The Mirrow

বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যোতিষ-বিজ্ঞানের অন্তর্জলিযাত্রা

Share the Article

সৌরভ চক্রবর্তী

স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে এই প্রথম কোন কেন্দ্রীয় সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যোতিষশাস্ত্র শিক্ষা দেওয়া এবং শিক্ষান্তে ডিগ্রি দেওয়ার ঘোষণা হল। এ বছর ২৪ শে জুন কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত IGNOU বা ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল ওপেন ইউনিভার্সিটি দু’বছরের দূরশিক্ষার ( এম এ, জ্যোতিষ) কোর্সে  ভর্তি হওয়ার আবেদন জানিয়ে অনলাইন ঘোষণা করল। ‘পঞ্চাঙ্গ এবং মুহূর্ত ‘ ‘ কুন্ডলী গঠন ‘ ‘গ্রহণের উপলব্ধি ‘ ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে । এই প্রথম সায়েন্স pseudo science বা অপবিজ্ঞান বলে  স্বীকৃত, যার কোনো বাস্তব প্রমাণ নেই, statistical test এ প্রমাণিত নয় সেই জ্যোতিষশাস্ত্র কে ‘সমাজের উপকার হবে ‘ ‘কর্মসংস্থান হবে ‘ ইত্যাদি বলে IGNOU র পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হলো। কোনো পড়ুয়া ৪০%  ক্রেডিট নম্বর পেয়ে যদি মাঝপথে পড়া ছেড়ে দেয় তাহলে তাকে ডিপ্লোমা বা শংসাপত্র দেওয়া হবে।

 এই ঘোষণায় ভারতের সংবিধানের ৫১(এ) এইচ  ধারা কার্যত তার গুরুত্ব হারালো। ২০০১ এর  এর ২৩ শে ফেব্রুয়ারি যখন প্রধানমন্ত্রীত্বে  ছিলেন অটল বিহারী বাজপেয়ী এবং মানব সম্পদ উন্নয়ন দপ্তরের মন্ত্রী ছিলেন মুরলী মনোহর যোশী, বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশন একটি নোটিফিকেশন জারি  করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে জ্যোতিষশাস্ত্র কে অন্তর্ভুক্ত করেছিল। সে সময়ে বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকার  বলেছিলেন, ‘ এতে ভারতবর্ষকে মধ্যযুগে ফিরিয়ে দেওয়া হল। ‘

কোথায় চলেছি আমরা! প্রাচীন জ্ঞানের দোহাই দিয়ে এবারে কি আমাদের কোপার্নিকাসের আগের বিশ্বে নিক্ষিপ্ত করা  হবে যখন আমাদের পূর্বপুরুষেরা বিশ্বাস করতেন সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে?  জ্যোতিষশাস্ত্রে তো সূর্যকে গ্রহ বলেই বলা হয়েছে। তাহলে এরপর হয়তো সরকারি ভাষ্যে শোনা যাবে যে সূর্যই পৃথিবীর চারিদিকে প্রদক্ষিণ করে।  কর্মসংস্থানের যুক্তিতেই যদি জ্যোতিষশাস্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে হয় তাহলে প্রেতচর্চা, ডাইনিবিদ্যা, অ্যালকেমি, ঝাড়ফুঁক, জল পড়া, তেল পড়া, বাটিচালান, নখদর্পণ – এসবও  বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত হোক!সাপের ওঝা, ভূতের ওঝারাই দেশের শিক্ষাব্যবস্থার দায়িত্ব গ্রহণ করুন! ভারতের গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি NEP ২০২০ তে অবৈজ্ঞানিক, বিতর্কিত,  উদ্বেগজনক তত্ত্বের সমাহার ঘটিয়ে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা এবং কাঠামোকে তছনছ করে দেওয়া হল এবং জ্যোতিষশাস্ত্রের মত অপ্রমাণিত এক শাস্ত্রকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হলো।

 এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সারাদেশ প্রতিবাদে উত্তাল হয়েছে। বিজ্ঞানী, গবেষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা,নানা প্রতিষ্ঠান, জনবিজ্ঞান সংগঠন প্রতিবাদে সামিল হয়েছে। সারা ভারত জনবিজ্ঞান নেটওয়ার্কের আহবানে দেশের ৩৮৩ টি  বিশ্ববিদ্যালয়,

স্কুল শিক্ষক, বিজ্ঞানী, গবেষক, বিভিন্ন বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ রাজ্যজুড়ে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০  এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যোতিষশাস্ত্রের অন্তর্ভুক্তির বিরুদ্ধে  প্রতিবাদ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

 একদিকে যেমন দেশের সরকারের প্রতিনিধিরা করোনাতে গোমুত্রের  নিদান দিচ্ছেন, মহাভারতের যুগে ইন্টারনেট, গণেশের প্লাস্টিক সার্জারি, গোদুগ্ধে সোনার উপস্থিতির মতো লাগাতার অবৈজ্ঞানিক  মন্তব্য করে যাচ্ছেন আর অন্যদিকে  অপবিজ্ঞান, ভ্রান্ত বিজ্ঞানকে দেশের নীতিনির্ধারণে অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছেন। একদিকে ভারত বর্ষ চন্দ্রযান, মঙ্গল যান পাঠাচ্ছে, নানা কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে পাঠাচ্ছে অন্যদিকে মহাকাশ নিয়ে চরম কুসংস্কার মূলক বিজ্ঞানবিরোধী ভাবনা-চিন্তার সমাবেশ ঘটিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে জ্যোতিষ শাস্ত্রকে অন্তর্ভুক্ত করেছে।

এর আগে ২০০১  সালে যখন ইউজিসি জ্যোতিষশাস্ত্র কে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করেছিল, স্বনামধন্য বিজ্ঞানী এবং ইউজিসির প্রাক্তন চেয়ারম্যান যশপাল মন্তব্য করেছিলেন ‘ এ অতি  লজ্জার ব্যাপার, বিজ্ঞানের অগ্রগতি বিরোধী কাজ। এই পাঠ্যবিষয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কায়েম হলে হয়তো ভবিষ্যতে জ্যোতিষবিদ্যাধর ও জ্যোতিষ ডিগ্রীর  পৃষ্ঠপোষকগণ তাদের বিরোধী মতের শাখাগুলিকে যেমন পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জ্যোতির্বিজ্ঞান, মহাকাশ বিজ্ঞান ইত্যাদিকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিতারণ করার উদ্যোগ নেবেন।

 স্বনামধন্য পদ্মভূষণ উপাধি ভূষিত বিজ্ঞানী, সেন্টার ফর মলিক্যুলার বায়োলজির প্রতিষ্ঠাতা ডাইরেক্টর পুষ্প এম ভার্গভ ২০০১ সালে অন্ধপ্রদেশ হাইকোর্টে  আরও দুজনের সাথে, বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যোতিষশাস্ত্রের অন্তর্ভুক্তির বিরোধ করে এক রিট পিটিশন দাখিল করেন। দুজনের একজন হলেন ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রনীতির প্রধান, অধ্যাপক সুভাষচন্দ্র রেড্ডি এবং লেখিকা চন্দনা চক্রবর্তী। পিটিশনে তাঁরা বলেন যে, বৈদিক জ্যোতিষ পাঠক্রমের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রতি একজন অধ্যাপক, একজন রীডার, দুজন লেকচারার, একজন লাইব্রেরী সহায়ক, একজন কম্পিউটার অপারেটর এর পদ সৃষ্টি করা হবে, তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রতি ১৫ লক্ষ টাকা ( ২০০১ এর হিসেবে) করে মঞ্জুর করা হবে। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই পঠন-পাঠন শুরু হলে বিশাল অংকের টাকা সরকারকে বরাদ্দ করতে হবে।

তারা প্রশ্ন তুললেন এই বিশাল অঙ্কের টাকা খরচ করে জ্যোতিষশাস্ত্র পড়ানো  কেন? বৈদিক জ্যোতিষ কখনোই বিজ্ঞান হিসেবে স্বীকৃত নয়। বিজ্ঞান হল সুনির্দিষ্ট পদ্ধতির মাধ্যমে জ্ঞান আহরণ, যে পদ্ধতিতে বারেবারে যাচাই করতে হয়, বারে বারে একই ফল হলে তাকে সত্য বলে মানা হয়, আর বারে বারে একই ফল না হলে তাকে ভ্রান্ত বলে নস্যাৎ করা হয়। এই পদ্ধতির নামেই বিজ্ঞান। বৈদিক জ্যোতিষ কখনো এই পদ্ধতিতে পরীক্ষিত সত্য নয় তাই তার বিজ্ঞান হিসেবে কোন স্বীকৃতিই নেই। বিশ্বের কোথাও কোনও বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এর কোন স্বীকৃতি নেই। বৈজ্ঞানিক সত্য কখনো কারো জেদ এবং খেয়ালখুশির উপর নির্ভর করে না। পিটিশনে তারা বললেন এ সিদ্ধান্ত আসলে শিক্ষা ব্যবস্থার গৈরিকীকরণ ছাড়া আর কিছু নয়। মূল বিজ্ঞানের বিষয়গুলিতে গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে না, তখন বৈদিক জ্যোতিষ নামে এক অপবিজ্ঞানের জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করা মানে পেছনের দিকে বিশাল এক লাফ দেওয়া।

মাদ্রাজ হাইকোর্ট বলল যে, জ্যোতিষশাস্ত্র নিয়ে আরো অনেক স্টাডি দরকার। বর্তমানে ইউজিসি র  এই সিদ্ধান্তে আদালত হস্তক্ষেপ করবে না। এই বলে রিট পিটিশন খারিজ করে দেওয়া হলো।

IGNOU এবারে যদিও ( এম এ,  জ্যোতিষ) এর কথা বলেছে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ২০০১ এর বৈদিক জ্যোতিষ বিএসসি, এমএসসি ডিগ্রী দেবার  সিদ্ধান্ত বহাল থাকছে।

 উত্তরাধুনিকতাবাদীরা ‘ মেটা ন্যারেটিভ ‘ এর নামে নবজাগরণ কে অস্বীকার করে। আর এই ‘ পোষ্ট ট্রুথ ‘ জমানায় রেনেসাঁ কে অস্বীকার করে তার পূর্ববর্তী পর্বকে অতীতের গৌরব নাম দিয়ে মানুষের চিন্তা চেতনাকে লাফ দিয়ে পেছনে নিয়ে যাবার ছক সাজানো হয়। নবজাগরণ আমাদের শিক্ষা দিয়েছিল এই জগৎ পরিবর্তনশীল। নবজাগরণ ফ্রান্সিস বেকনের পরীক্ষা পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে সত্যের  সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে এই ভাষ্যকেই উচ্চে তুলে ধরেছিল। জন্ম নিয়েছিল আরোহ যুক্তি বিজ্ঞানের। রেনে দেঁকার্ত এনেছিলেন অবরোহ যুক্তি পদ্ধতি। নবজাগরণের দুকূলশ্রাবী ঢেউ  শিল্পকলা সাহিত্য বিজ্ঞান এবং অর্থনীতিকে বদলে দিয়েছিল। এই ধাক্কাতেই এসেছিল ফরাসি বিপ্লব। রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ  হয়েছিল। গণতন্ত্র এসেছিল তখনকার আধুনিক বণিকের হাত ধরে। মধ্য যুগ পেরিয়ে পৃথিবী প্রবেশ করেছিল আধুনিকতায়। আজ পুঁজিবাদের সংকটে আধুনিকতার ভগীরথরাই

কায়েমীতে  রূপান্তরিত হয়েছে। তাই তারা পশ্চাদগামী। তারা রেনেসাঁ টপকে কোপার্নিকাস গ্যালিলিও নিউটনকে টপকে পেছন পানে  দীর্ঘ লাফ দিতে উদ্যত। রেঁনেসা  থেকে প্রাপ্ত মহামূল্যবান বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, বিজ্ঞান আধারিত যুক্তি আজ আক্রান্ত! কোথায় যাব আমরা! পক্ষান্তরে দেশের মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে নব নব কৃত্রিম উপগ্রহ, চন্দ্রযান, মঙ্গল যান নিক্ষিপ্ত হচ্ছে দেশের মাটি থেকেই আবার বিজ্ঞানের বুনিয়াদি ক্ষেত্রে দেশের গবেষণাগারগুলি, বিশ্ববিদ্যালয়ের  গবেষণা অর্থ বরাদ্দের অভাবে রুগ্ন হচ্ছে। আদতে আজ বিজ্ঞান গবেষণাও মুনাফা কেন্দ্রিক বাণিজ্যের স্বার্থে  পরিচালিত। এই স্ববিরোধিতা রেনেসাঁ পূর্বের বণিক সমাজের ছিলনা। তখন তারা আধুনিকতার ভগীরথ। আজকের বিজ্ঞানের সুফল সবার জন্য নয়, ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর জন্য, আর এই চিন্তাকেই কার্যকর করতে বৃহত্তর জনসমাজের চিন্তা-চেতনাকে পশ্চাদগামী করে তুলবার অপকৌশলজাত  পশ্চাদগামী দর্শন আজ শাসকের হাতিয়ার। প্রাক রেঁনেসা পর্বের  উল্টো অবস্থান। মধ্যযুগের দর্শন ছিল অ্যারিস্টটলের বেঁধে দেওয়া অনড় অজর ভূমন্ডলের মেটাফিজিক্যাল দর্শন। পৃথিবী কে কেন্দ্র করে আবর্তিত ভূমন্ডল আর ঈশ্বরের প্রতিনিধি রাজা রূপ শাসক কে কেন্দ্র করে আবর্তিত পৃথিবী। পৃথিবীর উপরের স্তরের গোলক ঈশ্বরের ইচ্ছায় অপরিবর্তনীয়।বৃহস্পতির চারটি উপগ্রহ আবিষ্কার তাই তখন নিষিদ্ধ গবেষণালব্ধ ফল তাই গ্যালিলিওকে ইনক্যুইজিশনে  যেতে হয়েছিল একাধিকবার। সূর্য নয় পৃথিবী সূর্যের চারদিকে প্রদক্ষিণ করে এই তথ্য কোপার্নিকাস মৃত্যুভয়ে মৃত্যুশয্যায় শায়িত হবার আগে পর্যন্ত প্রকাশ করতে পারেননি।  শাসকের দর্শন মৃত্যুদূত হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁর সম্মুখে।

 জ্যোতিষশাস্ত্র শাসকের কায়েমী স্বার্থের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। দ্বিতীয় নগরায়ন থেকে উদ্ভূত কর্মফল জন্মান্তর অদৃষ্টবাদ কে দার্শনিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছিল জ্যোতিষ। এদেশে তারপরে বরাহমিহির জ্যোতিষ বিজ্ঞান থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভবিষ্যদবেত্তা হিসেবে জ্যোতিষশাস্ত্র কে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কর্মফল জন্মান্তর অদৃষ্টবাদ যেমন শাসকের হাতিয়ার তেমনি জ্যোতিষশাস্ত্রও তাই। আজও  জ্যোতিষশাস্ত্র তার গণনা থেকে অস্তিত্বহীন রাহু কেতু কে বাদ দিতে পারেনা সূর্যকে নক্ষত্র হিসেবে মান্যতা দেয় না। প্রাচীন সেই অজর অমর বিচারবিযুক্তবাদের  বাইরে যেতে পারে না। এ এক  কায়েমী স্বার্থের  চিন্তাপ্রসূত হাতিয়ার।

জ্যোতিষশাস্ত্রকে ভ্রান্ত  বলে বিজ্ঞানীদের ঘোষণাপত্রঃ

১৯৭৫  সালের সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কের দ্য  হিউম্যানিস্ট পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৮৬  জন স্বনামধন্য বিজ্ঞানীর স্বাক্ষর করা ঘোষণাপত্র। স্বাক্ষর কারীদের মধ্যে ছিলেন ১৮  জন নোবেল পুরস্কারে ভূষিত  বিজ্ঞানীগণ। ঘোষণাপত্রে তারা বলেন, গ্রহ নক্ষত্রগুলির অবস্থান পৃথিবী থেকে এত দূরে যে তারা পৃথিবীর উপর মহাকর্ষ বা অন্যান্য অভিঘাতজনিত যে বল বা শক্তি প্রয়োগ করে তার পরিমাণ অতি নগন্য। জন্মমুহূর্তে গ্রহ-নক্ষত্রের আকর্ষণ বলের ক্রিয়া জাতকের ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ করছে এরকম ভাবনার পেছনে কোনো যুক্তি নেই।এও সত্য নয় যে এই বহু দূরের গ্রহ নক্ষত্রদের  অবস্থান কোন বিশেষ দিন বা সময়কে কোন বিশেষ কাজের পক্ষে সুবিধাজনক করে তুলছে। আমরা অত্যন্ত বিচলিত কেননা বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে নামকরা সংবাদপত্র, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, পুস্তক প্রকাশক পর্যন্ত ঠিকুজি কোষ্ঠী, রাশি বিচার ভবিষ্যৎ বাণীর মহীমা সম্পর্কে ক্রমাগত প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন, সেখানে কোনো রকম যুক্তি বিচারের স্থান নেই। এতে মানুষের মধ্যে অলৌকিক ধ্যান-ধারণা অন্ধবিশ্বাস বেড়েই যায়। আমরা বিশ্বাস করি জ্যোতিষ চর্চার ধ্বজাধারীদের ভন্ডামীর বিরুদ্ধে সরাসরি দৃঢ়ভাবে এই চ্যালেঞ্জ জানানোর সময় এসেছে। জ্যোতিষশাস্ত্র ভ্রান্ত, অপবিজ্ঞান। এই বৈজ্ঞানিকভাবে সত্যটিকে ঘোষণাপত্রে স্পষ্ট করার পর তাতেব স্বাক্ষর করেছিলেন খ্যাতনামা ১৮৬  জন বিজ্ঞানী। যাদের মধ্যে প্রাতঃস্মরণীয় বিজ্ঞানীগণ যেমন, স্যার টমাস গোল্ড, কনরাড লোরেঞ্জ, লিনাস পাউলিং, টিনবারগেন, চন্দ্রশেখর,  বি এফ স্কিনার, ফ্রান্সিস ক্রিক প্রমূখ ছিলেন।

এবারে আমরা দেখি দেশের প্রাতঃস্মরণীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা বৈদিক জ্যোতিষ সম্পর্কে কি বলেছিলেন। তিনি ভারতীয় জ্যোতিষের ক্রমবিকাশকে তিনটি পর্বে ভাগ করেছিলেন।

 ১) বেদ কালঃ  খৃঃ পূঃ ১৪০০ শতাব্দীর পূর্ববর্তী

 ২) বেদাঙ্গ জ্যোতিষ কালঃ খৃঃ পূঃ ১৪০০ – ৪০০ খৃঃ

৩)  সিদ্ধান্ত জ্যোতিষ কালঃ ৪০০ খৃঃ অঃ – ১২০০ খৃঃ অঃ

তাঁর মতে, ” বেদ কালের জ্যোতিষ অতিসাধারণ রকমের এবং বহু স্থলে অর্থ সম্বন্ধে মতদ্বৈধ আছে। তদপেক্ষা উন্নততর বেদাঙ্গ জ্যোতিষের কাল গণনা প্রণালী ‘ মহাভারতে ‘  অনুসৃত হইয়াছে ( বিরাট পর্ব ৫২ অধ্যায়) মহাভারতের সংকটকাল দীক্ষিতের মতে (এবং যাহা এখন সর্বসম্মত) খৃঃ পূঃ ৪৫০  হইতে ৪০০ খৃষ্টাব্দ।  এই মহাভারতে কুত্রাপি  সপ্তাহ বার রাশিচক্রের ( যাহা বর্তমান পঞ্জিকার একটি প্রধান অঙ্গ)  উল্লেখ নাই। ‘মহাভারতে’ কোথাও পৃথিবীর গোলত্ব,  আবর্তনবাদ বা সূর্যের চতুর্দিকে  পৃথিবীর প্রদক্ষিণ বাদের উল্লেখ নাই ; বরঞ্চ যে সমস্ত মতের উল্লেখ আছে তাহা উক্ত সমস্ত মতবাদ হইতে সম্পুর্ণ অন্যরকমের ( ভীষ্ম,পর্ব ৬ অধ্যায়; বনপর্ব ১২৬)। মহাভারতে পৃথিবীকে সমতল বলিয়া বর্ণনা করা হইয়াছে, সুমেরু উহার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এবং পৃথিবী যতটা প্রসারিত সুমেরু প্রায় কতটা উঁচু, সূর্য সুমেরুর চতুর্দিকে ভ্রমণ করিয়া দিবারাত্রি ঘটায় এই রূপ বর্ণনা আছে। সুতরাং ধরা যেতে পারে যে মহাভারত সংকলন কালের অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০ অব্দের পূর্বে ভারতে পৃথিবীর গোলত্ব বা আবর্তনবাদ অথবা সূর্যের চতুর্দিকে পৃথিবীর প্রদক্ষিণবাদ জানা ছিল না।

 এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার যে সেই সময় জ্যোতির্বিজ্ঞানকে  জ্যোতিষ বলা হতো। তখনও জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং এসময়ের জ্যোতিষশাস্ত্রের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ঘটেনি। সেসব হয়েছে বরাহমিহিরের সময়। তাহলে এটাই দাঁড়ায়, বেদের সময়ে এদেশে জ্যোতির্বিজ্ঞান বলে কিছু ছিল না। বেদাঙ্গ বা বেদ পরবর্তী সময়েও বলার মত কিছু উদাহরণ পাওয়া যাচ্ছেনা। প্রাচীন বিজ্ঞানের ঐতিহ্যের নামে যা বলা হচ্ছে তার কোন বাস্তব প্রমান ভিত্তি নেই।

গর্বের সাথে যে বলা হয় যে, ‘ মহাভারতের যুগে ইন্টারনেট ছিল ‘ তার কোনও  বাস্তব প্রমাণ দূরে থাক মহাভারতের যুগে বার, সপ্তাহ, রাশিচক্র, পৃথিবীর আবর্তনবাদ সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না এমনকি ধারণা ছিল না পৃথিবীর আকার- আকৃতি নিয়েও। মেঘনাদ সাহা বলছেন,” বেদাঙ্গ জ্যোতিষের গণনা প্রণালী বর্তমান সময়ের তুলনায় অত্যন্ত স্থূল ও অশুদ্ধ।  এই গণনা প্রনালীই  একটু পরিবর্তিত হইয়া খৃষ্টের পর পর্যন্ত ‘পিতামহ সিদ্ধান্ত ‘ নামে প্রচলিত ছিল এবং পরবর্তীকালে ‘পিতামহ ব্রহ্মা ‘ প্রণীত বলিয়া স্বীকৃত হয়। অন্যান্য সিদ্ধান্তের তুলনায় এই প্রাচীন সিদ্ধান্ত কতদূর অশুদ্ধ,৫৫০ খ্রিস্টাব্দে প্রসিদ্ধ জ্যোতিষী বরাহমিহির তাহার সময়ে প্রচলিত পাঁচখানা সিদ্ধান্তের সারমর্ম তাঁহার পঞ্চসিদ্ধান্তিকা নামক করণ  গ্রন্থে বর্ণনা করেন এবং উক্ত পঞ্চসিদ্ধান্ত সম্বন্ধে নিম্নলিখিত তুলনামূলক মন্তব্য প্রকাশ করেন।

 বরাহমিহিরের সময় (৫৫০ খ্রিস্টাব্দে) পাঁচখানা সিদ্ধান্ত প্রচলিত ছিল – পৌলিশ বা পুলিশ,রোমক, সৌর, বাশিষ্ঠ ও পৈতামহ। তন্মধ্যে প্রথম দুইখানি লাটদেব  ব্যাখ্যা করেন। এই দুইখানির মধ্যে পৌলিশ সিদ্ধান্ত স্ফুট অর্থাৎ শুদ্ধ,রোমক সিদ্ধান্ত তাহার আসন্ন অর্থাৎ তদপেক্ষা অশুদ্ধ ; সর্বাপেক্ষা শুদ্ধ সূর্য- সিদ্ধান্ত কিন্তু অবশিষ্ট দুইখানি বাশিষ্ঠ ও পৈতামহ সিদ্ধান্ত ‘ দূরবিভ্রষ্ট ‘  অর্থাৎ অত্যন্ত অশুদ্ধ।

 এই মন্তব্যটি তলাইয়া বুঝিতে হইবে। নাম দৃষ্টে  প্রমাণ যে রোমক ও পৌলিশ- সিদ্ধান্ত বিদেশ হইতে আনুমানিক ৪০০ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষে আনীত হয়। বাস্তবিকপক্ষে পৌলিশ সিদ্ধান্তPaulas of Alexandria ( 376 AD) র জ্যোতিষ গ্রন্থ থেকে সংকলিত। বাকি রইল সর্বাপেক্ষা শুদ্ধ সূর্য – সিদ্ধান্ত কিন্তু ইহাও যে বিদেশ হইতে ধার করা তদ্বিষয়ে সন্দেহ নাই। “

এদেশে সূর্যসিদ্ধান্ত প্রণয়ন কিভাবে হ’ল?  মেঘনাদ সাহা বলছেন, ” সূর্য সিদ্ধান্তের কোন কোন পাণ্ডুলিপিতে আছে যে, ময়াসুর ব্রহ্মা কতৃক  শাপগ্রস্ত হইয়া রোমকপুরে  যবনরূপে জন্মগ্রহণ করেন এবং তথায় সূর্যের আরাধনা করিয়া জ্যোতিষের জ্ঞান প্রাপ্ত হন এবং ময়াসুরের  নিকট হইতে মহর্ষিগণ কাল ও জ্যোতির্বিজ্ঞান লাভ করেন। “

তিনি বলছেন, ” এই অসুরেরা রক্তমাংসের লোক। প্রাচীনকালে সমস্ত পশ্চিম এশিয়া জুড়িয়া তাহারা একটা মহান সভ্যতা গঠন করেন যাহার কেন্দ্রে ছিল Babylon, Nineveh, Ur ইত্যাদি Trigris ও Uphrates   নদীদ্বয়ের উপর অবস্থিত নগরগুলি। “

তিনি বলছেন “প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ শতাব্দীতে যে বেবিলনে গ্রহ-নক্ষত্রের পর্যবেক্ষণ হইত তাহার লিখিত প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে ( e.g Venus Tables of King Amiza Dugga, nearly 1900 B.C)।

…….. তাঁহারাই প্রথমে সৌর ও চান্দ্রমাসের সামঞ্জস্য সাধনের জন্য খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৩ অব্দে  প্রথম ১৯ বৎসরে ৭ টি অধিমাস গণনার প্রণালী প্রবর্তিত করেন ( Metonic Cycle) বেবিলনবাসী Kidinnu প্রায় খৃঃ পূঃ ৪০০ তে প্রথম অয়নচলন ( Precession of Equinoxes) আবিস্কার করেন।

এরপর তিনি বলছেন ”  ৫৫০ খ্রিস্টাব্দে যে  পাঁচখানি সিদ্ধান্ত প্রচলিত ছিল তন্মধ্যে প্রাচীন আর্য ঋষিদের নিজস্ব ছিল মাত্র পৈতামহ, যা পিতামহ ব্রহ্মা প্রণীত বলিয়া খ্যাত  কিন্তু বরাহমিহির  ‘ পিতামহ ব্রহ্মা ‘ কে ভাল কালগণগ্য  বলিয়া certificate  দেন নাই বরঞ্চ ৮০ খ্রিস্টাব্দে পিতামহ  ব্রহ্মার  জ্যোতিষের জ্ঞান সমসাময়িক ইংরাজ কৃষকদের জ্যোতির্বিজ্ঞানের জ্ঞান হইতে বিশেষ উন্নতস্তরের  ছিল না ইহা জোর করিয়া বলা যাইতে পারে।”

 একটা উদাহরণ দিয়েছেন তিনি, ” ভারতীয় নিজস্ব জ্যোতিষ যাহা খৃঃ পূঃ ১৪০০ শককাল (৮০ খৃঃ অঃ)  পর্যন্ত প্রচলিত ছিল তাহা কত অশুদ্ধ যে সামান্য দৃষ্টান্ততেই বোঝা যাইবে।  এই সিদ্ধান্ত মতে ৩৬৬  দিনে বৎসর হয় অর্থাৎ বৎসর গণনায় পিতামহ  ব্রহ্মা প্রায় ১৮  ঘন্টা ভুল করিয়াছিলেন কিন্তু ইহার বহু পূর্বেই খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দী হইতেই Eguptian, Babylonian এবং কিছু পরে Greek ও Roman গণ  প্রায় ৩৬৫ এবং এক চতুর্থাংশ দিনে যে বৎসর হয় তাহা জানিতেন। “

তাহলে কি দাঁড়ালো? প্রাচীন মুনি- ঋষিদের জ্যোতিষ! বৈদিক জ্যোতিষ!আদতে উল্লেখ করার মতো কিছু নেই, যেটুকু আছে তাও বিদেশিদের দান!  তাহলে কেন এত ঢক্কানিনাদ! কেন এতো শূন্য কুম্ভের বাদ্যি! এক হিমালয় মিথ্যের ওপর দাঁড়িয়ে ‘  মিথ ‘ তৈরী করে রোজ নানা অবৈজ্ঞানিক মন্তব্য উপর থেকে ছড়িয়ে  দিয়ে দেশব্যাপী যুক্তিবাদ বিবর্জিত, কুসংস্কারচ্ছন্ন এক মহল তৈরি করা হচ্ছে আর তার ওপর দাঁড়িয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিবর্জিত ভাগ্য গণনা, প্রতিকার ইত্যাদির জ্যোতিষশাস্ত্র কে বিজ্ঞান বলে চালিয়ে দিয়ে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা  চরম প্রগতিবিরোধী পদক্ষেপ। রেনেসাঁর মহান দান বিজ্ঞানমনস্কতার কাঠামোকে ভেঙে চৌচির করে দেওয়া হচ্ছে। এর খেসারৎ  দিতে হবে বহু বহু দিন ধরে। শাষক চলে যাবে, রেখে যাবে মনোজগতে একরাশ অন্ধকার!  বিজ্ঞানের পথ পরিহার করে দৈব – অলৌকিক কর্মফল জন্মান্তর নিয়তির অন্ধ চোরা গলি!

বিশ্ববিদ্যালয় যে জ্যোতিষশাস্ত্র অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তা জ্যোতির্বিজ্ঞান নয়।  ভাগ্য গণনার নামে জোড়াতালি দেওয়া অপবিজ্ঞানের পরাকাষ্ঠা মাত্র। যে প্রাচীন বৈদিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের নামে এই জ্যোতিষশাস্ত্রের যে বুজরুকি, অপবিজ্ঞান চালানো হচ্ছে সেই বৈদিক জ্যোতিষ বিজ্ঞান বা তখনকার নামে বৈদিক জ্যোতিষ নিয়ে মেঘনাদ সাহা কি মন্তব্য করছেন?

” হিন্দুর তিথি  ইত্যাদি গণনা, শুভ অশুভ দিনের মতবাদ, কতকগুলি মধ্যযুগীয় ভ্রান্তির উপর প্রতিষ্ঠিত এবং প্রচলিত হিন্দু পঞ্জিকা একটা কুসংস্কারের বিশ্বকোষ মাত্র। “

এই কুসংস্কারের বিশ্বকোষকে ঢাক  ঢোল পিটিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ  দিয়ে ডিগ্রি দেওয়া হচ্ছে!  কি গণনা করা হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে? কোন জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে ভাগ্য গণনা হবে? তিথি নক্ষত্রের হিসেব-নিকেশ হবে?

মেঘনাদ সাহা বলছেন, ”  প্রায় ১৭৩০  খ্রিস্টাব্দে সম্রাট মহম্মদ শাহ এর আদেশে জয়পুর রাজ সবাই জয়সিংহ ভারতে উন্নততর আরব জ্যোতিষের প্রচলন করিতে চেষ্টা করেন। তাঁহার  আদেশে তৈলঙ্গ পন্ডিত জগন্নাথ সংস্কৃত ভাষায়  ‘ সিদ্ধান্ত সম্রাট ‘নামক গ্রন্থ রচনা করেন।উহা Ptolemy র Syntaxis  এর আরব্য সংস্করণের ( যাহা Almagest নামে বিখ্যাত) অনুবাদ মাত্র। তাঁহার প্রতিষ্ঠিত মানমন্দিরসমূহ মধ্য এশিয়ার উলুখ বেগের মানমন্দিরের আদর্শে গঠিত।”

 একজন হিন্দু রাজা বৈদিক জ্যোতিষ ছেড়ে আরব জ্যোতিষের উপর ভরসা করলেন কেন? ১৭৩০ সালেই যে বৈদিক জ্যোতিষ কে বিশ্বাসযোগ্য মনে করেননি সবাই মানসিংহ ২০০১ এ সেই জ্যোতিষ কে ভিত্তি করে বুজরুকি গণনার জ্যোতিষশাস্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে গেল কেন? কার স্বার্থে? দেশের আপামর জনসাধারণের প্রগতির স্বার্থে? নাকি নিয়তিবাদ প্রতিষ্ঠায় শাসকের কায়েমী স্বার্থে? 

কোন ছকে গণনা হয়? সে ছক শুরু হয় কোন রাশি দিয়ে? সেই রাশির অবস্থান কি আদি বিন্দুতে আছে এখনো?  না নেই!

রাশিচক্রের ছকে আদি বিন্দু হল মেষ রাশি। রাশি চক্রের বারোটা রাশি আর বছরে মাস হলো ১২ টি, তাই প্রতিটি রাশি ছকের এক একটি ঘরে একমাস  করে অবস্থান করে আর গণনার আদি বিন্দু হলো রাশিচক্রের প্রথম ঘর মেষ।

vernal equinox বা মহাবিষুব হলো ২১ শে মার্চ, যেদিন সূর্য লম্বভাবে নিরক্ষরেখা ছুঁয়ে যায়। দিনরাত্রি সমান হয়।এই দিনটিকেই আদি বিন্দু ধরা হয়।

জ্যোতির্বিজ্ঞানী রমাপ্রসাদ সরকার বলছেন ” এক সময় সূর্যের মহাবিষুবতে আসার অর্থ ছিল মেষ রাশিতে আসা। এখন এগোতে এগোতে সেটা ঘটছে মীন রাশিতে। আরো কয়েকশো  বছর পরে ঘটবে কুম্ভ রাশিতে।

পৃথিবীর আহ্নিক গতি এবং বার্ষিক গতির পরেও আরো একটা গতি আছে – পৃথিবীর নিজের অক্ষের গতি।  অক্ষটিকে যদি মহাকাশে বর্দ্ধিত করে দেওয়া যায় তাহলে সেই অক্ষ মহাকাশে এক কাল্পনিক বৃত্ত রচনা করবে,  এক অবস্থান থেকে শুরু  করে  পুনরায় একই অবস্থানে ফিরে আসতে বা বৃত্ত শুরু করে শেষ করতে লাগবে প্রায় ২৬,০০০ বছর। এই কারণেই আজকের শেষ মহাবিষুব আবার 26 হাজার বছর পরে এই একই অবস্থানে ফিরে আসবে। এই ব্যাখ্যা করেছিলেন বিজ্ঞানী নিউটন। একেই বলে অয়নচলন বা precession of equinoxes। আমাদের দেশের পঞ্জিকাকারেরা  সূর্যকে ধরে অয়নচলন কে হিসেবের মধ্যে রেখে সায়ন বর্ষের (tropical year) ধরে গণনা করতে অক্ষম। তারা গণনা করেন নিরয়ন বর্ষ (siderial year), একটি নির্দিষ্ট নক্ষত্রের  সাপেক্ষে বর্ষ  গণনা।  সায়ন বর্ষ  আর নিরয়ন বর্ষের  পার্থক্যে মহাজাগতিক ঘটনাবলীর গণনায় চরম ভ্রান্তি হয়।

 মেঘনাদ সাহা বলছেন, ” নিরয়ন বৎসরের পরিমাণে যে ভুল ছিল দুয়ে  মিলিয়া  তাহাদের বৎসরমান প্রকৃত সায়ন বর্ষমান  অপেক্ষা প্রায় ০.০১৬ দিন বেশি হয় এবং প্রায় ১৪০০ বৎসরে হিন্দু বর্ষমান প্রায় ২৩  দিনে পৌঁছিয়াছে। হিন্দু পঞ্জিকায় ৩১ শে চৈত্রকে মহাবিষুব  সংক্রান্তি বলা হয় কিন্তু বাস্তবিক মহাবিষুব সংক্রান্তি হয় ৭ কি ৮ই  চৈত্র। “

সখেদে তিনি বলছেন, ” বাস্তবিক পক্ষে ১২০০ খৃঃ অব্দের পর হইতে হিন্দু জ্যোতিষিক পন্ডিতগণ বেহুলার মত মৃত সভ্যতার শব আলিঙ্গন করিয়া নিশ্চেষ্ট হইয়া বসিয়া আছেন এবং বর্তমান সময় পর্যন্ত অতি ভুল পদ্ধতিতে বর্ষ গণনা করিতেছেন। “

তাহলে গণনার আদি বিন্দু সরে গেছে মেষ থেকে বৃষে। রাশিচক্রের ছকটাই  ভুল হয়ে যাচ্ছে আর এইসব হাবিজাবি শিক্ষাদান বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের  নামে চালানো হচ্ছে! এই রাশিচক্রের রাশিগুলি যে নক্ষত্রপুঞ্জ আছে সেখান থেকে আলো আসতে ন্যূনতম ৪ বছর সময় লেগে যায়। ৪ বছর অনেক শিশুর আইয়ু্ই পায়  না কিন্তু তার কোষ্ঠী হয়ে যায়!

 হাজারো প্রশ্নের উত্তর নেই। কেন এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে শুধু ১২ টি রাশি?  কেন ১৮ ডিগ্রীর পটিকে সূর্যের আপাত পরিক্রমণ পথ ecliptic কেই বেছে বারোটি রাশির নির্ধারণ ? অন্যরা বাদ কেন? কেন কাল্পনিক রাহু কেতু? কেন সূর্য, চন্দ্রকে গ্রহ বলে ধরা হয়?হাজারো জন্ম সময়, কোনটা তাহলে সঠিক? আর লাখ টাকার যে প্রশ্নটার উত্তর নেই তাহ’ল কেন গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাবে  ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হয়?

এরপরে আছে পঞ্জিকাগুলোর একেকটার একেক  ভাষ্য! মল মাস, ক্ষয় মাস ধরে বিচারের পার্থক্য! দুই পঞ্জিকা মতে এক বছরে দুটো দুর্গাপূজা!বাণবৃদ্ধিরসক্ষয়!  হাজারো অসঙ্গতি, ভ্রান্তি! নক্ষত্রগুলির কোনওটা  মেয়ে কোনওটা  পুরুষ কোনওটা  ক্লীব! আষাঢ়ে কল্পনার সাথে কোন গাণিতিক হিসেবে যোগ করে ভাগ্য গণনা, শুভ-অশুভ নির্ধারিত হয়?

শুধু ভাগ্য গণনাই নয়, ভাগ্যের ভবিষ্যৎবাণীই নয় এরসাথে  আছে ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য প্রতিকার হিসেবে গ্রহ রত্ন ধারণ! এই ভাবনাটি আবার এসেছে পুরাপ্রস্তর যুগ  আর নব্য প্রস্তর যুগের সন্ধিক্ষণে যাদু ভাবনা থেকে। কোনও বস্তুর মধ্যে আদিদৈবিক কিছু আরোপ করে সেই শক্তি দিয়ে মানুষের হিতে কাজ করানো। তখন পরা হতো একগুচ্ছ  পালক, পাথর, অস্থি। এখন আসল নকল মিলিয়ে নানা রত্ন পাথর। একটা হিসেব বলছে, বাজারে বিক্রি হওয়া ৮০ শতাংশ পাথরই নকল। চলছে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা রমরমিয়ে।

শাস্ত্রে বলে বিধাতা মানুষের যে ভাগ্য লিখেছে সেই ললাট লিখনকে  খন্ডন করা যায় না! তা অমোঘ! কিন্তু তাহলে মর্তের হাতে আর থাকে কি? মর্তের কারবারিরা তাই ভাগ্যের ভবিষ্যতবাণীর সাথে সাথে ভাগ্য পরিবর্তনেরও রাস্তা খোলা রেখেছে! কিন্তু এসবের সাথে বিজ্ঞানের সম্পর্ক কি? এসব ছাইভষ্ম বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে কি করে  অনুপ্রবেশ করলো ?

আমাদের সরকার কি শুনবে না মেঘনাদ সাহা, রাজশেখর বসু, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, পুষ্প এম ভার্গব, নারলিকার এবং  বিশ্বের প্রাতঃস্মরণীয় ১৮ জন নোবেল পুরস্কারে ভূষিত বিজ্ঞানী সহ ১৮৬ জন বিজ্ঞানীর কথা!

সমস্ত কিছু বিবেচনা করে ফিরিয়ে নেবে না বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যোতিষশাস্ত্র পঠন পাঠনের সিদ্ধান্ত! আমরা অপেক্ষা করব, আমরা জেগে থাকব।

ঋণ স্বীকারঃ
উৎস মানুষ প্রকাশনার ‘ প্রতিরোধ’ এবং ‘ বিজ্ঞান জ্যোতিষ সমাজ ‘ – এই দুটি সংকলন পুস্তকের কাছে সবিশেষ ঋণী।

( লেখক পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞানমঞ্চের সহ-সাধারণ সম্পাদক। )

3 thoughts on “বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যোতিষ-বিজ্ঞানের অন্তর্জলিযাত্রা”

  1. খুব সুন্দর।যথেষ্ট তথ্যবহুল এবং যুক্তিগ্রাহ্য।সমৃদ্ধ হলাম।

  2. Hey, I think your ѕitе might be having browser compatibility іssues.
    When I looқ at your blog in Safari, it looks fine but when opening in Inteгnet Ꭼxploreг,
    it has some overlapping. I just wantеd to give you
    a qսick heads up! Other then thɑt, terrific blog!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!