The Mirrow

আইজ ওয়াইড শাট্‌

Share the Article

সব্যসাচী রায়

‘হোয়াট্‌স দ্য প্লান?’ প্লাবিত শিলচর শহরের ত্রাণ বিতরণ ও জলবন্দীদের উদ্ধার পদ্ধতি নিয়ে এই প্রশ্নের উত্তরে আজ একজন বললেন, “নো প্লান ইজ দ্য প্লান।” উল্টো প্রশ্ন করলাম, তবে কি গো অ্যাজ ইউ লাইক? এই প্রশ্নে মৌন থাকলেন তিনি।

আচ্ছা, যদি ধরেও নেই প্লান-এ ছিল না (বা ব্যর্থ হয়েছে) তবে প্লান-বি টা কী ছিল? নাকি সেটাও নেই?

প্রশ্ন, প্রশ্ন…অনেক প্রশ্ন। খাল কাটা নিয়ে প্রশ্ন, বাঁধ ও স্লুইস-গেট্‌ ভাঙা নিয়ে প্রশ্ন, উপর্যুপরি দু-দু’টি বন্যার মাঝখানের সময়টুকু সদ্যব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন, এবারের বন্যার প্রথম দু’দিনে ডেমেজ-কন্ট্রোল পদ্ধতি (যদি কিছু থেকে থাকে!) নিয়ে প্রশ্ন… সে ধরণের অনেক প্রশ্নমালা পরবর্তীতে পোস্ট-মর্টেমের জন্য নাহয় তুলে রাখি। কিন্তু, আজকের পরিস্থিতিতে, ত্রাণ বিতরণ ও উদ্ধার পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তো করতেই হবে। নিজের জন্য। এই ‘আমি’ তো আর আমি একা একটি মানুষ না… বন্ধু, ভাই, অভিভাবক, ছাত্র … সবাইকে নিয়েই তো  আমার ‘আমি’-র অস্তিত্ব। তাই, আমার সেই পরিচয়গুলোর খাতিরে নিদেনপক্ষে এই সওয়ালগুলো গুছিয়ে রাখার প্রয়োজন রয়েছে।

গত পাঁচদিন ধরে শিলচর শহরে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ জলবন্দী হয়ে ফোর্সড আইসোলেশনে আছেন। এই যে লক্ষাধিক বললাম সেটা আমার ব্যক্তিগত অনুমান। তা, কত হবে? এর সঠিক তথ্য কি কাছাড় জেলা প্রশাসনের কাছে আছে? পাওয়া যাবে? কোন্‌ রোডে কোন্‌ কোন্‌ বাড়িতে কত কত মানুষ তিন/চার/পাঁচদিন ধরে আটকা পরে রয়েছেন তা সঠিক বলতে পারবেন প্রশাসন? জানিনা।

‘ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট’ শব্দগুচ্ছ ভারী শ্রুতিমধুর। কিন্তু, ব্যাপারটা ঠিক ততটুকুই কঠিন। মাইক্রো-লেভেল প্লানিং, মেক্রো-লেভেল প্লানিং, সেকেন্ড লাইন অব ডিফেন্স… এগুলো এর মধ্যেই নিহিত। তা সেগুলো হয়েছে বা হচ্ছে কি কাছাড়ে? এসডিআরএফ, এনডিআরএফ কাজ করছে বললেই যথেষ্ট কি? তাদেরকে পরিকল্পনা অনুসারে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে কি? সর্বোপরি, এই ব্যাপারগুলো নিয়ে শিলচরবাসী আশ্বস্ত হতে পারছেন কি?

শিলচরে আমার পরিচিতদের মধ্যে খুব কম করেও ডজন-খানেক বাড়িতে আজকের দিনে এক বা ততোধিক লোক অসুস্থ। সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও উদ্ধারে কাউকে পাওয়া যায় নি। কিছুক্ষেত্রে সাধারণ মানুষই কাজে এসেছেন শেষবেলায়। পানীয় জলের কথা আর নাই বা বললাম। বরাক নদীর পাড় ধরে কান পাতলে সেই হাহাকারের গুঞ্জন বহুকাল শুনা যাবে।

এই দুর্যোগের দিনে কালোবাজারিদের রমরমা… নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম কে নিয়ন্ত্রণ করবে? সবার উপরে, যে পানীয় জলের জন্য পিপাশার্থ মানুষ শুষ্ক কণ্ঠে ত্রাহি-ত্রাহি রব তুলছেন, সেই জল আকাশছোঁয়া দামে বিক্রী হচ্ছে। আপ্‌দা ম্য অব্‌সর ! শেষমেষ এই ভাবের এভাবেই সঙ্কুচন হয়ে গেল?

আর, নেতারা? “আমার যেমন বেনী তেমনি রবে চুল ভিজাবো না।” এর বেশি আর কীই বলবো! রাজনীতি তার নিজের পথেই চলছে, চলবে। তার (দল-মত নির্বিশেষে) এক সর্বব্যাপী সর্বগ্রাসী রূপ দিয়ে দিচ্ছি না তো আমরাই? জানি, এই প্রশ্নের গভীরে বিতর্কের (মানে আলোচনার) অবকাশ রয়েছে, তাই আজকের দিনে সেটা করলাম না। এই মুহূর্তে, আমাদের মাছের মতো চোখ খুলে ঘুমাতে হচ্ছে যে।  

সরকার প্রচুর ত্রাণের বন্দোবস্ত করেছেন, নিঃসন্দেহে এতে খামতি নেই। অনেক এসডিআরএফ, এনডিআরএফ কর্মী পাঠানো হয়েছে, উদ্ধারে সহায়তায় সেনাও এসেছেন। কিন্তু, সঠিক যোগসূত্রটুকু হচ্ছে কি? এখানে উদ্যম, পরিশ্রমের বাইরেও আরেকটি ব্যাপার আছে — দূরদর্শিতা এবং তীক্ষ্ণবুদ্ধির পরিকল্পনা। এই কথিত ‘ম্যান মেড ফ্লাডের’ মোকাবিলায় এখানেই মার খেয়ে যায়নি তো পুরো ‘ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’?

পাশাপাশি, আরেকটি কথা বুঝা গেল যে আমাদের ‘সেফটি ভাল্বটি’ বড়ই দুর্বল, সেই ভেঙে যাওয়া স্লুইস গেটের দেওয়ালের মতো। সামাজিক ন্যায় এবং আমাদের অধিকার/পরিষেবার ক্ষেত্রে রক্ষাকবচই এই সেফটি ভাল্ব। একে তিলে তিলে দুর্বল করে দেওয়া হচ্ছে না তো? ভাববেন। আমিও ভাবা প্রাক্টিস করছি।

পলিথিন ব্যবহার, মাস্টার ড্রেন, জলাশয়গুলো সংরক্ষণ… এই ব্যাপারগুলোকে ছাপিয়ে গেছে এবারের এই ‘ম্যান মেড ফ্লাড’। এই দুর্যোগের মাত্রা ভিন্ন। এই ভিন্ন মাত্রাকে মোকাবিলায় নিয়োজিতদের পক্ষ থেকে যতটুকু সাহস এবং বুদ্ধির প্রয়োজন সেটা এবার ভিজিবল হয় নি। বরং, মানুষের স্বাভাবিক চরিত্রগত সদগুণগুলোই বন্যার জলে তীব্রভাবে ভেসে উঠেছে এই ক’দিন। শিলচরের সাহসী যুবকেরা মানুষের প্রাণ বাঁচাতে যেভাবে ‘স্রোতের বিরুদ্ধে’ একমাথা জল ভেঙে বুক চিতিয়ে এগিয়ে এসেছেন এর ইতিহাসও স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

যাইহোক, আগামী ক’দিনে বন্যার জল হয়তো কমে যাবে। ধীরে ধীরে শহর আপন লয়ে ফিরে আসবে। হয়তো, কিছু দিনের মধ্যেই কাছাড়ে গ্রীনফিল্ড এয়ারপোর্ট স্থাপন হবে, কয়েক বছরের মধ্যেই শিলচর একটি স্মার্ট সিটিতে পরিণত হবে। আমি এবং আমার মতো অনেকেই হয়তো একখানা ফ্লেটবাড়ি কিনব তখন ‘বড় শহর’ শিলচরে। কিন্তু দুর্বল ‘সেফটি ভাল্ব’ কাছাড় তথা সারা উপত্যকাকে আগামীতেও দুঃশ্চিন্তায় রাখবে। তবে কি ‘প্রিভেনশন’ এবং ‘কিওর’-এর ঠিক মাঝখানে অনন্তকাল পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকবে উপত্যকাবাসী? আর, পরেরবার (না-হোক সেটাই কাম্য) যদি মহিশাবিলের মতো এক্সকিউজের সুযোগটাই না দেয় প্রকৃতি, তবে?

আচ্ছা, শহরটা ‘বড়’ হওয়ার কী বড়ই দরকার, থাক না সেই পুরনো শহরটাই। পুরনো শহরকে ফিরে পেতে একটি চেষ্টা করা যায় না? যেখানে আমাদের নিজেদের সেই ‘আমি’কে ফিরে পাওয়া যায়, যেখানে ‘সেফটি ভাল্ব’ খুবই শক্ত, যেখানে মানুষের ভিড়ে হারিয়ে যায় রাজনীতি, যেখানে মানুষের জন্য রেড কার্পেট বিছিয়ে দেয় ‘ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!