The Mirrow

ডিলিমিটেশন : আরেক ‘গড সেন্ট অপর্চুনিটি’?

Share the Article

এনআরসি যা পারেনি, ডিলিমেটেশন তা পারবে কি? পারবে কি মেরুকরণের গুমোট আবহকে উড়িয়ে দিয়ে সবাইকে এক সুতোয় বাঁধতে? বরাক উপত্যকাকে নিয়ে এই প্রশ্নটি আজ সবচাইতে বেশি জীবন্ত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিশুতীর্থ কবিতার সেই লাইনগুলো বিগতদিনে বারবার মনে পড়ত, “তাতে একত্রে মিলেছে পরশ্রীকাতরের কানাকানি, কুৎসিত জনশ্রুতি// অবজ্ঞার কর্কশহাস্য। সেখানে মানুষগুলো সব ইতিহাসের ছেঁড়া পাতার মতো // ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে…// মশালের আলোয় ছায়ায় তাদের মুখে // বিভীষিকার উল্কি পরানো।” বহুদিন পর, মনে হচ্ছে, এহেন অপবাদের শৃঙ্খল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে বুকে সাহস সঞ্চার করছে বরাক উপত্যকা, নিজের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিসর সঙ্কোচনের আশঙ্কায় একে অপরের হাত ধরছেন বরাকবাসী। ডিলিমিটেশনের প্রেক্ষিতে এটাই আজ বড় প্রাপ্তি।

২০ জুন নির্বাচন আয়োগ আসামের জন্য নির্বাচনকেন্দ্র পুনর্বিন্যাস বা ডিলিমিটেশনের খসড়া প্রস্তাব প্রকাশ করার পর বরাক উপত্যকায় এ-নিয়ে যে পর্যায়ে প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে তাতে একটি বিষয় স্পষ্ট যে উপত্যকাবাসী শঙ্কিত, অসন্তুষ্ট। এই অসন্তুষ্টির সম্মিলিত বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে ২৭ জুনের বরাক বনধে। ১৯৭৬ সালের শেষ ডিলিমিটেশনের পর বিগত কয়েক দশকে প্রায় স্থির হারে উপত্যকার জনসংখ্যা বাড়ার পরও বিধানসভা আসনসংখ্যা পনেরো থেকে দু’টো কমবে কেন? ভৌগলিকভাবে বিচ্ছিন্ন ও অনেক দূরত্বে থাকা অঞ্চলগুলোকে পুরনো নির্বাচনকেন্দ্র থেকে কাটছাট করে দূরের বিছিন্ন নির্বাচনকেন্দ্রের সঙ্গে কেন সংযুক্ত করা হল? তবে, কার স্বার্থে এই ডিলিমিটেশন?

খসড়া প্রস্তাবটি নিয়ে এ-ধরণের বেশ কিছু ন্যায্য প্রশ্ন আজ উঠে আসছে। লাভ-লোকসানের প্রশ্নের বাইরে এখানে ভাষাগোষ্ঠী হিসেবে বাঙালির বঞ্চনাটাই বেশি আলোচিত হচ্ছে। যুক্তি-তর্কের বাইরে ভোট রাজনীতির অঙ্কটাই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।  

এই খসড়া প্রস্তাব প্রকাশের পর অনেকে বলছেন, আসাম চুক্তি ও এনআরসি যা পারেনি তা এই ডিলিমিটেশন করে দেখাবে, খিলঞ্জিয়ার স্বার্থ রক্ষা করবে আখেরে। বলা বাহুল্য, রাজ্যে খিলঞ্জিয়া কারা সেটাই এখনও সাব্যস্ত হয়নি। তাছাড়া, খিলঞ্জিয়া-অখিলঞ্জিয়া বিভাজন এখানে আসবে কেন? সেক্ষেত্রে, সেই খিলঞ্জিয়াপ্রেমীদের যুক্তিতে যারা অখিলঞ্জিয়া তাদের প্রতি বৈমাতৃসুলভ আচরণ হচ্ছে বললে অত্যুক্তি হবে কি? সংবিধানের মূল চেতনাতে আঘাত বললে আপত্তি হবে কি?

ডিলিমিটেশনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জনসংখ্যার সমান অংশের সমান প্রতিনিধিত্ব ও ভৌগলিক অঞ্চলগুলোর ন্যায্য বিভাজন নিশ্চিত করা। এই নিবন্ধে খসড়া প্রস্তাবের আইনগত বিশ্লেষণ সম্ভব না হলেও, ডিলিমিটেশন সংক্রান্ত কয়েকটি বিধানের উল্লেখ করতে হয়। সংবিধানের ১৭০(২) ধারা বলছে, “প্রতিটি রাজ্যকে এমনভাবে আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকায় বিভক্ত করা হবে যাতে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকার জনসংখ্যা ও তার জন্য বরাদ্দকৃত আসনের অনুপাত, যতদূর সম্ভব, রাজ্য জুড়ে একই হবে।” সেইসঙ্গে, ২০০২ সালের ডিলিমিটেশন আইনের ৯(১)(ক) বিধানে উল্লেখ রয়েছে, “সমস্ত নির্বাচনী এলাকা, যতদূর সম্ভব, ভৌগোলিকভাবে আঁটসাঁট এলাকা হতে হবে, এবং সেগুলোর সীমানা নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে ভৌত বৈশিষ্ট্য, প্রশাসনিক ইউনিটের সীমানা, যোগাযোগের সুবিধা এবং জনসাধারণের সুবিধার প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।” ২০০২ সালের ডিলিমিটেশন আইনের সূত্র ধরে ২০০৪ সালে প্রকাশিত নির্দেশিকা ও পদ্ধতির V(iv) নম্বর ধারায় স্পষ্ট ভাবে লেখা আছে, “জেলার এলাকাকে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিধানসভা কেন্দ্রে ভাগ করার ক্ষেত্রে জেলার প্রতি নির্বাচনী এলাকার গড় জনসংখ্যা বিচারে রাখতে হবে যে এবং সেক্ষেত্রে ১০% যোগ বিয়োগকে অনুমতিযোগ্য বিচ্যুতি হিসেবে মানতে হবে।” V(v) নম্বর ধারায় উল্লেখ আছে, “বিধানসভা কেন্দ্রগুলো পুনর্বিন্যাস করার ক্ষেত্রে, যতদূর সম্ভব, মহকুমা/তহসিলগুলো অক্ষত রাখতে হবে এবং সেগুলো অপ্রয়োজনীয়ভাবে যাতে ভাঙা না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।” তার পরের V(vi) ধারায় বলা রয়েছে, “প্রশাসনিক খণ্ডের ভিত্তিতে বিধানসভার নির্বাচনকেন্দ্রগুলো পুনর্বিন্যাস করার ক্ষেত্রে এই জাতীয় প্রশাসনিক খণ্ডগুলোর সংলগ্নতাই মৌলিক আবশ্যকতা হবে, দেখতে হবে যাতে কোনও নির্বাচনী এলাকার অন্তর্গত কোনও অঞ্চল অন্য নির্বাচনী এলাকার অন্তর্গত নির্দিষ্ট অঞ্চলগুলোর মধ্যে সংলগ্নবিহীন ছিটমহল/দ্বীপ না হয়ে থেকে যায়।” V(vii) ধারা বলছে, “উপরন্তু, সংলগ্নতা ছাড়াও ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য, উন্নত যোগাযোগ, যোগাযোগের মাধ্যম, জনসাধারণের সুবিধার বিষয়ও বিবেচনায় রাখা হবে এবং নদী, পাহাড়, বন, গিরিখাত বা অন্যান্য প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতায় বিভক্ত এলাকা একই নির্বাচনী এলাকায় রাখা হবে না।”

প্রশ্ন উঠছে পুনর্বিন্যাসের এই খসড়া প্রস্তাবে, বরাক উপত্যকার প্রেক্ষিতে, আইনের এই বিধানগুলোর সঠিক প্রতিফলন হয়েছে কি? বরাকের তিন জেলার বিভিন্ন অঞ্চলকে এক জেলা থেকে অন্য জেলার বিধানসভাকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার পরও করিমগঞ্জ সংসদীয় কেন্দ্রের মোট ভোটদাতার সংখ্যা কমেনি, তবুও এর আওতাধীন বিধানসভার আসন সংখ্যা আট থেকে দু’টো কমিয়ে ছয় করা হল কেন এর সদুত্তর কেউ দিতে পারছেন না। এতে পুরো প্রক্রিয়াটি নিয়ে সংশয় দানা বাঁধছে।

করিমগঞ্জের জন্য এই ডিলিমিটেশনের প্রস্তাব যেন আরেক সিলেট বিভাজন! রাজ্যপালের এক নির্দেশ অনুসারে বদরপুর শহরকে ইতিমধ্যে কাছাড়ের কাটিগড়ায় ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। এবার, শতবর্ষ পুরনো করিমগঞ্জ পুরসভাকে উত্তর করিমগঞ্জ কেন্দ্র থেকে সরিয়ে বদরপুর কেন্দ্রে দিয়ে দেওয়া হল। চরগোলা-ঘোড়ামাড়া, দত্তপুর, মুগরাপুর, আধরকোনা, মহাকল, দক্ষিণ-বদরপুর জিপি — সবই বদরপুর শহরের পার্শ্ববর্তী অঞ্চল। সেগুলোকে কেটে অনেক অংশ এখন রাতাবাড়ি বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অপরদিকে, রাতাবাড়ি দ্বারা বেষ্টিত হলেও মধ্য বাগবাড়ি জিপি, কালিগঞ্জ এবং উত্তর করিমগঞ্জের মাইজগ্রাম, বাগরসাঙ্গন, বাজারঘাট জিপি এবং নিলামবাজারের কিছু অংশ বদরপুরের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। উত্তর করিমগঞ্জ নির্বাচনকেন্দ্রের উত্তর করিমগঞ্জ জিপিটাই এখন উত্তর করিমগঞ্জে থাকছে না, দেওয়া হয়েছে বদরপুরে। প্রতিদানে হাইলাকান্দির সীমানাঘেষা ভৈরবনগর, বিনোদিনি ও মোহম্মদপুর জিপির অংশ প্রস্তাবিত উত্তর করিমগঞ্জ নির্বাচনকেন্দ্রে সংযুক্ত করা হয়েছে। 

কাছাড়, হাইলাকান্দির চিত্রটিও একইরকম। শিলচর পুর-এলাকার সাতটি ওয়ার্ড উদারবন্দে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বড়জালেঙ্গা উন্নয়নখন্ডের বড়জালেঙ্গা, ছোটোজালেঙ্গা, শিলকুরি বা ঘুংঘুর জিপির বৃহদাংশ বড়খলায় সংযুক্ত করা হয়েছে – উত্তর  আর  দক্ষিণ, মাঝখানে  শিলচর! এ-রকম অসংখ্য অদলবদলের নিদর্শন দেখা যাচ্ছে এই খসড়া প্রতিবেদনে। নির্দ্বিধায় বলা যায়, এইভাবে অঞ্চল পুনর্বিন্যাসে সাধারণ জনগণের ভোগান্তির সীমা থাকবে না। তবে কার স্বার্থে এই পুনর্বিন্যাসের প্রস্তাব? এই প্রশ্নটি আজ উপত্যকার সাধারণ নাগরিকদের।

বরাকে খিলঞ্জিয়া আছেন বলে দিশপুরের রাজনৈতিক মহল মানেন না। তবে বরাক উপত্যকার ভোট-মানচিত্রে এই রদবদলের উদ্দেশ্য কী? সংবিধানের রূপকার বি আর আম্বেদকর যদিও ভাষার ভিত্তিতে রাজ্যগঠনের সমর্থনে ছিলেন, তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে বড় রাজ্যগুলোতে ভাষাগত সংখ্যালঘুরা হারিয়ে যেতে পারে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠদের ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে বিরত রাখার জন্য কোনও সুরক্ষা ব্যবস্থা না থাকে। এই আশঙ্কা যে অমূলক ছিল না তা কি আজ হাড়েহাড়ে বোঝা যাচ্ছে না?  

আসলে, খিলঞ্জিয়া-অখিলঞ্জিয়া বিভাজন নিয়ে রাজনীতি রাজ্যে স্বাধীনতার আগে থেকে চলে আসছে, দেশভাগ যেখানে ঘৃতাহুতি দিয়েছে। অনেকে এই দেশভাগকে এক ‘গড সেন্ট অপর্চুনিটি’ বলে মনে করেছিলেন (‘গড সেন্ট অপর্চুনিটি?’ শীর্ষক নিবন্ধে সুজিৎ চৌধুরী এর বিশদ আলোচনা করেছেন যার বাংলা অনুবাদ সব্যসাচী রায়ের ‘অভিবাসন, নাগরিকতা ও আসাম’ শীর্ষক বইটিতে সংযোজিত রয়েছে।)। কিন্তু, সেই সময় থেকে পঁচাত্তর বছর পার করে আসার পর সেই আত্মতুষ্টির ছিটেফোঁটাও যে আজ আর নেই সেটা সহজেই দেখা যায়। তবে কি আরেক ‘গড সেন্ট অপর্চুনিটির’ আশায় এই ডিলিমিটেশন? না, কেবল আশা দেখানো হচ্ছে, পেছনে নিছক এক ভোট-রাজনীতির সমীকরণ!  

এই কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে বাঙালির কোনও উগ্র জাতীয়তাবাদ বা উগ্র রাষ্ট্রবাদ হয় না। বাঙালির আছে উদার জাতীয়তাবোধ। শত আঘাতের পরও বহুত্বের বেদীমূল থেকে সৃজিত সমন্বয়ের মূল ভাব থেকে কখনও সরেনি বাঙালি। সাময়িক বিভাজনের শিকার হলেও, সরেনি বরাকের বাঙালিও। ডিলিমিটেশনের প্রস্তাবে অসন্তুষ্টি প্রকাশে বাঙালি এবং কেবল বাঙালি হিসেবে বরাকবাসী যেভাবে নিজেদের পরিচয় তুলে ধরছেন, সেটা নতুন আলোর দিশারী, যেন সমন্বয়ের এক ‘গড সেন্ট অপর্চুনিটি’। যারা উপত্যকাবাসীর মতামতকে উপেক্ষা করে ক্ষমতার গলিতে আনাগোনা করছেন তাদের প্রতি এক স্পষ্ট বার্তা। এক বৃহত্তর জাতীয়তাবোধের পাটাতনে দাঁড়িয়ে আজ বরাকবাসী বন্ধক-মুক্তির পথে হাতে হাত ধরছেন। পারস্পরিক বিশ্বাসকে সম্বল করেই আত্মরক্ষার পথে এগিয়ে যাওয়াটাই সময়ের দাবি। “আমি শুনেছি সেদিন নাকি // তুমি তুমি তুমি মিলে, // তোমরা সদল বলে সভা করেছিলে। // আর সেদিন তোমরা নাকি অনেক জটিল ধাঁধা // না বলা অনেক কথা, কথা তুলেছিলে।” মৌসুমী ভৌমিকের এই কবিতাটির বাস্তবিক প্রতিফলন আজ বরাকের মাটিতে দেখা যাচ্ছে। উপত্যকাজুড়ে চলছে সভা-সমিতি। সেখানে ক্ষোভ প্রকাশ হচ্ছে, উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বিভেদের কালোমেঘ, গ্রহণ করা হচ্ছে গণতান্ত্রিক উপায়ে প্রতিবাদ-আপত্তির পরিকল্পনা। নির্বাচন আয়োগের শুনানিতেও বরাকের নাগরিকেরা দল-মত নির্বিশেষে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছেন। এই যখন পরিস্থিতি, তখন জনগণের মতামতকে সম্মান জানিয়ে এই ব্যাপারে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসাটাই জনপ্রতিনিধিদের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে। বিশ্বাসযোগ্যতা রক্ষার এটাই সঠিক সময়। সেক্ষেত্রে, ডিলিমিটেশন তাদের জন্য হবে এক ‘গড সেন্ট অপর্চুনিটি’।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!