The Mirrow

ছোটবেলার পুজো

Share the Article

সুজাতা চৌধুরী

আমার জন্ম রামকৃষ্ণনগরে। টিলা, পাহাড়, চা বাগান ঘেরা এক অপূর্ব সুন্দর জনপদ। কিছুটা দূরেই রূপসী শনবিল। আমরা থাকতাম রামকৃষ্ণনগর ব্লকে। শরৎ আসত শিউলির ডালি সাজিয়ে। ভোরবেলা উঠে দাদাদের সাথে ফুল কুড়োতে যেতাম। শিউলি গাছের তলা সাদা ফুলে ছেয়ে থাকত। সাজি ভরে ফুল কুড়িয়ে আনতাম। ব্লকে প্রায় প্রতিটি কোয়ার্টারে শিউলি আর স্থলপদ্মের গাছ ছিল। গোলাপি স্থলপদ্মে ভরে থাকত গাছ। সকালের হালকা গোলাপি ফুলের রং বেলা বাড়ার সাথে সাথে গাঢ় গোলাপি হয়ে যেত আর শেষ বিকেলে পদ্মের পাপড়ি মুখ বুজত। সেই বিকেলের বুজে যাওয়া পদ্মের গাঢ় গোলাপি রঙের মধ্যে একটা করুণ আভা লেগে থাকত যেন। 

রামকৃষ্ণ নগরের শিউলি কুড়োনোর স্মৃতি মনে আছে, কিন্তু দুর্গাপূজার কোনো স্মৃতি নেই। হসপিটালের কাছে বিহারী পালের বাড়িতে পুজো হত, মায়ের কাছে শোনা।
আমার আট বছর বয়সে আমরা বদলি হয়ে শিলচর চলে আসি।  বরাক নদীর পাড়ে ভাড়া বাড়িতে থাকতাম। বর্ষায় উথাল-পাথাল নদীতে ভেসে যেত ঘর বাড়ি, বাঁশঝাড়, মৃত গরুমোষ। গরু মোষের ফুলে ফেঁপে ওঠা শরীরে বসে থাকত শকুন, কাক। এমন দুর্গতির দিন পেরিয়ে ধীরে ধীরে শিউলির গন্ধ আর সবুজ ঘাসে শিশিরের বিন্দু নিয়ে শরৎ আসত যেত নয়ন ভুলানো রূপ নিয়ে। তারপর একদিন বীরেন্দ্রকৃষ্ণর কন্ঠে “আশ্বিনের শারদ প্রাতে” বেজে উঠত রেডিওতে ভোর চারটেয়।

মহিষাসুরমর্দিনী শোনার জন্য আমরা সারা বছর উদগ্রীব হয়ে থাকতাম। শিলচর শহরের একটা মজার ব্যাপার ছিল, মহালয়ার ভোরে সারা শিলচরবাসী সেজেগুজে সদর ঘাটে বরাক ব্রীজের ওপর বেড়াতে যেতেন। সে কী উদ্দীপনা মহালয়ার ভোরে! সেই ট্রাডিশন এখনও চলছে। শিলচরে আমরা প্রথমে নদীর একেবারে পাড়ে জয়কুমার পাঠশালার সামনে থাকতাম। আমার বয়স তখন আট। সেই সময় ঐ পাড়ায় কোনো সর্বজনীন দুর্গাপূজা ছিল না। মালুগ্রাম ভৈরব বাড়িতে গিয়ে অঞ্জলি দিতেন সবাই। তারপর আমরা চলে আসি আর্যপট্টি আর রহমানপট্টির মাঝামাঝি জায়গায়, নদীর ধারে বাঁধের পাশে একটি বাড়িতে। আর্যপট্টি দুর্গাবাড়ির পুজো ছিল কাছেই। ষষ্ঠীর দিন খুব অপেক্ষা থাকতো কখন দেবীর মুখের ঢাকা খোলা হবে। ঢাকের আওয়াজ শুনে ভাইবোনেরা মন্ডপে ছুটে যেতাম। আমরা পুজোয় অঞ্জলি দিতাম তিনদিনই। পশ্চিমবঙ্গে এসে দেখি এখানে সবাই অষ্টমীর দিনেই অঞ্জলি দেন। কিছু ব্যতিক্রম আছে যদিও। পুজোর মন্ডপে বাচ্চারা বন্দুক ফাটাতো, ওটা আমার ভারি ভয় করত। দুর্গা বাড়ির পুজোয় যেতাম প্রতিদিনই কিন্তু সেখানে আমাদের নেহাতই দর্শকের ভূমিকা ছিল। পুজোর আয়োজনে আমাদের কোনো ভূমিকা ছিল না। তাই হয়তো নিজেকে রিলেট করতে পারতাম না। কেমন একটা দূরত্বের অদৃশ্য বেড়া থাকত। পুজোয় যেমন পাড়ার বাচ্চারা হইহই করে, পদ্মফুল ফোটায় সেই অভিজ্ঞতা হয়নি কখনো। অথবা হয়ত আমার স্বভাবেই কোথাও একটা বিষণ্ণতা কাজ করত, যে কারণে সেই দূরত্বটুকু আর পার করা হয়ে ওঠেনি কোনোদিন। তবে দুর্গাবাড়ির পুজোর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীর প্রতি রাতে মঞ্চ-নাটক। নাটক শুরু হত রাতের দিকে, খুব সম্ভবত সাড়ে নটা দশটায়। খেয়ে দেয়ে উঠে আমরা ভাই-বোনেরা বাবার কাছে নাটক দেখতে যাবার অনুমতি চাইলে বাবা সরাসরি নাকচ করে দিতেন। শেষটায় মাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আমরা যেতাম, কিন্তু আধঘন্টা বা একঘন্টার জন্য। তাই একটি নাটকও পুরো দেখার সৌভাগ্য হত না।

দশমীর দিন বা তারপরদিন বিচিত্রানুষ্ঠান হত, সেখানে শহরের নামী গায়কেরা আসতেন। চেংকং কাবুই, প্রসেনজিৎ ফাংচু, অঞ্জন দেব এরা সব আসতেন। দশমীর দিন বিকেলে চাল বেটে দুয়ারে, বারান্দায় আলপনা দিতাম। এই কাজটি করতে খুব ভালো লাগত। আর ভালো লাগত নবমীর রাতে মায়ের পাশে বসে কুচি নিমকি বানাতে। ময়দা মাখাটাকে গোল পরটার মত বেলে নিয়ে ছুরি দিয়ে বরফির আকারে কাটতে খুব আনন্দ হতো। 

সন্ধ্যায় ভাসান দেখতে যেতাম সদরঘাট ব্রীজের ওপর। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। ঝলমলে আলোয় আলোকিত সদরঘাটে দেবীর নিরঞ্জন বরাকব্রীজের ওপর থেকে দেখতাম। বরাকের জলে ভেসে ভেসে মা পৌঁছে যাবেন কৈলাশ পর্বতে, যেখানে ভোলানাথ পথ চেয়ে বসে আছেন। রাত আটটা সাড়ে আটটার সময় বাড়ির দিকে ফেরার সময় বাবার অবধারিত মন্তব্য বা আদেশ “নাও অনেক হলো, কাল সকাল থেকে পড়তে বস।” পরদিন সকালে উঠে সাদা কাগজে একশো আটবার শ্রী দুর্গায়ৈ নমঃ লিখে, পড়তে বসতে হত। এরইমধ্যে পাড়ার কাকিমা, মাসীমাদের বাড়ি গিয়ে প্রণাম করে নারকেল নাড়ু, কুচিনিমকি, ঘুগনি খেয়ে পুণ্যঅর্জনের গুরুদায়িত্ব তো ছিলই। দুদিন বিজয়া করতে করতেই হইহই করেএসে যেত লক্ষ্মীপুজো। সে গল্প আরেক দিন…..

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!