দেশটুকু দিয়ে দাও মা।
মা মঙ্গলকারিনী, এই দশদফা দাবি তোমার কাছে সবিনয় পেশ করলাম। কৈলাশে পৌঁছে অবসরে এই দাবিপত্রটি দেখবে। প্রয়োজনে, শিবঠাকুরের সঙ্গে আলোচনাক্রমে এগুলোর প্রতি নজর দেবে, এই প্রত্যাশা। সুরাহার অপেক্ষায় থাকব।
কৈলাশে সবাইকে নিয়ে খুব ভালো থাকবে। আসছে বছর আবার দেখা হবে। ইতি।
তোমার আশীর্বাদপ্রার্থী,
এক বঙ্গসন্তান
২৮ আশ্বিন ১৪২৮ বঙ্গাব্দ। মর্ত্যলোক।
PERFECT DEMAND NOTE TO MATA….
দাবি সনদটি যথার্থ।