কল্পার্ণব গুপ্ত
বাঙালি মূলত মধুর রসের উপাসক। তাই মায়ের মধুরূপিণী এবং ভয়ঙ্কর মূর্তির মিশ্রণ থেকে সে তার সহজাত প্রবণতাবশে মধুরূপিণী মাকেই বেছে নিয়েছে। শাস্ত্রকার ব্রাহ্মণ পন্ডিত মার্কন্ডেয় “চণ্ডী” মাহাত্ম্য কীর্তন করেন এবং দেবী দুর্গাকে পৌরাণিক অসুরনাশিনী রণরঙ্গিণী দেবী রূপেই দেখতে চান। কিন্তু বাংলার জনমানস মার্কণ্ডেয় চণ্ডী এবং এই রণরঙ্গিণী দেবীর ধার ধারে না। তারা স্থির নিশ্চয়ে জানে, ব্যাপার আর কিছুই নয়, এ তো আমাদের উমা মায়ের স্বামীগৃহ কৈলাস থেকে পুত্র কন্যা নিয়ে বাপের বাড়ি আগমন।তিন দিন বাপের বাড়িতে আনন্দ-উৎসব, তারপর আবার চোখের জলে ভাসিয়ে বিজয়া – মায়ের পুনরায় স্বামীগৃহে প্রত্যাবর্তন। এই সহজ সত্যকে অবলম্বন করেই “আগমনী-বিজয়া” সঙ্গীতের উদ্ভব।
তাই দাশরথি রায়ের পাঁচালিতে আমরা দেখতে পাই মেনকা দশভুজা রণরঙ্গিণী দেবীকে কন্যা হিসেবে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। তিনি স্পষ্টই বলেন —
কৈ হে গিরি, কৈ সে আমার প্রাণের উমা নন্দিনী !
সঙ্গে তব অঙ্গনে কে এলো রণরঙ্গিণী ?
এই রণরঙ্গিণীকে মেনকা এবং তার মারফতে বাঙালি চিনতে পারে না ।কারণ তার মানসপটে উমার মূর্তি তো এইরূপ —
দ্বিভুজা বালিকা আমার উমা ইন্দুবদনী ,
কক্ষে লয়ে গজানন, গমন গজগামিনী,
মা বলে মা ডাকে মুখে আধ-আধ বাণী ।
রসিকচন্দ্র রায়ের গানেও দেখি মেনকা এই অভিনব নারীকে চিনতে পারেন নাই।
গিরি, কার কণ্ঠহার আনিলে গিরিপুরে?
এ তো সে উমা নয় – ভয়ঙ্করী হে, দশভুজা মেয়ে!
মুখে মৃদু হাসি, সুধারাশি হে, আমার উমাশশীর;
এ যে মেদিনী কাঁপায় হুঙ্কারে ঝঙ্কারে।
হায় এ হেন রণ-বেশে, এল এলোকেশে,
এ নারীরে কেবা চিনিতে পারে!
শুধু অসুরনাশিনী দুর্গা-দেবী নয়, ভয়ঙ্করী-রূপের চরম নিদর্শন যে কালীর মধ্যে তিনিও বাঙালি কবিগণের রচনার গুণে মধুর রসে প্রতিষ্ঠিতা হয়ে উঠেছেন। সে আলোচনা নাহয় অন্যদিন হবে।
এই সব কথা বলার একটি রাজনৈতিক তাৎপর্য আছে। আমরা জানি বর্তমান ভারতে হিন্দুত্বের নাম করে একটি রাজনৈতিক দল হিন্দুধর্ম এবং হিন্দুদের সশস্ত্রীকরণের এজেন্ডা নিয়ে মাঠে নেমেছে। তাদের সাধনা বাঁশি ফেলে অসি তুলে নেওয়ার। প্রেম কিংবা সম্প্রীতি নয়, হিংসা এবং সাম্প্রদায়িকতার বেসাতি করে তারা। এই পরিস্থিতিতে উপরের তথ্যগুলো কাউন্টার নেরেটিভ তৈরি করার কাজে লাগলেও লাগতে পারে ।
ঋণস্বীকারঃ
ভারতের শক্তিসাধনা ও শাক্ত সাহিত্য – শশিভূষণ দাশগুপ্ত।
( এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত সম্পূর্ণ লেখকের। )