বিবেকানন্দ মোহন্ত
প্রস্তাবনা:-
নদীমাতৃক বরাক উপত্যকায় বর্ষাকালীন বন্যা পরিস্থিতি তেমন কোনও অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। অত্যধিক ধারাবর্ষণে বরাক যেমন ফি-বছরে তার তাণ্ডব দেখিয়ে যায়, ঠিক তেমনি কোনও না কোনও সহায়িকাও তার স্বরূপ চিনিয়ে দিতে তেমন কোনো কসুর করেনা। ফলে কখনও বরাক, তো কখনও ধলেশ্বরী-কাটাখাল, কিংবা কখনও লঙ্গাই-সিংলার জলপ্রবাহ সংশ্লিষ্ট অববাহিকা অঞ্চলকে প্লাবিত করে যায়। কিন্তু এবারের প্রলয়ঙ্করী বন্যা সাম্প্রতিক অতীতের সবক’টি রেকর্ডকেই যেন ম্লান করে দিয়ে গেল। চতুর্দিকেই হাহাকার পরিস্থিতি, কুড়েঘর থেকে শুরু করে বহুতলবিশিষ্ট অট্টালিকাবাসী কেউই রেহাই পাননি বরাকের করালগ্রাসী রূপ থেকে। ফলে স্তব্ধ হয়ে পড়ে রেলপথ ও সড়কপথ, স্তব্ধ হয়ে পড়ে পানীয়জল ও বিদ্যুৎ পরিষেবা। এবং সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা সহ আন্তর্জাল পরিষেবাও। এবারের বন্যা সমগ্র বরাককে প্লাবিত করলেও তার প্রভাব সবচাইতে বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে উপত্যকার প্রাণকেন্দ্র শিলচর শহরে।
জুন ২০ তারিখ থেকেই বহির্জগতের সাথে একপ্রকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল শহর শিলচর। তাই ক’দিন থেকেই মনটা আনচান করছিল বানগ্রস্ত শহর শিলচরের স্বজন-সুহৃদদের একটু খোঁজখবর নিই, কিংবা একটু পাশে গিয়ে দাঁড়াই। পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হওয়াতে রেল পরিষেবা শুরু হচ্ছে ২৭ তারিখ থেকে, এই খবরটা শুনার পর মনস্থির করে ফেললাম যে, ঐদিনই শিলচরের পরিস্থিতি দেখে আসব। সুতরাং, পুত্র রাজর্ষিকে নিয়ে করিমগঞ্জ রেলস্টেশনের দিকে রওয়ানা হই সকাল ন’টা নাগাদ। সেদিন শিলচরের খণ্ডচিত্রের সাথে যেটুকু পরিচয় ঘটেছিল, তা নিয়েই আজকের এই দিনলিপি।
এক:-
করিমগঞ্জ রেলস্টেশনে গিয়ে দেখলাম আমাদের মত আরও জনাকয়েক যাত্রী দাঁড়িয়ে রয়েছেন, ট্রেন চলাচলের কোনও নিশ্চয়তা নেই। কাউন্টারে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম যে, মহিশাসন থেকে গাড়িটি ফিরে আসার পর আলাপ-আলোচনায় স্থির হবে – সেটি আদৌ শিলচর যাচ্ছে কী না, কারণ রাস্তায় স্থানে স্থানে ট্র্যাকের নীচ দিয়ে বইছে বন্যার জল। যাইহোক, মিনিট পঁয়তাল্লিশ অপেক্ষার পর ট্রেনটি স্টেশনে এলো এবং স্থির হলো যে সেটি যাবে গন্তব্যে। আমরাও হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
যাত্রাপথে পাঁচগ্রাম-কাটাখাল স্টেশনের মাঝামাঝি অংশ থেকেই দেখা গেল বন্যার জলস্তর রেললাইনের গা ছুঁই ছুঁই অবস্থা! কোথাও বান-সলিলে অর্ধ-অবগুণ্ঠিত লৌহবর্ত্ম বেয়ে খুব ঝুঁকি নিয়ে চলছিল ট্রেনটি, যেন নববধূর পদক্ষেপের মতনই তার মন্থর গতি। রেলপথের ডানে-বামে উত্তাল জলরাশি, কাছে-দূরের ঘর-বাড়ি গুলোর চালের উপর অব্ধি ডুবে রয়েছে বন্যার জলে। কোথাও টিনের চালের উপরের অংশমাত্রই দেখা যাচ্ছে। ঐসব বানাক্রান্ত অঞ্চলের অধিবাসীদের এখন ঘরবসতি কাটাখাল রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্ম এবং আশপাশের দীর্ঘ পরিসর। স্টেশনের দুই পাশ জুড়েই রয়েছে তাদের সারি সারি ঝুপড়ি। পলিথিনের ছাউনিতে গড়ে ওঠা বানপীড়িতদের ঘরবসতির সাথে রয়েছে তাদের গৃহপালিত হাঁস-মুরগী, গরু-ছাগল মায় কুকুর-বিড়ালও। কেউবা জল-কাদার মধ্যেই উনুনে চেপে রান্নার আয়োজন করছেন, কেউবা পাথর-ব্যালাস্টের স্তরের উপর। ভাগ্যবান কেউ কেউ আবার দীর্ঘ প্ল্যাটফর্মের ফ্লোরে ঠাঁই নিয়েছেন। কয়েজনকে দেখলাম ঘর থেকে নিয়ে আসা তক্তাপোষে আসন পেতে বসে দ্বিপ্রাহরিক ভোজন সারছেন। এই চৌকির এক পাশে রয়েছে তাদের তোষক-বালিশ, বিছানা-পত্তর। এই ঝুপড়িঘেরা অস্থায়ী পাড়ায় রয়েছে বানভাসিদের গোটাকয়েক ‘বাণিজ্য-বিপণিও’। এখানে নিত্য-নৈমিত্তিক প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী ছাড়াও রয়েছে মুখরোচক প্যাকেটজাত খাবার-দাওয়ার, যার মধ্যে আছে লেইজ, কুরকুরি, ভুজিয়া-ডালমুট, চকোলেট ইত্যাদি। এবং, রয়েছে পান-তাম্বুলের পশরাও। এখানে শাঁখা-পলা, তুলসীমালা গলে বানপীড়িতরা যেমন রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন লুঙ্গি-তকী পরিহিত ফেরেশতারাও। সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদকে দুরমুশ করে দিয়ে পারস্পরিক সহাবস্থানের এক অনন্য নিদর্শন বানাগ্রস্ত-আশ্রিতদের এই ঘরসংসার। এখানে নেই কোনো অদৃশ্য কাঁটাতারের বিভাজনরেখাও। যেন এক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মহামিলনক্ষেত্র, যার প্রেক্ষাপট তৈরি করে দিয়ে গেল এবারের প্রলয়ঙ্করী বন্যা! একই চিত্র উপলব্ধ হল পরবর্তী শালচাপড়া কিংবা অরুণাচল স্টেশনেও।


দুই :
বানভাসি শিলচরের পথে পথে :
করিমগঞ্জ থেকে যাওয়ার সময় পানীয়জল এবং অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রী অল্প-বিস্তর সঙ্গে নিয়েছিলাম। এবার শিলচর রেলস্টেশনে নেমে বুঝলাম, নেই রাজ্যে বুঝি এসে পড়েছি! তারাপুরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ঘুরে টুকিটাকি জিনিস সংগ্রহ করতে গিয়ে কালঘাম ছুটেছিল। যাইহোক কোনোক্রমে সেটুকু যোগাড় করে গলিপথ ধরলাম। সেপথে মিটার পঞ্চাশেক এগোনোর পরই খেয়াঘাট ! এখানে ঘনকৃষ্ণকালো জলে দাঁড়িয়ে রয়েছে সারি নৌকো, মনে হল কোনও নৌপথের খেয়াঘাটে বুঝি পা-রেখেছি! এসবের ফাঁকে রয়েছে গোটাকয়েক ভেলাও। এগুলো চিরাচরিত কলাগাছের ভেলা বা ভোরার বিবর্তিত রূপে এখানে হাজির থার্মোকল নির্মীত জলযান। যাইহোক, রাজর্ষিকে নিয়ে একটি ছোটখাটো নৌকোয় চেপে বসলাম, গন্তব্য-বিবেকানন্দ রোড। ভাড়া স্থির হল দুশো টাকা। নৌকোর আগে-পিছে দু’জন মাঝি, চান্দমারির গলিপথ ধরে চলতে গিয়ে দেখলাম ডানে-বামে-পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সারি সারি বহুতল ভবন। অধিকাংশ ভবনেরই গ্রাউণ্ড ফ্লোর প্রায় দরজার উপর পর্যন্ত জলের তলায়। প্রতিটি ভবন থেকেই ঝুলছে বাজার ব্যাগ, কোথাও মাঝারি মাপের প্লাস্টিকের বালতি। হকাররা কালো নোংরা জলে এক বুক অবধি ডুবে, ভেলায় করে নিয়ে আসা নিত্য-পণ্য সামগ্রী তুলে দিচ্ছে ঝুলে থাকা এই ব্যাগ কিংবা বালতিতে। উপর থেকে ক্রেতা মূল্য চুকিয়ে দিচ্ছেন এরূপ ট্র্যান্সপোর্টেশনের মাধ্যমেই। পথে যেতে যেতে দেখলাম এক প্রৌঢ় তার পুত্রকে নিয়ে আম-আনারস বোঝাই ভেলা টেনে চলছেন বুকজল ভেঙ্গে। হাঁক পাড়ছেন – “আনারস চাই -আনারস?” জিজ্ঞেস করে জেনে নিলাম দরটা, তেমন আহামরি কিছু নয়, জোড়াপ্রতি ৬০টাকা মাত্র। মনে হল যতটুকু কায়ক্লেশ স্বীকার করে এবং নোংরা জল মাড়িয়ে অট্টালিকাবাসীদের রসনাতৃপ্তিদানে তাদের এই হাঁড়খাটুনি, তার বিনিময়ে রেট্টি একেবারেই নগণ্য। যেতে যেতে মনে হল এই হতদরিদ্র পিতা-পুত্র জীবনযুদ্ধে নেমে কী কঠোর পরিশ্রমই না করে চলছেন! জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, তপোবন নগরের বানভাসি এই পরিবার চার্চ রোডস্থিত ওরিয়েন্টাল স্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন।




বিবেকানন্দ রোডে এসে আরও বিপদ্জনক অবস্থার মধ্যে পড়লাম। ছ’মাস ধরে গোটা সড়কের বাঁ-পাশ বরাবর গভীর খাল কেটে রাখা হয়েছে, গড়ে উঠবে মাস্টার ড্রেন কাম ফুটপাত। তারই রডের জালি মাথা উঁচু করে রয়েছে, কোথাও জলের তলায় ডুবে রয়েছে, আবার কোথাও জলস্তর থেকে ৬/৮ ইঞ্চি উপরে। মাঝ-সড়কে কোমর অব্ধি জল, খালের গভীরতা অপরিমেয়। এই খাল পেরিয়ে যে বাড়িতে যাব, সে বাড়ির এপ্রোচের মুলিবাঁশের সাঁকোটি বানের জলের তোড়ে কোথায় ভেসে গিয়েছে কে জানে! বাড়ির উঠোনে ডুব জল, একতলায় বুক-জল। রাস্তার ওপাশের এক ভদ্রলোক দোতলার জানালায় দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ওদিকে যেতে পারবেন না দাদা, বরং পাশের গলি দিয়ে একটু এগিয়ে হাঁক দিন।’ তাই করতে গিয়ে গলির মুখে কাত হয়ে থাকা সাঁকোটি কোনোক্রমে পেরিয়ে, কোমর জলে দাঁড়িয়ে ডাকা-ডাকি শুরু করলাম। স্বজন-পরিবার দোতলার ব্যালকনি থেকে দড়ি মারফত বাজার ব্যাগ নামিয়ে দিলেন। জানালেন, দিন দশেক ধরে জলবন্দী অবস্থায় রয়েছেন, নেই পানীয়জল -বিদ্যুৎ। নিত্য-পণ্যসামগ্রীর মজুত একেবারে তলানীতে। অষুধ-পত্তরেরও একই হাল, নেই যোগাযোগেরও কোনো সুযোগ। বললাম -দু’একদিনের মধ্যে আবার আসব।
তিন :-
বিবেকানন্দ রোডের বাড়ি থেকে ফিরে এসে এবার থার্মোকলের ভেলায় চেপে কলেজ রোডের দিকে পা-বাড়ালাম। গোটা এলাকার পরিস্থিতি ভয়াবহ। কুড়েঘর থেকে বহুতল ভবনের আবাসিক — সবাই একই পথের পথিক! পথে যেতে যেতে দেখলাম কুম্ভীরগ্রাম এয়ারপোর্টের তরফ থেকে পাঠানো পানীয় জলের ট্যাংকার, দাঁড়িয়ে রয়েছে রাস্তার ডান-পাশের অপেক্ষাকৃত একটু উঁচু জায়গায়। পাড়ার বৌ-মেয়েরা হাঁটুজল, কোমরজল, বুকজল ভেঙ্গে কলসী নিয়ে এগিয়ে আসছেন। রাস্তায় নৌকা, ভেলায় চেপে অনেকেই আসা-যাওয়া করছেন, তবে বাঁদিকের অথৈ গভীর জলে ডুবে থাকা ভয়ঙ্কর সেই পরিখা থেকে কোনোক্রমে গা-বাঁচিয়ে।

এভাবেই একসময় আমরা কলেজ রোড পয়েন্টে এসে পড়লাম। এখানে জলস্তর পায়ের পাতা অব্ধি। তাই নেমে পড়লাম। এবার গন্তব্য অম্বিকাপট্টি। মাঝি দু’জন ‘আধুনিক জলযান’কে কাঁধে তুলে নিয়ে চললেন আগে আগে, আমরা তাদের পিছন পিছন। এভাবেই সুভাষনগর কো-অপারেটিভ পয়েন্ট পেরিয়ে আরেকটু এগিয়ে যাওয়ার পর আমরা আবার ভেলার সওয়ারি হলাম। সেখান থেকে নিয়ন রোড ধরে এগিয়ে যাওয়ার পর অবশেষে স্থলপথে অম্বিকাপট্টীর সুজন-সুহৃদদের ঠিকানায় গিয়ে পৌঁছেছিলাম।
করিমগঞ্জ ফিরে আসতে গিয়ে আমরা বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিটের শিলচর-ভৈরবী ট্রেনে উঠেছিলাম। সেখান থেকে কয়েকটি স্টেশন পেরিয়ে পড়ন্ত বেলায় এসে হাজির হয়েছিলাম কাটাখাল জংশনে। সামনে অথৈ জলের সমুদ্র, দেখলাম স্টেশনের ঘাটে দাঁড়িয়ে রয়েছে গোটাকয়েক নৌকো। তারমধ্যে একটির সওয়ারি হলাম আমরা দু’জন। দিগন্তবিস্তৃত বকরী হাওরের বুক বেয়ে চলতে গিয়ে চোখে পড়ল গোটা জনপদই গভীর জলে নিমজ্জিত, যেন শ্মশানের নীরবতা ভেঙ্গে সাগরের ঢেউগুলো বারে বারে আছড়ে পড়ছে দালান-কুটিরের চালে-দেয়ালে, বড় বড় গাছ-গাছালির নুয়ে পড়া শাখা-প্রশাখায় কিংবা আধ-ডুবা ইলেক্ট্রিক পোলে। অপরদিকে, দিনভর মেঘের আড়ালে লুকোচুরি খেলতে খেলতে একসময় পরিশ্রান্ত দিনান্তের অস্তমিত রবিও যেন এবার জলছবি এঁকে দিয়ে যাচ্ছে সাগরসম উত্তাল হাওরের বুকে।
আমরা পিতা-পুত্র সেদিন বেশ রাতেই ঘরে ফিরেছিলাম।
চার :-
সেদিনের পরিক্রমায় একাধিক বানভাসি এলাকায় যাওয়া সম্ভব হয়নি সময়াভাবে। তাই চিন্তা করলাম আরেকদিন যাব। সে অনুযায়ী ২৯ জুন তারিখে যাওয়া স্থির করলাম। ট্রেন যাচ্ছেনা, তাই খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলাম সড়কপথে কাটিগড়া-কালাইন-রাণীফেরি রুট ধরে যাওয়া যাবে। সুতরাং করিমগঞ্জ থেকে প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী সংগ্রহ করে ছোট গাড়ি নিয়ে রওয়ানা হলাম। বন্যাবিধ্বস্ত নিকটাত্মীয়দের পাশে গিয়ে দাঁড়াবো, তাই পুত্রের সাথে সহধর্মিণী অসীমাও (পাপড়ি) সহযাত্রী হলেন।
এবার আমাদের গন্তব্য শিলচর চেংকুড়ি রোড ও সন্নিহিত অঞ্চলের বান-পরিসর। গাড়ি নিয়ে অম্বিকাপট্টী-অধরচাঁদ-জিসি কলেজ পেরিয়ে চেংকুড়ি রোড পয়েন্ট অব্ধি এসে পৌঁছেছিলাম। এখানকার বান-পরিস্থিতি মোটেই অনুকূল নয়, বরং আমাদের পূর্বানুমানকে পিছনে ফেলে দিয়েছিল। গোটা চেংকুড়ি রোডে অথৈ জল! ঘাটের কোলাহল মুখরিত পরিবেশ হার মানিয়েছিল উপত্যকার অন্যান্য নৌঘাটের পরিচিত দৃশ্যকেও। বিভিন্ন পরিমাপের ডিঙ্গি থেকে ছোটবড় মাঝারি নৌকোর ভীড় এখানে। কিছুটা তফাতে রয়েছে অনেকগুলো থার্মোকলের ভেলা। মাতৃশ্রী লেন, যেখানে আমরা যাচ্ছি, সেটি চেংকুড়ি রোড বাই-লেন্, অপ্রশস্ত এবং ভীষণ আঁকা-বাঁকা, তদুপরি ইংরেজী , ‘জেড’ আকৃতিও রয়েছে এই লেনে। তাই ভাবলাম ডিঙ্গি নিয়ে যাওয়াটা সম্ভবপর নাও হতে পারে। সুতরাং ভেলার আশ্রয় নেয়াটাই যুক্তিযুক্ত। এক্ষেত্রে অসীমাকে ভেলায় চড়িয়ে নেয়াটা সমীচীন নয়। অতএব তাঁকে নিরাপদ আশ্রয়ে রেখে আমরা পিতা-পুত্র ভেলায় চড়ে বসেছিলাম।
তারাপুর বাইলেন, চাঁন্দমারী এলাকা কিংবা বিবেকানন্দ রোডের মত এখানেও রয়েছে কুড়েঘর থেকে বহুতল ভবন, অধিকাংশেরই গ্রাউণ্ড-ফ্লোর জলের তলায়। সবক’টি ভবন থেকেই ঝুলানো রয়েছে ব্যাগ কিংবা প্লাস্টিকের বালতি। ভেলাবাহী হকারের সমাবেশ এখানেও। পথে যেতে যেতে একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে দেখেছি ত্রাণসামগ্রী নিয়ে যাচ্ছে দূরবর্তী এলাকার জন্য। তাদের মধ্যে রয়েছে মিজোরামের সংস্থাও।
এদের সাথে কথা বলতে বলতে একসময় আমরা ভেলা নিয়ে মাতৃশ্রী লেনে ঢুকে পড়লাম। এই ছোট্ট গলিতেও অনেকগুলো বহুতল ভবন রয়েছে এবং রয়েছে ঝুলে থাকা ব্যাগ-পত্তরও। গলির ভৌগোলিক পরিসর দেখে অনুমিত হয় যে, এটি বহুলাংশে ভেলাবাহী হকার-নির্ভর, যাদের নিবাস তপোবন নগর এবং আশ্রমরোড। আমাদের বাহককে জিজ্ঞেস করে জানলাম, সেও বান-বিধ্বস্ত তপোবন নগরেরই বাসিন্দা, পরিবার রয়েছে ওরিয়েন্টেল স্কুলে।
আমাদের জলযানটি গলির শেষপ্রান্তে এসে এবার সরাসরি ঢুকে পড়লো ‘পদধুলি’ ভবনের গ্রাউণ্ড ফ্লোরে। জল নেমে গিয়ে এখন কোমর অব্ধি ঠেকেছে। দু’দিন আগে লেভেলটি দরজার উপর পর্যন্ত ছিল। পরিবারের কর্তা, অশীতিপর জয়কিশোরবাবু সহধর্মিণীকে নিয়ে বাড়িতে একাই থাকেন। ছেলেমেয়েরা কলকাতা এবং মুম্বাইয়ে রয়েছেন। শিলচরের প্রলয়ঙ্করী বন্যা এই পরিবারকে বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যেই ফেলে দিয়েছিল। সরকারি-বেসরকারি পরিষেবা এই কৌণিক পরিসরের জন্য একপ্রকার অধরাই থেকে গিয়েছিল। ভরসা শুধু বানভাসি তপোবন কিংবা সন্নিহিত অঞ্চলের হকার। একই পরিষেবার সুযোগ পেয়েছিলেন বিবেকানন্দ রোডের অধিবাসী আমার অগ্রজভ্রাতা, আটাত্তরোর্ধ বয়সী আনন্দমোহন মোহন্ত।

যাই হোক, সেদিন ‘পদধুলি’ থেকে ফিরে এসে আশ্রম রোড হয়ে বিবেকানন্দ রোডের অসহায় পরিবারের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম।
শেষকথা :
এবারের বর্ষার মরশুমে বরাক নদীর জলস্তর ২১.৫৯ মিটার অবধি পৌঁছেছিল ২১ জুন দুপুর দুটোয়। কিন্তু এই স্তরকেও পিছনে ফেলে দিয়েছিল সাম্প্রতিক অতীতের একাধিক রেকর্ড। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল –
(১) ২০০৪ সালের জলস্ফীতি ( ২১.৬১ মিটার ),
(২) ১৯৮৯ সালের জলস্ফীতি ( ২১.৮৪ মিটার )।
তা সত্বেও বিগত ৩৩ বছরে সংঘটিত হওয়া একাধিক বান পরিস্থিতিকেও হার মানিয়েছিল এবারের প্রলয়ঙ্করী বন্যা। প্রেক্ষাপট অজানা নয় কারও কাছে। এরূপ হঠকারিতা এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে সময়োপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণে নির্লিপ্ততার পরিপ্রেক্ষিতেই পৌর ও লোকায়ত পরিসরের জনসমাজকে যে কতটুকু দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ যে কতদূর অবধি গিয়ে দাঁড়িয়েছে, সেটি নিশ্চিতরূপেই অপরিমেয়। বিপদ সীমা থেকে ১.৭৬ মিটার উপর দিয়ে বয়ে চলা বরাকের জলের তোড়ে সেদিন ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল গোটা শিলচর সহ উপনগরী এলাকাকে। আজও এই চিত্রের তেমন কোনো হেরফের ঘটেনি শহর তথা শহরতলী এলাকার কিছু অংশে।
জলবন্দী প্রায় দু’লক্ষ নাগরিকদের অবস্থা যে কতটুকু ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিল, সেটা স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করার উপায় ছিলনা। চতুর্দিকেই হাহাকার পরিস্থিতি, পানীয়জল, বিদ্যুৎ পরিষেবা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, মোবাইল পরিষেবা সবই স্তব্ধ হয়ে পড়েছিল জুন ১৯/২০ তারিখ থেকেই। এই পরিস্থিতি যে কতটুকু ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে, সেটি অনুধাবন করতে কোনো অসুবিধা হয়না, যখন দেখা যায় জলমগ্ন শ্মশানে দাহ করতে না পেরে, নিরুপায় হয়ে মৃতদেহ প্যাকেটে মুড়ে ভেলায় করে জলে ভাসিয়ে দিতে হয়েছিল। নিত্যপণ্য সামগ্রীর অবস্থাও তথৈবচ। এই পরিস্থিতিটা আজও পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। ত্রাণ পরিষেবায় সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও এগিয়ে এসেছিল। কিন্তু অধিকাংশ গলি-উপগলির বানভাসি পরিবার এই পরিষেবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছিল, অন্তত ভুক্তভোগীদের স্বাক্ষ্য মতে। সেসব জায়গায় দেখেছি পানীয়জল থেকে শুরু করে অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছিল ভেলাবাহি হকাররা। এইসব হকাররা যদি সেসময় এগিয়ে না আসতেন, তবে শহরের অলি-গলিতে বসবাসরত বানভাসি নাগরিকদের অবস্থা যে কী পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াতো, সেটা ভাবা যায়না! সেখানকার বন্যাপীড়িতদের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে এইসব দৃশ্যই উপলব্ধ হয়েছিল, যা এককথায় অবিশ্বাস্য এবং অবর্ণনীয় বৈকি।
এবারের বন্যা শহর কিংবা শহরতলির নিকাশি ব্যবস্থার কঙ্কালসার রূপটিকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেল। আমরা অপরের জন্য একচুলও জমি ছাড়তে রাজি নই, আমাদেরই আগ্রাসী ক্ষুধায় ক্রমান্বয়ে সঙ্কুচিত, আবার কোথাও চিরতরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে জল-জমিন-গ্রীনবেল্ট, যেখানে একটু ঠাঁই নিতে পারত ধারাবর্ষণের জমা জল। ফলে, চিরাচরিত বিস্তীর্ণ এলাকায় যেখানে আশি-নব্বুইর দশক পর্যন্ত, ফুট-তিনেক গভীরতা নিয়ে দিনকয়েকের জন্য একটু বিশ্রাম নিতে পারতো মরশুমি বানের জল, সেখানে সঙ্কুচিত পরিসরে থাকতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের শাসন-শোষণ-চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করেই আশপাশ এলাকাকে প্লাবিত করে তুলছে। এবং তার স্থিতিকাল দীর্ঘায়িত করার ক্ষেত্রে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে — আমাদেরই ক্ষুধা নিবৃত্তির কারণে কোনোক্রমে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা পূর্বতন প্রশস্ত খাল কিংবা নিকাশি নালা। এমন চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে বান পরিস্থিতি যে আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা।