The Mirrow

ছেলের আচরণে স্ত্রীর সঙ্গেও দূরত্ব বেড়েছিল বিদ্যাসাগরের

Share the Article

উত্তম সাহা

নানা ঘাত-প্রতিঘাতে কেটেছে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবন৷ সমাজসংস্কারকে ব্রত হিসেবে   নিলে নানা প্রতিবন্ধকতার মোকাবিলা করতে হবে, এ কথা  ঈশ্বরচন্দ্রের জানাই ছিল৷ তাই শেষজীবনে আক্ষেপ ব্যক্ত করলেও নিজের রাস্তা থেকে সরে আসেননি৷ কিন্তু তাঁকে সবচেয়ে আঘাত পেতে হয়েছিল একমাত্র পুত্রের অসংযত আচরণে৷ তিনি তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণায় বাধ্য হয়েছিলেন৷

ঈশ্বরচন্দ্র ও দিনময়ী দেবীর বৈবাহিক জীবনে বোঝাপড়ার অভাব ছিল না৷ বিয়ের দীর্ঘদিন পরও সন্তান হচ্ছিল না বলে পরিবারের ভেতরে-বাইরে তাঁকে দ্বিতীয় বিয়ের জন্য প্রচণ্ড চাপ সইতে হয়৷ কিন্তু দিনময়ীর প্রতি প্রগাঢ় ভালবাসায় শেষমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি রাজি হননি৷ বিয়ের ১৬ বছর পরে জন্ম হয় তাদের প্রথম সন্তান নারায়ণের৷ পরে দীনময়ীর কোল আলো করে আসে একে একে চার কন্যা৷

বিশিষ্ট বিদ্যাসাগর গবেষক উমাশঙ্কর নিয়োগী লিখেছেন, চার কন্যা থাকলেও বিবাহিত জীবনের ষোল বছর পরে জন্মানো প্রথম সন্তানের প্রতি স্নেহান্ধ ছিলেন দিনময়ী দেবী। নিষেধ করলেও পুত্রের অন্যায় কাজে সহায়তা করতেন। বিদ্যাসাগর মশাই এটা মেনে নিতে পারেননি। ১২৭৬ সালে তিনি তাই বাড়ি ছেড়ে চলে যান৷ স্ত্রী শয্যাশায়ী হওয়ার আগে তাঁদের আর সাক্ষাৎ ঘটেনি, মৃত্যুর আগে একবার স্ত্রী বিদ্যাসাগরকে কিছু বলতে চেয়েছিলেন, পারেননি৷ বিদ্যাসাগরের দিকে তাকিয়ে শুধু কেঁদেছেন আর কপাল চাপড়েছেন৷

পুত্র নারায়ণচন্দ্র সম্পর্কে উইলে বিদ্যাসাগর লিখেছেন,‘‘আমার পুত্র বলিয়া পরিচিত শ্রীযুক্ত নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় যারপরনাই যথেচ্ছাচারী ও কুপথগামী এজন্য, ও অন্য অন্য গুরুতর কারণবশতঃ আমি তাহার সংশ্রব ও সম্পর্ক পরিত্যাগ করিয়াছি। এই হেতু বশতঃ বৃত্তিনির্বন্ধস্থলে তাঁহার নাম পরিত্যক্ত হইয়াছে এবং এই হেতুবশতঃ তিনি চতুর্বিংশধারা নির্দিষ্ট ঋণ পরিশোধকালে বিদ্যমান থাকিলেও আমার উত্তরাধিকারী বলিয়া পরিগণিত অথবা… এই বিনিয়োগ পত্রের কার্যদর্শী নিযুক্ত হইতে পারিবেন না।’’

এই উইল লেখার পর বিদ্যাসাগর ষোলো বছর বেঁচেছিলেন, কিন্তু উইলের একটি শব্দও পরিবর্তন করেননি।

বিহারীলাল সরকার তাঁর ‘বিদ্যাসাগর’ গ্রন্থে লিখেছেন – “পত্নী দিনময়ী দেবী প্রকৃত গৃহিণী ছিলেন, তিনি স্বহস্তে রন্ধন করিয়া লোকজনকে খাওয়াইতে বড় ভালবাসিতেন। দানধ্যানেও তাঁর পূর্ণ প্রবৃত্তি ছিল। বর্জিতপুত্র ( ত্যাজ্যপুত্র) নারায়ণে’র জন্যে পতির সহিত তাঁহার বাদবিসংবাদ ঘটিত। তিনি গোপনে পুত্রকে অর্থ সাহায্য করিতেন। এমনকি নিজের অলঙ্কার পর্যন্ত বন্ধক দিতেন।”

তবে পরবর্তীতে বিদ্যাসাগর গ্রন্থাবলী প্রকাশ (১৩০২ বঙ্গাব্দ) করতে গিয়ে সম্পাদকের দায়িত্ব নেন নারায়ণই৷ ভূমিকায় লিখেছেন, ‘পূজ্যপাদ পিতৃদেব ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মানবলীলা সম্বরণের পর অনেকেই বলেছিলেন যে, যাঁহার অমৃতময়ী লেখনীর প্রসাদে বঙ্গভাষা পুনর্জীবন লাভ করিয়াছে, সেই মহাত্মার পুস্তকগুলি গ্রন্থাবলীরূপে প্রকাশিত হওয়া নিতান্ত আবশ্যক। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের গ্রন্থাবলী মহামূল্য সামগ্রীর মধ্যে পরিগণিত হইয়া সর্ব্বত্র সাদরে পরিগৃহীত হইবেক।’

বিদ্যাসাগরের জীবদ্দশায় যদি এই উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারতেন ‘ত্যাজ্যপুত্র’ নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!