মনোজ মোহন চক্রবর্তী
Global Hunger Index-এর ২০২১ সালের সমীক্ষার প্রতিবেদনটি অতি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। জার্মানি ও আয়ারল্যান্ডের দুটি বেসরকারী সংস্থা (NGO) যৌথভাবে এই সমীক্ষা চালিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই দুটি সংস্থা সম্পর্কে পরে বলব।
এই সমীক্ষা প্রকাশ হওয়ার পর ভারত সরকার খুব অস্বস্তিতে পড়েছে। এই সরকার কোন ধরণের সমীক্ষাকেই বিশেষ গুরুত্ব দেয় না। এই সমীক্ষাটিকেও তাঁরা প্রায় উড়িয়ে দিয়েছে। তাঁরা বলছে, এই সমীক্ষায় পরিসংখ্যান নিরভর্যোগ্য ছিল না। পদ্ধতিগত ভুলও ছিল। কাজেই এই সমীক্ষাটির বিশেষ গুরুত্ব নেই। এই সমীক্ষায় যে পরিসংখ্যান ও পদ্ধতি ব্যবহার হয়েছে সে সম্পর্কেও পরে বলা যাবে। প্রথমে সরকারের এই বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কারণ বলি।
এদেশে যে সব বয়ষ্ক মানুষ ও শিশু অনাহারে অর্ধাহারে থাকে, মোদী সরকার আসার পর থেকে জনসংখ্যার সঙ্গে তাদের অনুপাতের হার ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। পৃথিবীর ১১৬টি দেশ এখনও ক্ষুধার কবলে রয়েছে। সমীক্ষায় এই দেশগুলো সম্পর্কে অনুসন্ধান করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে সব থেকে বেশি ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা রয়েছে আফ্রিকার কতগুলো অত্যন্ত দরিদ্র দেশে। এরকম দশটি দেশ আছে। তারপরই আমাদের স্থান। অর্থাৎ ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যার বিবেচনায় আমাদের স্থান পৃথিবীর অতি দরিদ্র মাত্র কয়েকটি দেশের সঙ্গে একই পংক্তিতে। স্মরণ করা যেতে পারে যে, অমর্ত্য সেন বলেছিলেন এই সরকার যে অর্থনীতি অনুসরণ করছে তাতে আমাদের অবস্থা অচিরেই সাব-সাহারার দেশগুলোর মত হতে বাধ্য। সে ভবিষ্যৎবাণী আজ ফলেছে। আজ আফ্রিকার দরিদ্রতম দেশের সঙ্গে এক পংক্তিতে এই সরকার আমাদের বসিয়েছে। কিন্তু একথা কে না জানে যে বিদ্বানদের কথা এই সরকার গ্রাহ্যও করে না।
আমাদের দেশ কী হারে নীচে নেমেছে এই সমীক্ষা থেকে একটি হিসেব আমরা পাই। এই ১১৬টি দেশের ক্ষুধা-সূচীর হার হিসেব করার জন্য একটি স্কেল বা মাপদণ্ড ব্যবহার করা হয়েছে। তাতে ১০০ নম্বর আছে। এই স্কেলে কোন দেশের নম্বর শূণ্য হলে সে দেশে ক্ষুধার্ত মানুষ নেই। সে দেশ এই সমীক্ষার আওতায় পড়ে না। যদি কোন দেশের নম্বর এক হয়, তাহলে সে দেশে ক্ষুধার্ত মানুষ আছে, কিন্তু সংখ্যা এত কম যে সে দেশকে সহজেই ক্ষুধার্তশূণ্য করে তোলা যাবে। কোন দেশের নম্বর এই স্কেলে যত বেশি হবে, তত বেশি হবে তার অনাহারী-অর্ধাহারী মানুষের সংখ্যা। এই নম্বর ১০ হলে বুঝতে হবে এদের সংখ্যা খুব বেশি । এই স্কেলে আমাদের দেশের স্কোর হল ২৭.৫।
এই হিসেবের উপর ভিত্তি করে এই ১১৬ টি দেশের স্থান নির্দিষ্ট হয়েছে। আমাদের স্থান হল ১০১ নম্বরে। অথচ ২০১৪ সালের মধ্যে আমাদের দেশে ক্ষুধার্ত মানুষের হার অনেক কমিয়ে আনা হয়েছিল। ২০১৪ সালে আমাদের স্থান ছিল ৫৫ নম্বরে । হিসেবটা এরকম।
বছর GHI-এ ভারতের স্থান
২০১৪ ৫৫
২০১৫ ৮০
২০১৬ ৯৭
২০১৭ ১০০
২০১৮ ১০৩
২০১৯ ১০২
২০২০ ৯৪
২০২১ ১০১
তাহলে ২০১৪-এ আমরা যে স্থানে ছিলাম আমরা এখন প্রায় তার দ্বিগুণ নীচে নেমে গেছি।
এই সমীক্ষা থেকে আমরা এই তথ্যগুলো পাচ্ছি:
১) আমাদের দেশের প্রতি একশ’জন মানুষের মধ্যে ১৫.৩ জন বয়ষ্ক ও শিশু ভাল করে খেতে পায় না। ২০২১ সালে আমাদের জনসংখ্যা যদি ১৩৯ কোটি হয়, তাহলে ২১ কোটি ২৬ লক্ষ মানুষ অর্ধাহারে অনাহারে থাকে।
২) এ দেশে ৫ বছরের নীচে যত শিশু আছে তাদের প্রতি একশ’জনের মধ্যে ১৭.৩টি শিশুর উচ্চতার অনুপাতে ওজন কম। অর্থাৎ এরা ভাল করে খেতে পায় না।
৩) এই শিশুদের প্রতি ১০০টির মধ্যে ৩৪.৭টি শিশু বয়সের অনুপাতে লম্বা হয় না।
৪) এ দেশের প্রতি ১০০টির মধ্যে ৩.৪টি শিশু পাঁচ বছর বয়স হবার আগেই মরে যায়। এর কারণ ক্ষুধা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ।
পৃথিবীতে খাদ্যের অভাব নেই। সকলের খাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য এখন উৎপন্ন হয়। তা সত্ত্বেও গোটা পৃথিবীতে ৮১কোটি ১০ লক্ষ মানুষ আজ খেতে পায় না। এই ৮১ কোটি দশ লক্ষের চার ভাগের এক ভাগ লোক (২১ কোটি ছাব্বিশ লক্ষ) আমাদের দেশেই থাকে। সরকার তাদের দেখতেও পায় না!
পরবর্তীতে, এই সমীক্ষার উদ্দেশ্য এবং যারা করেছে তাদের পদ্ধতির কতটুকু নির্ভরযোগ্য তা নিয়ে আলোচনা করব।
( মনোজ মোহন চক্রবর্তী করিমগঞ্জ কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক। এই নিবন্ধে প্রকাশিত মত তাঁর নিজস্ব।)