The Mirrow

ডার্ক-ওয়েব আজ অপরাধীদের মৃগয়াক্ষেত্র

Share the Article

রাজীব দাশ

“পরিকল্পনা করেই খুনের সন্দেহ, ডার্ক-ওয়েব মারফত অস্ত্র কারবার”, “পাকিস্তান থেকে ডার্ক-ওয়েবে আল-কায়েদা জঙ্গিদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছিল নির্দেশ, এএনআই-র  জেরায় চাঞ্চল্যকর তথ্য”, “ডার্ক-ওয়েবের মাধ্যমে লোন উল্‌ফ নিয়োগ করে রেস্তোরাঁ, সিনেমা হল্‌, থিয়েটার ও বাজারে হামলার ছক আল-কায়দার”, “এটিএম জালিয়াতি — ডার্ক-ওয়েবে তথ্য কিনে নেপালে চলত কার্ড ক্লোনিং” এই বিভিন্ন ধরনের চাঞ্চল্যকর তথ্য আজ প্রতিনিয়ত সংবাদ শিরোনামে পাওয়া যায়। জাল ফেলে এ-ধরনের অনৈতিক কাজে লিপ্তদের শায়েস্তা করা সেরকম সম্ভব হয়ে উঠছে না, হোম-ওয়ার্কেই আটকে আছেন বিভিন্ন তদন্তসংস্থা। এর কারণ হিসেবে তদন্তকারী সংস্থার আধিকারিকরা জানাচ্ছেন যে এই ডার্ক-ওয়েবের পরিচালন সম্পর্কে পুরো তথ্য না থাকায় তদন্ত প্রক্রিয়া বারবার হোচট খাচ্ছে। এখনই এই ‘ডার্ক ওয়েবের’ সমাধান করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন সাইবার বিশেষজ্ঞদের এক বিরাট অংশ।

তাই, কী এমন মারাত্মক এই ‘ডার্ক-ওয়েব’ যা আজ আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে প্রায়? কারাই বা এই অন্ধকার জগতে ‘সাইবার ক্রাইম’ চালিয়ে যাচ্ছে? কীভাবেই বা চলছে এই অপরাধকর্ম? 

ডার্ক-ওয়েব হচ্ছে আমাদের ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের একটি এনক্রিপ্ট করা অনলাইন জোন বা ডেটা নেটওয়ার্ক যা গুগলের মত প্রচলিত সার্চ ইঞ্জিনে খুঁজে পাওয়া যায় না। আজকের দিনে ডার্ক-ওয়েবকে অবৈধ কাজে ব্যবহার করা হলেও এর পথ চলা শুরু হয়েছিল ভাল উদ্দেশ্যে। গোপনীয় অনলাইন যোগাযোগের ধারণা নিয়ে ডার্ক-ওয়েবের পথচলা শুরু হয় সেই ১৯৬০ সালে।

আমরা ইন্টারনেটের যে অংশটি সাধারণত ব্যবহার করে থাকি সেটিকে সার্ফেস-ওয়েব বলা হয়, আর যে অংশটি আমরা সরাসরি ব্যাবহার করতে পারি না সেটিকে ডিপ-ওয়েব হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ডার্ক-ওয়েব মূলত ডিপ-ওয়েবেরই একটি অংশ যেখানে সার্চ ইঞ্জিন সরাসরি প্রবেশ করতে পারে না। যদিও কখনও কখনও ডিপ-ওয়েব শব্দটি ডার্ক-ওয়েবকে বোঝাতে ব্যবহার করা হয়।

আমরা সাধারণভাবে যে ধরনের ওয়েবসাইট প্রতিনিয়ত ব্যবহার করে থাকি সেগুলোর তুলনায় ডার্কনেটের ওয়েবসাইটগুলো ভিন্ন নীতি অনুসরণ করে থাকে। ডার্কনেট-ওয়েবসাইটগুলো শুধুমাত্র কিছু নির্দিষ্ট নেটওয়ার্কের উপরে কাজ করে থাকে – যেমন, টর (অনিওন রুটার) বা আইটুপি (ইনভিসিবল ইন্টারনেট প্রোজেক্ট)। এই ওয়েবসাইটগুলোর ডট অনিওন ( .onion) এক্সটেনশন থাকে। টরের আরেক নাম অনিওন রাউটার কারণ এখানে একজনের পরিচয় পেঁয়াজের খোসার মতো একের পর এক পরতের পর পরতের পিছনে লুকনো থাকে।

এই ডট অনিওন বা ডার্ক-নেট ওয়েবসাইটগুলোতে প্রবেশ বা অ্যাক্সেস করতে গেলে আমাদেরকে একটি বিশেষ ধরণের ব্রাউজার ব্যাবহার করতে হয় যার নাম ‘টর ব্রাউজার’।  

এই গোপন ওয়েবসাইটগুলো শুধু মাত্র টর ব্রাউজার ব্যবহার করে খোলা যায় এবং যদি কেউ এই ধরনের ওয়েবসাইটের সঠিক তথ্য না জেনে থাকে সে ক্ষেত্রে টর ব্যবহার করেও এই ওয়েবসাইটগুলোকে খোঁজে বের করা সম্ভব নয়। সেই সুবিধাটুকু নিয়ে অসামাজিক ব্যক্তিরা গোপন ওয়েবসাইট খুলে ড্রাগ কেনা-বেচা, বন্দুক কেনা-বেচা, মানুষ কেনা-বেচার মতো বেআইনি ও অসামাজিক কাজ চালিয়ে যায়। এমনকি, এই ডার্ক-ওয়েবের আড়ালে বিভিন্ন উগ্রপন্থী সংগঠনগুলো সামাজিক মাধ্যম সৃষ্টি করে ফেসবুক ও টুইট্যারের মত নিজস্ব যোগাযোগ মাধ্যম বানিয়ে তাতে তথ্য আদান-প্রদান করে, হামলা বা নাশকতার ছক তৈরি করে। যেমন, আফগানিস্তানের কুখ্যাত হাক্কানি নেটওয়ার্ক এই ডার্ক-ওয়েবের মাধ্যমেই নিজেদের গোষ্ঠীর কাজ চালিয়ে যায়। সাম্প্রতিক অধিকাংশ সাইবার ক্রাইম যেমন ব্যাঙ্ক প্রতারণা এই ডার্ক-ওয়েবের আড়ালে হয়ে থাকে।

তা হলে এই ডার্ক-ওয়েবের আঁধারে চলতে থাকা অনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধ করার উপায় কী? এনসিবি-র একজন বিশেষজ্ঞের মতে ‘‘কেন্দ্রীয় সরকারের সাইবার বিশেষজ্ঞরা কাজ চালাচ্ছেন। দ্রুত ডার্ক-ওয়েবের রহস্য সমাধান হবে।’’ তিনি আরেকটি উপায়ের কথা বলেছেন যে ডার্ক-ওয়েবে ঢুকে কাজ শুরুর আগে পর্যন্ত ব্যবহারকারীদের তথ্য আই পি অ্যাড্রেসে জমা থাকে। সেই সময়েই নজরদারি চালিয়ে ডার্ক-ওয়েব ব্যবহারকারীদের তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব। তাঁর কথায় – ‘‘টেলিকম কোম্পানিগুলোকে দিয়ে ডার্ক-ওয়েবে কারা বিচরণ করছে সেই তথ্য সংগ্রহ করা যেতে পারে। সেই শুত্র ধরে সব তথ্য উদ্ধার করা সম্ভব। ……মূলত গোপনীয়তা রক্ষার মাধ্যমে বাক-স্বাধীনতার জন্য এই ধরনের ওয়েবের ব্যবহার শুরু হয়েছিল। তবে গোপনীয়তার ভাল-খারাপ দুই-ই রয়েছে। অপরাধ হলে তখন সেই গোপনীয়তাই আইনের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ জন্যই তদন্তকারীরা দোষীদের ধরতে পারছেন না।’’

তাই আমাদের সবার মনে প্রশ্ন আসতে পারে যে ডার্ক-ওয়েবে বিচরণ করাটা কি বেআইনি? আসলে তা নিশ্চয়ই নয়। এটি সম্পূর্ণ ব্যবহারকারীর মানসিকতা ও অভিসন্ধির ওপর নির্ভর করে। ডার্ক-ওয়েব নিজে কখনই অবৈধ নয়, তবে কিছু সাইট সেটাকে ব্যবহার করে অবৈধ কার্যকলাপ চালিয়ে যায়। ইন্টারনেট ব্যবহার বাড়ার সাথে সাথে এই ডার্ক-ওয়েবের আড়ালে চালানো অপরাধ ও প্রতারণার মাত্রাও বৃদ্ধি পেয়েছে সমহারে। এই ব্যাপারে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের সচেতন থাকাটা জরুরি।

( রাজীব দাশ করিমগঞ্জ কলেজের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। )

1 thought on “ডার্ক-ওয়েব আজ অপরাধীদের মৃগয়াক্ষেত্র”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!