আশিস চৌধুরী
২০০৫ সালের ২ অক্টোবর মৌলানা বদরুদ্দিন আজমল সাহেবের নেতৃত্বে এআইইউডিএফ দল আত্মপ্রকাশ করে। যদিও এই দল সর্বভারতীয় দল হিসেবে নিজেদেরকে দাবি করেছিল কিন্তু বাস্তবে আসামের রাজ্য রাজনীতিতেই কেবল এই দলের প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে অনুভূত হয়ে আসছে। নতুন এই দলে আদিত্য লাংথাসার মত সামান্যসংখ্যক অন্য-ধর্মাবলম্বী মানুষের উপস্থিতি থাকলেও আসলে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক শক্তি রূপেই এআইইউডিএফ গড়ে উঠে এবং ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।
ইতিহাসে ফিরে দেখলে, আসামে বিদেশি খেদা আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া ও সর্বোপরি ১৯৮৫ সালের আসাম চুক্তির বিরোধিতার মধ্য দিয়ে ব্যাপক গণ-আন্দোলনের হাত ধরে সংযুক্ত সংখ্যালঘু মোর্চা বা ইউএমএফ দলের আবির্ভাব হয়েছিল। কিন্তু, সেই ইউএমএফ দলের সঙ্গে এআইইউডিএফ দলের আত্মপ্রকাশের তুলনা করলে ভুল হবে। বিদেশি খেদা আন্দোলনের নামে জাতিবিদ্বেষী, ধর্মবিদ্বেষী আগ্রাসী আক্রমণের প্রতিরোধে ইউএমএফ-এর উত্থান ঘটেছিল। আর সেই উত্থানে যুক্ত ছিল মূলত ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের যৌথশক্তি। সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ উদার মানবতাবাদী আদর্শে বিশ্বাসী ব্যারিস্টার গোলাম ওসমানি সহ ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালি হিন্দুদের আস্থাভাজন শান্তি রঞ্জন দাসগুপ্ত, কালিপদ সেনের মত নেতা এই দল প্রতিষ্ঠায় যুক্ত ছিলেন। ডাঃ অর্ধেন্দু কুমার দে-র মত যুবনেতা উঠে এসেছিলেন সেই গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে।
অন্যদিকে, এআইইউডিএফ দলের সুপ্রিমো বলে যাকে আখ্যায়িত করা হয় সেই বদরউদ্দিন আজমল সাহেব প্রকৃত অর্থেই সুপ্রিমো। নিজের কর্মক্ষমতায় অর্জিত বিপুল সম্পদের অধিকারী আজমল সাহেব-ই এই দলের সর্বময় কর্তা। এই দলে তার কথাই শেষ কথা। একদিকে দেশে দেশে বিস্তৃত বিশাল বাণিজ্যের মালিক আর অন্যদিকে একজন ধর্মনিষ্ঠ মৌলানা – এই ভাবমূর্তি নিয়ে আজমল সাহেব অতি দ্রুত আসামের রাজনীতিতে একজন প্রভাবশালী নেতা হয়ে উঠেন। তার এবং তার প্রতিষ্ঠিত দলের প্রভাবের ক্ষেত্র হচ্ছে নিম্ন অসমের অভিবাসী কৃষিজীবী মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো যা প্রধানত অবিভক্ত গোয়ালপাড়া, কামরূপ, নঁগাও এবং দরং জেলায় বিস্তৃত। অন্যদিকে বরাক উপত্যকার ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যেও একইভাবে এই দলের শক্তিশালী জনভিত্তি রয়েছে।
আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে ইউএমএফ দলের প্রধান মুখ ওসমানি সাহেব বরাক উপত্যকার মানুষ হলেও এবং আসাম চুক্তির বিরুদ্ধে বরাক উপত্যকায় তীব্র বিক্ষোভ দেখা দিলেও ১৯৮৫ সালে বিধানসভা নির্বাচনে ইউএমএফ সংখ্যালঘুদের ত্রাতার ভূমিকায় থেকে যে ১৮/১৯ টা আসনে জয়ী হয়েছিল তার একটিও বরাক উপত্যকায় ছিল না, সবগুলোই ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায়। অন্যদিকে ২০০৬ সাল থেকে আজমল সাহেবর দল কমবেশি যে জনসমর্থন পেয়ে চলেছে তা দুই উপত্যকায়ই বিস্তৃত। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় দলের নির্বাচিত বিধায়কদের মধ্যে দু-একজন অ-মুসলমান থাকলেও বরাক উপত্যকায় তারা সকলেই মুসলমান।
আবহমানকাল ধরেই এই দুই উপত্যকায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু প্রধান এই অঞ্চলগুলো কংগ্রেস দলের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে কাজ করেছে। এআইইউডিএফ এর আবির্ভাব ও সংগঠন বিস্তার কংগ্রেসের এই নিশ্চিত ভোট ব্যাঙ্ককে চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। বিশেষ করে কংগ্রসের সংখ্যালঘু নেতাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দেয়। সে-কারণেই কংগ্রেসের অনেক বিশিষ্ট সংখ্যালঘু নেতা সময়ে সময়ে এআইইউডিএফ দলের সঙ্গে কংগ্রেসের মিত্রতার বিরোধিতা করে এসেছেন।
এখানে পর্যালোচনার বিষয় হচ্ছে যে এই দুই দলের জোটবদ্ধভাবে বা পৃথক পৃথক নির্বাচন লড়ার ক্ষেত্রে সামগ্রিক নির্বাচনী ফলাফলে কী প্রভাব পড়তে পারে। পরিসংখ্যানের সাহায্য না নিয়েও সাধারণ বিচারেই যে সত্যটা বেরিয়ে আসে তা-হল আসন লাভের সামগ্রিক চিত্রে খুব হেরফের হয় না। ২০০৬ সালে এআইইউডিএফ দলের আত্মপ্রকাশের পর থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এই দলের সঙ্গে আতাঁত করে বা না করে কংগ্রেসের সংখ্যালঘু বিধায়কের সংখ্যায় তেমন পরিবর্তন হয় নি। আর ধর্মীয় সংখ্যালঘু প্রধান এলাকায় এই দু’দলের প্রাপ্ত আসন যোগ করলে তা মোটামোটি একই থাকছে।
এর ব্যাখ্যা অতি সহজ। রাজ্যে নিরঙ্কুশ ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনবসতিপূর্ণ বেশ ক’টি আসন রয়েছে। যেমন – ধুবড়ি, দক্ষিণ শালমাড়া, মানকাচর ইত্যাদি। বরপেটার বাঘবর, জনিয়া, চেংগা বা অবিভক্ত নগাঁওয়ের যমুনামুখ, ধিং, রুপহী, সামাগুড়ি, বরাকের হাইলাকন্দির অন্তত দু’টি আসন, করিমগঞ্জের দক্ষিণ করিমগঞ্জ ও বদরপুর, কাছাড়ে সোনাই ইত্যাদিতে মুসলমান ভোটের সংখ্যাধিক্য এতই প্রবল যে এসব কেন্দ্র থেকে মুসলমান প্রার্থীই নির্বাচিত হয়ে আসছেন – তা সে যে দলেরই হোন। এছাড়াও বেশ কিছু আসন আছে যেখানে মুসলমান ভোটদাতারাই জয়-পরাজয় নির্ধারণ করেন।
সামগ্রিক ফলাফলে দেখা যায় এইসব কেন্দ্রে কংগ্রেস বা এআইইউডিএফ এর প্রার্থীরা জয়ী হয়ে থাকেন। বিগত দুটি নির্বাচনে ধর্মীয় মেরুকরণ এত গভীর ও ব্যাপক হয়েছে যে মুসলমানরাও সংঘবদ্ধ ভাবে যেকোনো একজন সংখ্যালঘু প্রার্থীকে বেছে নিয়েছেন। প্রান্তিক আসনগুলিতে মেরুকরণের তীব্রতা ও কিঞ্চিৎ ভোটভাগাভাগির খেলায় ক্রিকেটের শেষ ওভারে বাজিমাৎ করার মত কেউ কেউ জয়ী হয়েছেন। এখানে দল গৌণ, প্রার্থীদের ধর্মীয় পরিচয় মুখ্য হয়ে উঠেছে। এই বাস্তব পরিস্থিতিতে কয়েকটি আসনের হাতবদল ছাড়া এই দুই দলের আসন সংখ্যায় তেমন কোন হেরফের হয়নি।
কংগ্রেস দলের গত দুটি নির্বাচনে প্রাপ্ত আসন সংখ্যার দিকে তাকালেই এটা স্পষ্ট হয়। ২০১৬ তে আঁতাত না করে কংগ্রেস বিধানসভার ২৬টি আসনে জয়ী হয় যার প্রায় অর্ধেকই ছিল ধর্মীয় সংখ্যালঘু আসন। এবার ২০২১ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস দল ২৯টি আসন পেয়েছে। অর্থাৎ, গত নির্বাচনের তুলনায় মাত্র তিনটি আসন বেশি। এই ২৯ এর ভাগাভাগি দেখলে পাওয়া যাচ্ছে কংগ্রেসের ধর্মীয় সংখ্যালঘু আসনে জয়ী প্রার্থী পাঁচজনের মত বাড়লেও উজান আসাম এবং অন্যান্য অসমিয়া প্রধান অঞ্চলে কংগ্রেসের বহু নেতা আসন হারিয়েছেন। এবং নতুন করে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ছিল এমন বহু আসনে ‘আজমল মুখ্যমন্ত্রী’ হয়ে যাবেন এই গুজবে ভর করে চূড়ান্ত মেরুকরণ করে বিজেপি কংগ্রেসের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। যার ফলে, এত ঘটা করে মহাজোট করেও কংগ্রেসের শক্তিবৃদ্ধি অধরা রয়ে গেছে। সেদিকে বিচার করলে, আজমল সাহেবের দলের ফলাফল কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ীই হয়েছে।
এআইইউডিএফ এর সঙ্গে মিত্রতা সামগ্রিক বিচারে তাই কংগ্রেসের ক্ষেত্রে লোকসানই বয়ে এনেছে।
(এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত সম্পূর্ণ লেখকের।)