বিবেকানন্দ মোহন্ত
-এক-
সাত-আট বছর বয়স পেরোনো সদ্য বিধবা কুসুমকে পিত্রালয়ে নিয়ে এসেছিলেন ভাইয়েরা ; মায়ের আদেশ — “তাকে লেখাপড়া শিখিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করো।” মাতৃআজ্ঞা পালন করেছিলেন বড় ভাই, পেশায় স্কুল শিক্ষক।যথারীতি কুসুমও শিক্ষাদীক্ষা করে পাঠশালার চাকরি পেয়ে যান, সেটা বিগত চল্লিশের দশকের মাঝা-মাঝি সময়ের কথা। বিধবা বিবাহের প্রচলন এইসব অঞ্চলে ছিলনা এবং এ ভাবনাকে মনে ঠাঁই দেননি কুসুম কিংবা তাঁর পিতৃকুলও।এই কুসুম কুমারীই আমাদের পিসিমণি, আমাদের পাঠশালার দিদিমণি এবং দিয়েছিলেন আমাদের “হাতেখড়িও”। তাঁর অন্তরঙ্গতা ছিল সুশীলা বৈষ্ণবীর সাথে, তাঁকে আমরা শ্রদ্ধা করতাম এবং নিজের আপন মাসি বলেই জানতাম। বাল্যবিধবা সুশীলা “রাধাকৃষ্ণের” শ্রীচরণে আত্মনিবেদন করে ইহলোকের বাকি জীবনটা কাটিয়ে গিয়েছিলেন।
এই সুশীলা মাসিই একদিন পিসিমণিকে এসে বললেন — “চলো রংপুর ঘুরে আসি, তোমার কাছে নতুন জায়গা, ভালো লাগবে”। ফি বছরের ছুটি-ছাটায় ভ্রমণে বেরোতেন পিসিমণি, সাথে বাড়ির ছোটোদের মধ্যে একজন বা দু’জন থাকত এবং বলাবাহুল্য সেই একজনের লিস্টে আমার নামটি অবশ্যই থাকত। সেই সুবাদে ঘুরেছি অনেক দেখা-নাদেখা জায়গায়, আত্মীয়-অনাত্মীয় পরিসরেও।
সুশীলার অনুরোধে রাজি হয়ে গেলেন পিসিমণি,সহচর আমি। সেটা ১৯৬৮-৬৯ সালের কথা, তখন আমার বয়স আর কত — মেরেকেটে বছর সাত/আট হবে।
এক সকালে রামকৃষ্ণনগরে ‘নাকওয়ালা’ বাসে গিয়ে উঠলাম, থার্ড-এ নয় — আপারে। কাঁকড়, ছোটো-বড় পাথর মেশানো মেঠো পথ ধরে ঝাকুনি দিয়ে দিয়ে পথ চলতে গিয়ে মাঝে মধ্যে বাসটি থামছিল চওড়া কোনো জায়গায়। বিপরীত মুখী গাড়ি এই ক্রশিং পয়েন্টে এসে আধখাওয়া বিড়িটি ধরিয়ে দিচ্ছে বাসচালকের হাতে, এ সুখটান মনে হলো বেশ রোমাঞ্চকর!
এভাবেই ঘন্টা দু-এক চলার পর এসে পৌঁছলাম টার্মিনাল স্টেশন নিভিয়াতে। সেখানে বড় বটগাছটার চারপাশ ঘিরে পাতানো রয়েছে কাঠের বেঞ্চ্ (জানিনা আজও সেটা আছে কি-না), আমরা তিনজন এখানে বসে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিলাম। এই অবসরে পিসিমা ও তাঁর বান্ধবী বেতের ঝাঁপি খুলে বসলেন, ঘর থেকে নিয়ে আসা উপাদান সহযোগে আমরা ফলাহার সারলাম। আমার জন্য উপরি পাওনা হিসেবে বরাদ্দ হলো এক গ্লাস হোয়াইট, সাথে এক প্যাকেট ‘রাধাবিস্কুট’।
এবার আঁকা-বাঁকা পাহাড়ি পথ ধরে শুরু হলো আমাদের পদযাত্রা। কিলোমিটার দশেক চলার পর এক জায়গায় দেখলাম হাতির পায়ে লোহার শেকল পরিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে একটি গাছের সাথে, মাহুতের সপাং সপাং বেত্রাঘাতে জর্জরিত হয়ে আর্তনাদ করছিল বেচারা হাতিটি। পথচলতি দু-একজন লোক ছিল, ওরা বলল এটাই দস্তুর, পোষ মানানো হচ্ছে। আমার কিন্তু সেটা সহ্য হয়নি, মনে হচ্ছিল মাহুতটির পিঠে দু’ ঘা বসিয়ে দিই! জায়গাটির নাম চেরাগি, অরণ্যঘেরা ছোট্ট এক জনপদ।
যাই হোক আমাদের পথচলা আবার শুরু হলো। পিসিমণিকে বললাম – “আর কতদূর?”, সুশীলা মাসি অভয় দিলেন – “এই তো রংপুর এসে গেছি, আর একটু জায়গা।” এভাবেই আরও বেশ কয়েক কিলোমিটার হেঁটে যাওয়ার পর এক বাজারে এসে পৌঁছলাম, নাম রংপুর। বিচিত্র লোকের সমাহার! বাহারি বেশভূষায় সজ্জিত উপজাতি মেয়েলোক, বিশাল বিশাল কর্ণাভরণে এদের কানদুটি বুঝি ছিড়ে যাওয়ারই উপক্রম, গলায় মানানসই নেকলেস, যেখানে বড় বড় আকারের রূপালী মুদ্রা ছাড়াও রয়েছে ছোটো বড় মাপের অজস্র কড়ির সমাহার! জুমের ফসল ছাড়াও তারা ঘরে প্রস্তুত করা দ্রব্যসামগ্রী নিয়ে পশরা সাজিয়ে বসেছে রংপুরের এই হাটে। বাজারটি দেখে মনে হলো এটি বহুভাষিক, বহুধর্মীয় এবং বহুমাত্রিক এক মিলনমেলা, যেখানে টিপরা, লুসাই, হিন্দুস্থানী লোক ছাড়াও আসছে “ঝঞ্ঝাবিধ্বস্থ ঝড়ের পাখিরাও।”
এবার আমাদের আরও এগোনোর পালা। বাজার ছেড়ে শাল-সেগুনের ফাঁকে ফাঁকে কিছুদূর চলার পর খরস্রোতা সিংলা নদি, পারাপারের জন্য রয়েছে আড়াআড়ি ভাবে পেতে রাখা লম্বা গাছের খুব পিচ্ছিল এক খাড়ি, বাঁশের হাতল, কাত হয়ে ধরে ধরে কোনোক্রমে ওপারে পৌঁছোনোর ব্যবস্থা, পা হড়কালেই নির্ঘাত ত্রিশ-পয়ত্রিশ ফিট নীচে গিয়ে পড়া! দুরু দুরু বুকে কোনোক্রমে এই পরীক্ষাটা পাশ করলাম।এবার গহীন অরণ্য ভেদ করে চড়াই-উতরাই পথ বেয়ে শুরু হলো আমাদের দীর্ঘযাত্রা। পথে দেখা হলো মুমূর্ষু এক রোগীকে মাচায় বয়ে নিয়ে নেমে আসা হচ্ছে ঢালু পথ বেয়ে, খুব সন্তর্পণে। কাছে আসার পর সুশীলা মাসি এদেরকে চিনতে পারলেন। জিজ্ঞেস করে জানা গেল, স্থানীয় কবিরাজ জবাব দিয়ে দিয়েছেন, এবার ভরসা দুল্লভছড়ার ডাক্তার, পুরো পথই বয়ে নিয়ে যেতে হবে, পরমায়ু থাকলেই শুধু বেঁচে ফিরে আসতে পারেন! যেতে যেতে মাসি বললেন এখানকার অবস্থাটা এমনই, আমার মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল অন্য কথা– যে সাঁকো আমরা পেরিয়ে এসেছি, আদৌ কী তারা এই অবস্থায় নির্বিঘ্নে সেটা পেরোতে পারবেন!
পড়ন্ত বিকেলে আমরা এসে পৌঁছলাম সংরক্ষিত বনাঞ্চল এলাকায় ভিটেহারাদের অর্বাচীন এক ছোট্ট জনপদ কালামাগুরায়। নিভিয়া-অলিভিয়াছড়া অতিক্রম করে করিমগঞ্জ মহকুমার প্রায় সর্বদক্ষিণ প্রান্তবর্তী এই এলাকা, যেটি ১৮৬২-৬৮’র সার্ভে অনুযায়ী সংরক্ষিত বনভূমি হিসেবেই মানচিত্রে প্রদর্শিত হয়েছে।এখানে চোখে পড়ল পাহাড়ের শীর্ষদেশে বিচ্ছিন্নভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে একেকটি কুড়েঘর, থেকেছিলাম দিনকয়েক।
কালামাগুরা সফর শেষে পশ্চিমদিকে কয়েক কিলোমিটার পাহাড়ি পথ ধরে এগোলে চোখে পড়বে একে একে ছোটোবালিয়া, বড়বালিয়ার উদ্বাস্তু পরিসর। ছ’সাত দিন কাটিয়েছিলাম এদের ঝুপড়িতে, যেখানে প্রতিনিয়ত তাদের দিন গুজরানের কঠিনতম পরিস্থিতির সাক্ষী হয়েছিলাম। এখানকার পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে সংকীর্ণ কৃষিভূমি, বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। বন্য জীবজন্তুদের সাথে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে দিন কাটানোর নির্মম চিত্রটিও উপলব্ধ হয়েছিল,দেখেছিলাম রাতবিরেতে ক্যানেস্তারা পিটিয়ে বন্য শূকর কিংবা হাতির তাণ্ডব থেকে ফসল বাঁচানোর আপ্রাণ প্রচেষ্টা। এতগুলো অঞ্চল পরিক্রমা করেও চোখে পড়েনি প্রাথমিক শিক্ষাঙ্গনেরও কোনো স্বাক্ষ্য।স্বাস্থ্য পরিষেবার তেমন কোনো বালাই নেই, ভরসা – দূরগাঁয়ের বদ্যি, কবিরাজ কিংবা হাতুড়ে চিকিৎসক!
সুশীলা বৈষ্ণবী মাসির পরিচিত ঐ জায়গাগুলোতে রয়েছে দু’একটি ছোটোখাটো আখড়া -দেবালয়; নিস্তরঙ্গ অরণ্যভূমে ‘জীবন খোঁজে নেবার’ অন্বিষ্ট পরিসর, এবং অবলম্বন যেগুলো তাঁদের যুগিয়ে যাচ্ছে বেঁচে থাকার অক্সিজেন।
-দুই-
ধর্মনগর থেকে মামাতো ভাই আমাদের রামকৃষ্ণনগরের বাড়িতে এসেছেন, যাবেন পিঁয়াজগুটির অরণ্যে। সুনামগঞ্জ মহকুমার ভাগ্যবিড়ম্বিতদের সরকার প্রদত্ত আশ্রয়স্থল এই পিঁয়াজগুটি। জগন্নাথপুর থানা অঞ্চল থেকে সেই কবে মাত্র আট বছর বয়সে (বিগত শতকের ১৯২৫-৩০ সাল নাগাদ) রামকৃষ্ণনগর (কালীনগর) জনপদে মাস্টার মশাইর গৃহিনী হয়ে এসেছিলেন আমার মাতৃদেবী। তাঁরই শৈশবের খেলার সাথীদের বর্তমান আবাসস্থলে আজ যাচ্ছে ভাইপো! সুতরাং তিনি উথলা হয়ে উঠলেন, যাবেন সেখানে। পর্বতসংকুল গহীন গিরিপথ ডিঙ্গিয়ে ওখানে যাওটা যে খুবই দুষ্কর, সে কথা বুঝিয়েও বিশেষ কোনো লাভ হলোনা।সুতরাং যাওয়া স্থির হলো, আমার ভাগ্যেও শিখে ছিড়লো, বয়সই বা কত – মেরেকেটে সাত/ আট হবে।
এক সকালে বাসে করে আমরা আনিপুর অবধি গিয়ে নেমে পড়লাম, এবার হাঁটার পালা। এ পর্যায়ে আনিপুর চা-বাগিচা পেরিয়ে শুরু হলো অরণ্য সংকুল চড়াই-উতরাই, আঁকা-বাঁকা গিরিপথ। প্রায় কিলোমিটার চারেক পেরোবার পর পেলাম সংকীর্ণ এক উপত্যকা, বাঁদিকে বেশ কিছু জায়গা জুড়ে রয়ছে জলাভূমি তারপর খাড়াই পাহাড়, ঘন জঙ্গলে আবৃত এলাকায় রয়েছে রামকলার ঝাড়। অপরদিকে, উপত্যকার ডানপাশে, যে পথ ধরে আমরা চলছি, সেটি পাহাড়ের ঢালু অঞ্চল।চোখে পড়লো জলাভূমির ওপারের কলাবাগান উজাড় করে চলছে পঁচিশ-তিরিশটি হাতি,দূর থেকে আমাদের দেখে শূড় উঁচিয়ে গগনভেদি চিৎকার দিতে শুরু করল। হস্তীযূথের এরূপ অভ্যর্থনায় আমরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পালাতে শুরু করলাম। এভাবে কিলোমিটার খানেক দৌড়োবার পর বুঝতে পারলাম যে আমরা এবার নিরাপদ, তাই একটু জিরিয়ে নিয়ে পাহাড়ি পথ ধরে আবার হাঁটা শুরু করলাম। এভাবে আরও কয়েক কিলোমিটার হেঁটে আমরা এসে পৌঁছেছিলাম ছোট্ট মালভূমি সদৃশ এক পাহাড়ের শীর্ষদেশে।আমলকি ছায়াঘেরা এই জায়গায় রয়েছে গুটিকয়েক কুড়েঘর – একটু বিসদৃশ বৈকি! এমনটি আর কোথাও দেখিনি। এখানে প্রতিটি ঘরের বেড়ার বাইরে গায়ে গা লাগিয়ে রয়েছে আস্ত বাঁশের আরেক প্রস্ত দেয়াল, ছনের চালা এবং বাঁশের খিড়কীগুলো চালের গা ছুঁই ছুঁই। প্রতিটি ঘরের ভিতরে পার্টিশন দিয়ে মানুষ-গরুর সহাবস্থানের ব্যবস্থা! প্রতিটি ঘরের বাইরে এবং উঠোনেও টাঙ্গানো রয়েছে কেরোসিনের টিন-কেনেস্তারা। পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে এক চিলতে কৃষিভূমি-আশ্রিতদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।এখানে জলের প্রয়োজনে নামতে হয় পাহাড়ের খাড়াই ঢালু বেয়ে একেবারে পাদদেশে, যেখানে বয়ে চলেছে শীর্ণকায়া এবং ক্ষীণস্রোতা জলধারা। যে ঘরে আমরা গিয়ে উঠেছিলাম, সেখানে আমার সমবয়সী একটি ছেলেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ঘরগুলো কী কারণে এরকমভাবে তৈরী করা হলো? উত্তর পেয়েছিলাম — ‘একরাত থাকো, তখন বুঝতে পারবে’।
খেয়ে দেয়ে শোবার পর রাতদুপুরে অক্ষরে অক্ষরে ছেলেটির কথার অর্থ টের পেলাম। ঘরের বাইরে বাঘের উপদ্রব শুরু হলো, সাথে হাড় হিম করা গর্জন, বেড়ার গায়ে ঘন ঘন নখের আঁচড় ! ওদিকে গৃহকর্তা প্রাণপণ ঘরের ভিতর থেকে রশি টেনে চলছেন-যার সাথে জুড়ে দেওয়া বাইরের কেনেস্তারাগুলো ঘড়াং-ঘড়াং শব্দে বেজে চলছে। অপরাপর কুড়েঘর থেকেও একই কসরত চলছে। একসময় বিরক্ত হয়েই শার্দুলের প্রস্থান ঘটলো এবং আমরাও প্রাণ ফিরে পেলাম!
সেই রাতে সমবয়সী ছেলেটি আমার সাথেই শোয়েছিল। কাকভোরে ঘুম থেকে জেগে উঠে ছেলেটি বাঁশের সিড়ি বেয়ে উপরের খিড়কী একটু ফাঁক করে কিযেন দেখছিল, তার ইশারায় আমিও তাকে অনুসরণ করে দেখলাম “আমলকি তরুতলে/মৃগ ফেরে দলে দলে”, কী অপূর্বই না সে দৃশ্য! চোখ জুড়িয়ে গেলো।ওরা আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে এক নিমেষেই দৃষ্টির বাইরে চলে গেলো! এই অনুপম দৃশ্য রাতের প্রাণান্তকর পরিস্থিতিকে খানিকটা ভুলে যেতে সাহায্য করেছিল।
দিন পাঁচেক এই অরণ্যভূমিতে থেকেছিলাম এবং উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম বাস্তুহারাদের জীবনযুদ্ধের প্রকৃত স্বরূপ।
এখানে উল্লেখ্য যে, গত পঞ্চাশের দশকে পুনর্বাসিত এই দুই পরিসরে আমার যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল ষাটের দশকের শেষ পর্বে। শৈশবের সেই স্মৃতিটুকু আজও মনে পীড়া দেয়।এই ঝঞ্ঝাবিধ্বস্থ বাস্তুহারাদের আদিনিবাস সমতল সিলেটে, যেখানে নদি-নালা, বিল-হাওরে সাজানো বিস্তীর্ণ পরিসরে তিলে তিলে গড়ে উঠেছিল তাঁদের সহস্র বছরের সমতলীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি। রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক চরম প্রতিকূল পরিস্থিতি তাঁদের করেছিল বাস্তুহারা-ভিটেহারা, গায়ে সেটে দিয়েছিল শরণার্থীর তকমা। রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পেয়েছিলেন এপারে এসে এবং পুনর্বাসিত হয়েছিলেন অরণ্য ভুবনের গহীন গিরিকন্দরে।
শহরকেন্দ্রিক নাই বা হলো, গঞ্জকেন্দ্রিক কিংবা নিদেনপক্ষে যোগাযোগ ব্যবস্থার লভ্য পরিসরের প্রতিবেশী এলাকায় কী তাঁদের ঠাঁই দেওয়া যেত না? এইসব ছেড়ে দিলেও, তাঁদেরকে যেখানে ঠাঁই দেওয়া হয়েছিল সেখানে জীবনধারণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা, যোগাযোগ ব্যবস্থা,স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিক্ষাদীক্ষার ন্যূনতম সংস্থানও কী ওদের প্রাপ্য ছিলোনা?
দেখা যায় এক একটি বিশাল পরিসর নিয়ে উনিশটিরও বেশি চা-বাগিচা রয়েছে রাতাবাড়ী থানা এলাকায়, যাদের হাতে পড়ে রয়েছে লিজকৃত হাজার হাজার একর ভূমি, পাহাড় -সমতল মিলিয়ে যার সিংহভাগই অনাবাদি পতিত ক্ষেত্র। সিলিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমেও তো তাঁদের পুনর্বাসন দেওয়া যেত, যার দৃষ্টান্ত তেমন কোনো বিরল ব্যাপার নয় এই উপত্যকার আনাচে-কানাচে। সিলিং টিলা, সিলিং গ্রান্ট কিংবা আপিন গ্রান্ট এই নামগুলো আমাদের কাছে অচেনা নয়।
বিভাগোত্তর পর্বে অনেক নামী-দামী ব্যক্তিত্বের পদরজে প্লাবিত হচ্ছিল এই উপত্যকার উদ্বাস্তু পরিসর; কিন্ত সেটির সীমাবদ্ধতা ছিল শহর কিংবা গঞ্জঘেষা উন্নত/উন্নয়নশীল এলাকা অবধিই। সার্বিক ঔদাসিন্যেই গহীন অরণ্যের নিভৃত ভুবনের জনগন আজও হয়তো জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার ‘জীওন কাঠির’ সুলুক সন্ধান করে চলছেন নিরন্তর, হয়তো বা ছুটে চলছেন স্বপ্নের ফেরিওয়ালাদের পেছন পেছন।
এমন নির্মম বাস্তবতার চিত্র এঁকে বিবেকানন্দ আমাদের চোখের সামনে নতুন জগৎ হাজির করলেন। এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকেও বুঝি উচ্ছেদ করার ফন্দি ফিকির হচ্ছে এখন কে জানে!