The Mirrow

আমাদের পাঠশালা পরিক্রমা – দ্বিতীয় পর্ব

Share the Article

বিবেকানন্দ মোহন্ত

করিমগঞ্জ জেলা প্রশাসনের আহ্বানে এবং শিক্ষাদপ্তরের অনুরোধে আমরা বিভিন্ন কারিগরি বিভাগের স্টাফরা স্কুল পরিক্রমায় বেরিয়েছিলাম আজ থেকে প্রায় বছর কুড়ি আগে। স্মৃতির পাতা থেকে এবিষয়ে কিছু অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলাম ‘আমাদের পাঠশালা পরিক্রমা – প্রথম পর্ব’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে যা ওয়েব পোর্টাল ‘The Mirrow’তে বেরিয়েছিল (নভেম্বর ২০২১)। এবারের দ্বিতীয় পর্বটি সেই স্কুল পরিক্রমারই ধারাবাহিক কিস্তি। অনেক দিনের কথা, সবকিছু মনে করতে পারছিনা, তবে এইটুকু অন্তত বলতে পারি যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গুরু-শিষ্যের দিক থেকে যতটুকু ইতিবাচক সাড়া পেয়েছিলাম কিংবা বলা যায় অনুকূল পরিবেশ উপলব্ধ হয়েছিল – সে তুলনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিকাঠামোগত দিকটি ছিল বহুলাংশেই নেতিবাচক। এবারের পর্বটিও ফেলে আসা দিনগুলোরই এক আবছা অবয়বমাত্র।

-এক-

পর্ণকুটিরের বিদ্যাশ্রম :-

আমাদের এযাত্রায় পাঠশালা পরিক্রমার অন্তর্গত ছিল কায়স্থগ্রামের এক এলপি স্কুল। যে পথ ধরে এই স্কুলে যেতে হয়েছিল, সেটা শুধুমাত্র লোক চলাচলের জন্য নয় – গোবাদি পশুর জন্যও, যাকে আমরা গোপাট বলে থাকি। এই পথ ধরে ক্ষেত-খামারেও যেতে হয়, খানিক পশ্চিমে রয়েছে লঙ্গাই নদী। যাইহোক, ভরা বর্ষার মরশুম, তায় আবার কর্দমাক্ত পিচ্ছিল রাস্তা, স্থানে স্থানে সুপারি গাছের ফালা ফালা করা টুকরো বিছানো রয়েছে, এসব বেয়ে চলতে গিয়ে কিছুটা সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। পা হড়কালেই গভীর কাদায় ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তার মধ্যে যদি গোপাট হয়, তবে তো আর কোনো কথাই নেই! 

      যাইহোক, পা টিপে টিপে এই পথ ধরেই আমরা একসময় গিয়ে পৌঁছেছিলাম পর্ণকুটিরের দোয়ারে। মাটির দাওয়া, মাটির মেঝে, মুলিবাঁশের দুধারা বাইনের দেয়াল, বাঁশে আটকানো টিনের ছাউনি এসব দিয়েই গড়ে তোলা হয়েছে এই ইস্কুল বাড়িটি। চোখে পড়লো ঘরটির সামনের বারান্দা সহ শ্রেণিকক্ষের মেঝে মাটি দিয়ে লেপানো-পোছানো রয়েছে। বেশ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন, শুচিশুভ্র পরিবেশ। এসব অবলোকন করে আমার পাঠশালা জীবনের কথা মনে পড়লো, স্কুলের মাসি আমাদের বিদ্যামন্দিরের পরিবেশকে ঠিক এরকমই শুচিশুভ্র করে রাখতেন প্রতিদিন। স্নেহশীল মাস্টারমশাইও নিয়ম করে স্কুল ছুটির পর বাগান পরিচর্যায় হাত লাগাতেন, আমরা থাকতাম তাঁর সহযোগিতায়। আজকের স্কুল পরিক্রমার অন্তর্গত এই পর্ণকুটিরের প্রাঙ্গণেও রয়েছে বাহারি ফুলের বাগান, নানা বর্ণের ফুলও ফুটে রয়েছে গাছে গাছে। এই পাঠশালায় রয়েছেন দুজন শিক্ষক, তারমধ্যে একজন সরকারি কাজে নিয়োজিত হয়ে এক সমীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন, ঘুরছেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে।

        এই স্কুল পরিদর্শনে চোখে পড়লো শ্রেণিকক্ষে ব্ল্যাকবোর্ড থেকে শুরু করে ছাত্র-শিক্ষকের বসার আসনও যথাযথ রয়েছে, জানতে পারলাম এসবের অধিকাংশই মাস্টারবাবুদের নিজব্যয়ে ব্যবস্থা করা। শ্রেণিকক্ষের দেয়ালে দেয়ালে টাঙ্গানো রয়েছে মনীষীদের ছবি, রয়েছে নীতিকথামালা। এবং রয়েছে পশুপাখির ছবি সহ একাধিক মানচিত্র। ক্লাসে ঘুরে ঘুরে দেখলাম পড়ুয়াদের উপস্থিতি যথেষ্টই আশাব্যঞ্জক। উৎসুকবশত পাঠ্যসূচী থেকে বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিলাম, সঠিক উত্তরও পেয়েছিলাম ছাত্রছাত্রীদের নিকট থেকে।

         স্কুলে বসে ১৪/১৫ পৃষ্ঠার বুকলেটটি ফিল-আপ করে প্রশান্তচিত্তে বেরিয়ে পড়েছিলাম ভিনগাঁয়ের উদ্দেশ্যে। যেতে যেতে ঘাড়-ঘুরিয়ে বারকয়েক পর্ণকুটিরের দিকে তাকাচ্ছিলাম, কিন্তু বিধি বাম! অসাবধানতাবশত সুপারির ফালি এড়িয়ে পা গলিয়ে গেলো একবুক কাদায়! অচিন্ত্যবাবুর সহযোগিতায় গহীন গহ্বর থেকে উঠেছিলাম ঠিকই, তবে সাধের চপ্পলের মায়া কাটিয়ে। অতঃপর পাশের পুকুর থেকে হাত-পা ধুয়ে,খালি পায়ে কিলোমিটার খানেক হেঁটে কায়স্থগ্রাম বাজারে পৌঁছে নতুন জুতোয় পা গলিয়েছিলাম।

-দুই-

আপিন-অটবী ভূখণ্ডে :-

আমাদের এযাত্রার স্কুল-পরিক্রমার অন্তর্গত ছিল কায়স্থগ্রাম-নিলামবাজারের পশ্চিমদিকবর্তী পাথারিয়া পাহাড় শ্রেণির ইন্দো-বাংলা সীমান্তের এক অটবী ভূখণ্ডের পাঠশালা । বর্ষার মরশুম, তাই মহাসড়ক থেকে প্রায় পুরো রাস্তাই এক হাঁটু কাদা মাড়িয়ে আমাদেরকে যেতে হচ্ছিল। এই রুটেও রয়েছে কোথাও সাঁকোবিহীন অপ্রশস্ত খাল – যথারীতি গামছা পরে পেরোনো, তো কোথাও ছোটো-বড়ো নদী, ভরসা এক বাঁশের সাঁকো – কাত হয়ে থাকা তার হাতল, পা টিপে টিপে খুব সন্তর্পণে এগোনো ছাড়া গত্যন্তর নেই। এভাবেই মাইল ছয়েক পেরোনোর পর উঁচু পাহাড়ের গা বেয়ে পিচ্ছিল চড়াই-উতরাই পথ! আবার কখনো দুটো টিলার মধ্যবর্তী হাড়া পথ (সংকীর্ণ গিরিপথ) – যেখানে দুপাশের টিলা থেকে গলে আসা কাদামাটির স্রোত নিশ্চিন্তে ঠাঁই  নিয়েছে সেই হাড়ায়। এর স্থানে স্থানে উরু অব্দি গলিত কাদা, আবার কোথাও শক্ত স্লেট-মাটির ঢালু পথ থাকলেও সেটা এতোটাই পিচ্ছিল যে টাল সামলানোটাই  দায়! এভাবেই হোচট খেতে খেতে একসময় দুটো পাহাড় শ্রেণির মধ্যবর্তী এক সংকীর্ণ উপত্যকায় এসে পৌঁছেছিলাম, যার প্রস্থ কোথাও ৪০/৫০ মিটার, কোথাও একটু বেশি। এই সমতল ক্ষেত্রের পূর্ব-পশ্চিম দুদিক জুড়েই রয়েছে পরস্পর সমান্তরাল শৈলশ্রেণি, এবং এদের বুক নিঃসৃত চুঁয়া জল নেমে এসে সমতল ক্ষেত্রকে একপ্রকার আদ্র,জলাভূমি করে রেখেছে প্রায় সারাবছরের জন্য। স্থানে স্থানে খানিক উঁচু তথা শীর্ণকায়া আল বেয়েই তবে আদ্রভূমি অতিক্রম করে ওপাশের টিলার পাদদেশে পৌঁছোনোর ব্যবস্থা। তারপর সুপারি গাছের পৈঠা দেওয়া গোটা দুশো সিড়ি ভেঙ্গেই তবে টিলার উপর বিচ্ছিন্নভাবে দাঁড়িয়ে থাকা একেকটি বসতভিটায় পৌঁছোনোর বন্দোবস্ত।

      যাইহোক, পূবদিকের পাহাড় ডিঙিয়ে, উপত্যকায় পৌঁছে স্কুলবাড়ির কোনো চিহ্নই দেখতে পেলাম না, অথচ ঠিকানা অনুযায়ী এঅঞ্চলেই তো থাকার কথা! কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর পথচারী একজনকে পেলাম যিনি হাড়া পেরিয়ে আসছেন। তাঁকে মাস্টারমশাইর নাম জিজ্ঞেস করে বললাম তার ঘর কোথায়। পথচারী পশ্চিমের টিলার দিকে আঙুল নির্দেশ করে বললেন ঐ দূরে টিলার উপর যে বাড়িটি দেখা যাচ্ছে – সেটিই। তাঁর কথামতো সংকীর্ণ উপত্যকার আল ধরে এগোতে থাকলাম। যেতে যেতে টিলাবাড়ির দিকে একঝলক চোখ বুলিয়ে দেখতে পাই একজন পুরুষ ও একজন  মহিলা ঐ বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে। মনে হলো ওঁরা আমাদের দেখে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছেন। যাইহোক টিলার পাদদেশ অব্দি পৌঁছে সেখান থেকে সিড়িভাঙ্গা শুরু করলাম। এভাবেই প্রায় গোটা দুশো সুপারির পৈঠা দেওয়া সিড়ি বেয়ে উঠোনে নেমে একমাত্র মহিলাকেই শুধু দেখতে পেলাম।  জিজ্ঞেস করলাম – “এটাই কী মাস্টারমশাইর বাড়ি?”,  কিছুটা ইতস্তত করে মাথানেড়ে সায় দিলেন। বললেন – “আপনারা কই থাকি আইতরা?” আমাদের আসার উদ্দেশ্য তাঁকে জানানোর পর বললেন – “ও,তাইন তো খুব অসুস্থ, আইজ ক’দিন থাকি একেবারেই বিছনাত।”

আমাদের পীড়াপীড়িতে একসময় বললেন – “ঠিক আছে, একটু বইন ওখানো।”

মহিলার কথামতো আমরা দাওয়ায় উঠে বহু পুরোনো এবং  জরাজীর্ণ কাঠের বেঞ্চে বসলাম। চোখ বুলিয়ে দেখলাম এই বাড়িতে দুটো ঘর রয়েছে, তারমধ্যে একটি বাথান বা গোয়ালঘর, রয়েছে গোবাদি পশু বেঁধে রাখার জন্য পাঁচ-ছয় ফুট উঁচু উঁচু বেশ কয়েকটি খুঁটি এবং সাথে রয়েছে পাটের দড়িও। বুঝা গেল দুপুর অব্দি এই ঘর পরিস্কারে হাত পড়েনি, গোবর-ছাগলের বিষ্ঠা সারা ঘর জুড়ে। 

ওদিকে বসতঘরের দাওয়ায় বসাটাও দায় হয়ে পড়েছে! দু’তিন জোড়া কবুতর বক্ বুকুম, বক্ বুকুম সুর তুলে ঘুরছে সারা বারান্দায়, বিষ্টা ত্যাগ করছে এখানে-ওখানে। এরমধ্যে ঘাত ঘাত ঘাত করে হেলেধুলে এসে হাজির হলো কয়েকটি দেশীয় গোত্রের হাঁস, সাথে গোটাকয়েক চিনা হাঁসও। ওরা দিব্যি উঠোন পেরিয়ে  ঢুকে যাচ্ছে অন্দরমহলে, এবং যেতে যেতে সহজাত প্রবৃত্তি নিয়ে  তাদের সই-স্বাক্ষর-সাবুদ রেখে যাচ্ছে দাওয়ার বুকে। ষোলোকলা পূর্ণ করতে খক্ খক্ করে  এবার মঞ্চে আগমন ঘটলো বাচ্চা-কাচ্চা সমেত রামপারো, ওরা আবার বাইরে থেকে নয়, সটান অন্দরমহল থেকে। যথারীতি তাদের আইডেন্টিটিও রেখে যাচ্ছে বারান্দা জুড়ে। অচিন্ত্যবাবু বললেন – “চলুন দাদা,এখানে আর বসা যায়না!”

আমাদের কথাবার্তার মাঝে ঘরের ভিতর থেকে কার যেন গোঙানির আওয়াজ শুনতে পেলাম, মনে হলো মুমূর্ষু রোগীর কাতর স্বর। ক্ষীণস্বরে বলছেন -”বারে কারা আইছইন গো?”   মহিলা বললেন – “করিমগঞ্জ থাকিয়া দুইজন আইছইন, তোমার লগে ইসকুলর বেপারে কিতা কাম আছে।” মহিলার কথা শুনে উনি কী বলছিলেন সেটা স্পষ্ট শোনা যায়নি।

যাইহোক, বেশ কিছুক্ষণ ঠায় বসে থাকার পর মহিলাটি এসে বললেন – “আপনারা ঘরো আইন, তাইন বিছনাত।”

অগত্যা আমরা মাস্টারমশাইর বেডরুমে ঢুকে দেখলাম ভাদ্রের এই কাঠফাটা গরমেও উনি চাদর মুড়ি দিয়ে শোয়ে রয়েছেন। তাঁকে দেখেই আমাদের চক্ষু চড়কগাছ ! মাঠ পেরিয়ে টিলা বেয়ে উঠতে গিয়ে তাঁকেই তো দেখছিলাম উঠোনে! এরমধ্যেই শয্যাশায়ী! আমরা আর কথা না বাড়িয়ে বললাম “আপনাদের স্কুল দেখতে এসেছি।”

“সেটা আর পাবেন কোথায়? গতবছর তুফানে উড়িয়ে নিয়ে গেছে, উপর মহলে লেখালেখি করেছি, দেখাও করেছি দু’একবার, কিন্ত কোনো কিছুই আর হয়ে ওঠেনি। সেই তখন থেকে আমার ঐ ঘরে স্কুলের কাজ চালিয়ে যেতে হচ্ছে।” – একথা বলে তিনি গোয়াল ঘরের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন। অবাক বিস্ময়ে বললাম – “এই ঘর তো আজ এখনো অব্দি পরিস্কারই করা হয়নি, তাহলে এতো খুঁটির ভিড়ে ছাত্ররা বসেছিল কোথায়?” “ইস্! আপনারা যে আজই আসছেন, একথা আগে জানালেই তো পারতেন, তাহলে যতই পরব থাকুক ওদেরকে কখনো  ছুটি দিতাম না।” বলে তিনি কপালে হাত ঠেকালেন। অর্থাৎ দোষটা আমাদেরই!

কথা বলতে বলতে মুমূর্ষু মাস্টারমশাইকে নিয়ে আমরা বারান্দায় বেরিয়ে আসলাম। কিন্তু ওখানকার পরিবেশ অনকূল না থাকাতে উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। একটু এগিয়ে গিয়ে টিলার পাদদেশের স্কুলবাড়ির জায়গাটি দেখিয়ে হতাশ সুরে বলেলন –“ঐ ওখানেই ছিল স্কুলটি!”

উঠোনে দাঁড়িয়ে তাঁর সাথে আলাপচারিতার ফাঁকে কোথা থেকে এবার উদয় হলো বাচ্চা-কাচ্চা সমেত সাত-আটটি ভেড়া (মেষ)। মাথা ন্যাড়া থাকলে বোধকরি চেনাই যেতনা ওরা কোন প্রজাতির অর্থাৎ কোন গোত্রের অন্তর্গত। কি বীভৎস ওদের গোটা অবয়ব! একমাত্র মাথা বাদে সমস্ত শরীর লোমবিহীন নিকষকালো তেলচিটচিটে, ঠিক যেন লোমবিহীন কালো তেলচিটচিটে রাস্তার সারমেয়! ওরা অচেনা অতিথিদের পেয়ে এবার আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সদলে। গা শুঁকে শুঁকে দেখতে লাগলো, দু’একটি আবার জিভ বের করে চাটতেও শুরু করছিল। আমাদের সারা গায়ে ঘিন্ ঘিন্ ভাব ধরিয়ে দিয়ে কুলীন ব্রাহ্মণকুলোদ্ভব মাস্টার মশাই তৃপ্তির হাসি হেসে বললেন – “ওদের লোম কামিয়ে সোজা লেপে ঢুকিয়ে দিয়েছি, খুব উম্।”

-তিন-

“লালন বলে জাতের কি রূপ——“

জেলা প্রশাসন ও শিক্ষাদপ্তরের অধীনে TRP-র (Technical Resource Person) দায়িত্ব নিয়ে মাঠে নেমে এযাত্রার সমীক্ষার অন্তর্গত ছিল জেলাসদরের উপকন্ঠীয় অঞ্চলের হাওর বেষ্টিত গাঁ-গঞ্জের কয়েকটি পাঠশালা। যেহেতু এলাকাগুলো শহর থেকে বেশি দূরে নয়, তদুপরি আকাশের গতিবিধিও তেমন গা-জ্বলা ধরার মতো নয়, তাই ভেবেছিলাম পিঠে ভারী বোঝা নিয়ে বেরোনোর তেমন দরকার নেই। জাতীয় সড়কের পাশেই রয়েছে ছোটোখাটো স্টল, তেমন প্রয়োজন হলে খাওয়ার জলটল ওখানেই পেয়ে যাব। এইসব সাত-পাঁচ চিন্তা করে পিঠের বোঝা একপ্রকার হালকা করেই বেরিয়ে পড়েছিলাম। যথারীতি করিমগঞ্জ থেকে রওয়ানা হয়ে আসাম-আগরতলা রোডের শরিফনগর-ভগিচগি পয়েন্টে এসে পশ্চিমদিক বরাবর হাঁটা শুরু করছিলাম। ক্ষেত-জমিনের আল ধরে কোনাকুনি হেঁটে কিলোমিটার কয়েক দূরের গ্রাম নলুয়া এবং সন্নিহিত অঞ্চলের একাধিক স্কুলের সমীক্ষা চালিয়েছিলাম এই পর্বে। এই পরিক্রমায় উপলব্দি হলো যে স্কুলের সার্বিক পরিকাঠামোর সাথে পুরোপুরি মানানসই রয়েছে পড়ুয়াদের উপস্থিতি এবং তাদের পড়াশোনার সন্তোষজনক পরিবেশ। নলুয়ার স্থানীয় ভূস্বামী কমলেশবাবুর পূর্বপুরুষের প্রতিষ্ঠিত এখানকার এলপি এবং এমই স্তরের শিক্ষা ও শিক্ষাঙ্গণ পরিক্রমা আমার পাঁক-কাদা মাড়িয়ে আসার পথশ্রমকে সার্থক করে তুলেছিল বললে মোটেই অত্যুক্তি হবেনা। এখানে এসে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের আতিথেয়তার কথাটি আজও মনে পড়ছে।

যাইহোক, এবার তাঁদেরকে বিদায় জানিয়ে হাঁটা শুরু করলাম, উদ্দেশ্য তিনঘরি-তেলিখালরপার গ্রামাঞ্চলের স্কুল পরিক্রমা। হাইওয়েতে এসে দোকানপাট থাকলেও সেদিকে নজর দিইনি, বরং জমির আলধরে রেললাইনের দিকে পা-বাড়িয়েছিলাম। আকাশের ভাবটাও তেমন সুবিধের ঠেকছেনা, চড়া রোদ জাঁকিয়ে বসা শুরু করছিল। শ-তিনেক মিটার পেরিয়ে উঁচু রেললাইনে দাঁড়িয়ে থেকে পূবদিকের হাওরটি দেখে মনে হল এ আর এমন কী! ঐটুকুনই তো তার বহর! তার চেয়ে অনেকগুণ বড়ো হাওর পেরিয়ে পদ্মারপার- দুল্লভপুর কিংবা আলমখানি থেকে মেঘনা-বড়ান্তর – তালতলার সমীক্ষা চালিয়েছিলাম। সেই তুলনায় তিনঘরি-তেলিখালরপারের এই হাওরটি গা-গতরে তেমন সমীহ জাগানোর মতো মোটেই নয়। ঐ তো সামনেই দেখা যাচ্ছে শিরিষ – জারুলের ছায়াঘেরা তিনঘরি-তেলিখালোরপার! তাচ্ছিল্যভরে রেললাইনের ঢালুপথ বেয়ে জমিনের আল ধরলাম। ডানে-বামে-সামনে পাঁক-কাদায় ভরা আদ্র-জলাভূমি, সেখানে হাল নিয়ে মাঠে নামার মতোও পরিস্থিতি নয়। দেখলাম  ইতস্ততভাবে ছড়িয়ে থাকা মহিষগুলো প্রায় আধডোবা হয়েই বিচ্ছিন্নভাবে মাথা উঁচিয়ে থাকা মানুঘাস-কচুরিপানা সাবাড় করে চলছে এবং সময় সময় তেষ্টা মেটাচ্ছে এই পাক-কাদা থেকেই। এইসব দেখতে দেখতে আলধরে হাঁটছিলাম, কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমশ প্রতিকূল হয়ে দাঁড়াচ্ছিল ! মাথার উপর তপ্ত অগ্নিগোলক, পায়ের নীচে উষ্ণ কাদা, পিচ্ছিল পথে বারে বারেই হোচট খাচ্ছি। এভাবে অনেকক্ষণ হেঁটে যাওয়ার পর পিছন ফিরে তাকিয়ে রেললাইনটিকে দেখলাম, যেনো আমার কাছেই রয়েছে – অর্থাৎ এতটুকু হাঁটার পরও মনে হলো যেন ওটাকে পিছনে ফেলে এগোয়নি বেশিদূর! সামনে তাকিয়ে দেখলাম শিরিষ-জারুলের ছায়াঘেরা গ্রামটি যেন রি রি, আবছা দেখা যাচ্ছে দূরে-বহুদূরে! মনে হলো গন্তব্যের দিকে যেন সিকিভাগও এগোইনি! এবার হাঁড়েহাঁড়ে টের পাচ্ছিলাম পিঠের বোঝা খালি করার কী হাল! তারই কসরত এখন গুনতে হচ্ছে একেবারে কড়ায়-গণ্ডায়!

দেখলাম সামনের আকাশে এক খণ্ড মেঘ পশ্চিম থেকে পূবদিকে চলে যাচ্ছে বেশ জায়গা জুড়ে। ছুটে চলছে তিনঘরি-কালীগঞ্জের দিকে। প্রাণপনে ছুটলাম যাতে ওটার নীচে গিয়ে একটুখানি দাঁড়াতে পারি, কিন্তু হায় কপাল! আমার ছোটার গতিবেগটি সেটার ধারেকাছেও পৌঁছে যাওয়ার মতো ছিলোনা। আমাকে পেছনে রেখেই একসময় ছায়াটি হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো! ওদিকে জলতৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যাওয়ার উপক্রম, এবার বুঝলাম একবিন্দু পানীয় জলের কী মহিমা! গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। বিস্তীর্ণ এই জলামাঠে একজনও কৃষক চোখে পড়েনি। আছে শুধু মহিষকূল। নিরুপায় হয়ে আলপথের ধারে মহিষের ক্ষুরের চাপে গর্ত হয়ে থাকা পরিসরটুক খুঁজতে লাগলাম, পেয়েও গেলাম একটি। কিন্তু সেই গর্ত থেকে এক আজলা জল তুলতে গিয়েই বিপত্তি! অনধিকার হস্তচালনার খেসারত গুনতে হলো। একটি দশাসই চেহারার কাকড়ার সেটা সহ্য হয়নি, তাই হাতিয়ার চালিয়ে বহিরাগতকে আচ্ছা-সাবুদ করতে কোনো কার্পণ্য করেনি। অন্য আরেক গর্তে হাত ঢুকিয়ে এক আজলা জল যদিও তুলেছিলাম, কিন্তু ছোটোবড়ো কীটের সমাহার, রয়েছে ‘আঙ্গুল কাটরিও’, এদের দংশনের জ্বালা যে কী, সেটা কেবল ভুক্তভোগীরাই বলতে পারবেন। ভীষণ হিংসে হচ্ছিল মহিষগুলোর জন্য, ওরা কি আনন্দেই আছে, মাঝে মধ্যে শোয়ে-বসে কাদায় গড়াগড়ি করে শরীরের জ্বালা জুড়িয়েও নিচ্ছে!

আজ দুঃখ হয়, সৃষ্টিকর্তা আমাদের পাঠিয়েছেন ঠিকই, তবে কাঠামো গড়ে তুলতে গিয়ে আয়ুঃসীমা এবং মেধার দিকে যতটুকু মনোযোগ দিয়েছেন, কিংবা অন্যের উপর ছড়ি ঘুরাবার যে ক্ষমতাটুকু দরাজ হাতে তুলে দিয়েছেন, তার তুলনায় সহ্যশক্তি এবং বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ পরিকাঠামোর প্রতি তেমন যত্ন নেননি, এখানেই বিপত্তি!

যাইহোক পরিস্থিতি যখন এতোটাই বিপন্ন হয়ে উঠেছিল, তখন প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূণ্য হয়ে এবার ছোটা শুরু করলাম এবং একসময় তিনঘরির জারুলতলায় গিয়ে পৌঁছেছিলাম। দেখলাম বাঁ-পাশেই রয়েছে  মাঝারি গোছের একটি পুকুর, কিন্তু মুলিবাঁশের বেড়া! এজাতীয় ফেন্সিং এতটাই ফ্লেক্সিবল থাকে যে, সেটা ভাঙ্গা তো দূরের কথা, ডিঙিয়ে যাওয়ারও জো নেই। ফেন্সিংয়ের উপরিভাগটি এতোটাই  ধারালো এবং সূচ্যাগ্র থাকে যে, পেরোতে গেলেই বিপত্তি,নির্ঘাত জখম হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। গোবাদি পশুদের ক্ষেত্রেও এজাতীয় ফেন্সিং দুর্লঙ্ঘ, মাথা গলালেই শিংযুগল পরস্পর সমান্তরাল কামিজের জালে আটকা পড়বেই। সুতরাং উপায় খুঁজে ব্যর্থ  হয়ে দৌড় লাগালাম, কিছদূর এগিয়ে বাঁদিকে মোড় ঘুরতেই চোখে পড়লো একটি পাকা মসজিদ, রয়েছে শানবাঁধানো পুকুরঘাট! এবার সোজাসুজি মসজিদে ঢুকে ব্যাগ ছুড়ে ফেলেই পুকুরে নেমে পড়লাম। সেখানে কোমর অব্দি জলে দাঁড়িয়ে মাথা ডুবিয়ে আকন্ঠ জল গিলেছিলাম। মনে হলো এযাত্রায় বুঝি নির্ঘাত প্রাণ ফিরে পেলাম। এভাবেই জলে কিছুসময় দাঁড়িয়ে থেকে,খানিক ধাতস্থ হয়ে মসজিদের বারান্দায় উঠে সটান শোয়ে পড়েছিলাম। আর কিছু মনে নেই।

যখন সম্বিত ফিরে এলো, চোখ খুলে দেখেছিলাম বালিশে শিয়র রেখে শীতল পাটিতে শুয়ে রয়েছি আমি এবং পাশে বসে একনাগাড়ে হাতপাখা চালিয়ে যাচ্ছেন মসজিদের ইমাম সাহেব। পরম স্নেহভরে হাত বুলিয়ে যাচ্ছেন মাথায়-মুখমণ্ডলে। ঘড়ি দেখে বুঝলাম কম করেও ঘন্টা দুয়েক জুড়ে মহানুভব ইমাম সাহেব এরূপ  আর্ত-পরিষেবায় রত ছিলেন। সেদিন  তাঁর খিদমতেই বোধকরি বেঁচে ফিরেছিলাম। ঘটনাটি বছর কুড়ি আগের, ইমাম সাহেবের বয়স তখন ছিল সম্ভবত ৬০/৬২ বছর, আজ জীবিত থাকলে বয়সটি আশির কাছাকাছি যেতে পারে। তাঁর উদ্দেশ্যে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

আজ মনে হচ্ছে ভরা ভাদ্রমাসে সেদিনের প্রতিকূল পরিস্থিতি, প্রচণ্ড রৌদ্রতাপ, ক্ষেত-জমিনের আদ্র পরিবেশ, তদুপরি তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাওয়ার মতো অবস্থা, এইসব আমাকে যে পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়েছিল – চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় সেটাকেই বোধহয় বলে হিট স্ট্রোক কিংবা সান স্ট্রোক!

এবার উঠতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু ইমাম সাহেব পাখা চালাতে চালাতে বললেন – “বাছাই (অর্থাৎ বাপু) আরও কিছুক্ষণ জিরিয়ে নাও।”

-চার-

রামকৃষ্ণমিশন প্রতিষ্ঠিত পাঠশালা পরিক্রমা :-

আমাদের এবারের সমীক্ষার অন্তর্গত ছিল দুর্ল্লভপুর এবং পদ্মারপারের বিদ্যালয়গুলো। যথারীতি করিমগঞ্জ জংশন থেকে ট্রেনে করে সুপ্রাকান্দি।সেখান থেকে কিলোমিটার খানেক হেঁটে বাঁদিকে নেমে কিছুদূর এগোলেই দুর্ল্লভপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়। সচরাচর যা হয়ে থাকে, স্কুল অব্দি পুরো রাস্তাই হাঁটা-চলার ক্ষেত্রে প্রচণ্ড প্রতিকূল, কচি-কাচারাও বাধ্য হয়ে এটিই ব্যবহার করে। দেখলাম এতো প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়েও পড়াশোনার প্রতি তাদের খুবই আগ্রহ। এবং বাৎসরিক রেজাল্টও চোখে পড়ার মতো। উৎসুকবশত বিভিন্ন শ্রেণির পড়ুয়াদেরকে পাঠ্যবই থেকে প্রশ্ন করে সঠিক উত্তরই পেয়েছিলাম। এইসব আমার অবর্ণনীয় কায়িক শ্রমকে তৃপ্তি দিয়েছিল বললে অত্যুক্তি হবেনা। দেখলাম স্কুলবাড়ি এবং এটির পরিকাঠামোগত দিকটি বেশ সন্তোষজনক। এবার এই স্কুল থেকে বেরিয়ে পরবর্তী গন্তব্যের দিকে পা টিপে টিপে খুব সন্তর্পণে এগোতে লাগলাম, দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী পদ্মারপার গ্রামেও রয়েছে একটি স্কুল। এখানে উল্লেখ্য যে, একটু খোঁজ নিলে দেখতে পাবেন পদ্মারপার নামের জনবসতি রয়েছে করিমগঞ্জ জেলার একাধিক স্থানে, যেখানে জল-জলাভূমি রয়েছে, এবং পেশাগত দিক দিয়ে মাছধরার ব্যাপারও রয়েছে। এবং অতি অবশ্যই রয়েছে মা-মনসা-পদ্মাদেবী আরাধনা, পদ্মাপুরাণ পাঠ, মনসামঙ্গল এবং ওঝানৃত্য। পদ্মারপার নামের এইসব জনবসতিতে রয়েছেন নামকরা ওঝা এবং পাঁখোয়াজ বাদক (বায়েন)। রামকৃষ্ণনগরে আমাদের প্রতিবেশি এলাকায়ও রয়েছে পদ্মারপার গ্রাম, সামনে সিঙ্গী নদি এবং পশ্চাতে রয়েছে দিগন্তবিস্তৃত হাওর। কিলোমিটার খানেক এগোলেই শনবিল ও উপকন্ঠীয় অঞ্চল। গতানুগতিক পারিবারিক পেশার সমান্তরালে এখানেও রয়েছে দেবীমনসা-বন্দনার শত শত বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।

যাইহোক, দুর্ল্লভপুর পেরিয়ে প্রায় কিলোমিটার খানেক একবুক পাক-কাদার রাস্তা অতিক্রম করার পরই এখানকার পদ্মারপার গ্রামের নাগাল পাওয়া গেলো, হাওরের বুকে গড়ে ওঠা জলজ মহীরূহের ছায়াঘেরা এই পিছপড়া গ্রামটি করিমগঞ্জ রামকৃষ্ণমিশন সেবা-প্রতিষ্ঠানের সুনজরে রয়েছে। গ্রামের মাঝবরাবর বয়ে চলেছে বেশ প্রশস্ত খাল, পূবদিকের হাওর থেকে নেমে এসেছে, এটি হেমন্তে এইটুকুন, কিন্তু বর্ষায় তার তাণ্ডব বেশ সমীহ জাগানোর মতোই। খালের পাশ দিয়ে চলা এই পথধরে এগোলে চোখে পড়বে একবাঁশের সাঁকো, যথারীতি কাত হয়ে থাকা তার হাতল। স্কুলে যেতে হলে এই সাঁকো পেরোতে হয়। এই স্থানে পৌঁছনোর একটু আগে থেকেই কচি-কাঁচাদের কোরাসের সুরে নামতাপড়া কানে আসছিল-বারো একে বারো, বারো দুগুণে চব্বিশ, তিন বারো ছয়ত্রিশ,চাইর বারো চৌচাল্লিশ। শুনলাম ঠাস ঠাস করে বেতের বাড়ি পড়ছে কার পিঠে। গুরুজী বলছেন আবার পড়ো। ওরা আবার কোরাসে সামিল হলো। এবার গুরুজীর গুরুগম্ভীর নিনাদে ক’ঘা বেতের বাড়ি পড়লো কার যেন পৃষ্ঠদেশে, তিনি বলছেন “এই  সুনীল তুই মানুষ ওইতেনায়, কোন্ সময় অঙ্ক ইগু করার লাগি দিছি, এখনো করডে।” – পড়লো আরও গোটা দুয়েক ঘা। পরক্ষণেই – “এই নিবারণ,  তোর ইসকুলো আইবার দরকার নাই, প্রসিদ্ধ স্থান মুখস্থ করার কথা কইসলাম, ওখনো একলাইনও পড়া দিতে পারডে না।” যথারীতি দু’ঘা পড়লো ওর পিঠেও।

এই পথ ধরে আসতে আসতে মনে হলো, মাস্টারমশাই খুবই নির্দয়, বেতের বাড়ি-টাড়ি এইসব কবেই উঠে গেছে। রামকৃষ্ণনগর উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে স্কুলজীবনে আমার পৃষ্ঠদেশেও এরূপ কয়েক ঘা পড়েছিল। আমার দোষ ছিল চিত্রাঙ্কনের পুরোধা বীরেন্দ্রলাল ভৌমিকের চিত্রাঙ্কন বইয়ের পেছন দিকের মলাটের বাইরে কাঠপেন্সিল চালানোর যে নিয়মাবলী – ‘প্রথমে বি মার্কা পেন্সিলের দাগ দিতে হবে——-।’ ইত্যাদি বেশ বড়ো এক প্যারাগ্রাফ মুখস্থ করে আসার কথা ছিল। কিন্তু সেটা আমি করিনি এইভেবে যে, দিনকয়েক আগে তৈলমর্দন করা জালিবেতটি আমিই বানিয়ে এনেছিলাম আমাদের বাড়ির বেতছুবি থেকে। এবং বলাবাহুল্য যে, সেটি এনেছিলাম চিত্রাঙ্কনের মাস্টারমশাই গোপেন্দ্র ভট্টাচার্য মহাশয়ের অনুরোধ কিংবা নির্দেশে। সেদিন বেঞ্চে দাঁড়িয়ে চিত্রাঙ্কনের নির্দেশিকাটি পুরোপুরি মুখস্থ করেই তবে ছুটি পেয়েছিলাম। সেটা ১৯৭১-৭২ সালের কথা।

যাইহোক পদ্মারপার খালের পার ধরে হাঁটতে গিয়ে এইসব শুনতে শুনতে একসময় নজরে পড়লো স্কুলবাড়িটি। সাঁকো পেরিয়ে দেখলাম ১৯৫০ ইংরেজিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘৫১৭ নং শ্রীরামকৃষ্ণ প্রাথমিক বিদ্যালয়।’ উঁচু ভিটায় টিনের ছাউনি দেয়া পলেস্তারা বিহীন ইটের দেয়াল, আর সি সি খুঁটি, গোটা পাঁচেক কাঠের দরজা। হিজল-তমাল-জারুলের ছায়াঘেরা এই বিদ্যানিকেতনে রয়েছে দখিনা হাওয়ার জন্য অবারিত দ্বার, সেজন্য রয়েছে ১০/১২ টি বাতায়নও। লম্বা বারান্দায় বসে সবকটি কক্ষই খেয়াল রাখা যায় স্পষ্টভাবেই। প্রবীন মাস্টারমশাইকে দেখে পথের পাঁচালি সিনেমার তুলসী চক্রবর্তীর কথা মনে পড়লো। দেখলাম মাস্টারমশাই বারান্দার খুঁটিতে হেলান দিয়ে শীতল পাটীতে বসে রয়েছেন, তাঁর সামনে দুই ফুট × আড়াই ফুট মাপের বেতের চাটাই, ওটার উপরই রয়েছে বেশ যুৎসই মাপের জালিবেত (ছড়ি)। এবং এখানে বসেই চাটাইর উপর নির্দয় প্রহার করে অমনোযোগি পড়ুয়াদের সাবুদ করছেন!

এই বিদ্যালয়ে কোনো ধরণের ফার্নিচার নেই। মাস্টারমশাই যেভাবে পাটি-চাটি নিয়ে বসে নিষ্ঠার সাথে গুরুদায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন, প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত অন্যূন ১৫০ জন পড়ুয়ারাও এভাবেই তপোবনাশ্রমের শিক্ষার পাঠ নিচ্ছে। তবে ব্যতিক্রমও রয়েছে, নিজ নিজ বাড়ি থেকে নিয়ে আসা তাদের বসার আসনটি রঙিন সুতোর কাজের এবং খানিকটা ভারী, সেটা নিশ্চিতরূপেই গ্রামবরাকের সূচীশিল্পের এক অনন্য নিদর্শন। স্কুলের দেয়ালে দেয়ালে রয়েছে মাস্টারমশাইর নিষ্ঠার ছাপ, রয়েছে মনীষীদের ছবি, নীতিকথামালা এবং টাঙানো রয়েছে প্রয়োজনীয় মানচিত্রও। মাস্টারমশাইকে নিয়ে শ্রেণিকক্ষে গিয়ে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির পড়ুয়াদের বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে চটজলদি উত্তরও পেয়েছিলাম। দেখলাম একজন নিষ্ঠাবান গুরুজীর তত্ত্বাবধানে এই স্কুলে পাঠদান চলছে খুব ভালোভাবেই। আমার চোখে তিনি যথার্থই একজন আদর্শ শিক্ষক। আলাপচারিতায় তিনি বললেন, চাকরি রয়েছে আর মাসছয়েক। জিজ্ঞেস করলাম উনি কি একাই এই স্কুলের শিক্ষকতার দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। জানালেন – “রয়েছেন আরও দুইজন, কিন্তু সরকারি দায়িত্ব নিয়ে তাঁরা গ্রামে গ্রামে ঘুরছেন।” বুঝলাম ওঁরাও নিশ্চয় সমীক্ষার কাজে নিয়োজিত হয়ে রয়েছেন।

সেদিন মাস্টারমশাইর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে স্কুল পরিক্রমাটি শেষ করেছিলাম। আজ তিনি ইহজগতে বেঁচে আছেন কী না জানিনা, তবে তিনি আমার মনে চিরঅক্ষয় হয়ে থাকবেন।

-শেষকথা-

সরকারি নির্দেশে আজ থেকে প্রায় বছরকুড়ি আগে পাঠশালা পরিক্রমায় বেরিয়ে অনেক বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। এই অবসরে লোকায়ত পরিসরকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ ঘটেছিল।  ক্ষেত্রপরিক্রমায় বেরিয়ে যেমন অনেক আদর্শ ও নিষ্ঠাবান গুরুমশায়ের সাক্ষাৎলাভ হয়েছিল, তেমনি ব্যতিক্রমও ছিল। আমাদের এই সমীক্ষার অন্তর্গত ছিল প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ভাদ্রের কাঠফাটা রোদে চরম প্রতিকূল যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সমীক্ষা চালাতে গিয়ে বারে বারেই ভাবিত করে তুলেছিল নিষ্পাপ শিশুদের কথা। এরূপ বিপদ-সংকুল পথ ধরেই তো তাদেরকে পাঠশালায় পৌঁছতে হতো! ওদের ক’জনেরই বা মাথায় ছাতা থাকত! আমাদের স্কুল পরিক্রমার অন্তর্গত ছিল অ্যাপ্রোচের হাল হকিকত, স্কুলভবনের সার্বিক পরিকাঠামো, পঠন-পাঠনের পরিবেশ-পরিসর ইত্যাদি। আপ্রাণ চেষ্টা করেছি সমীক্ষার মাধ্যমে এইসব চিত্র বিধৃত করার, যাতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা ফলপ্রসূ হয়েছিল। আজ শহর তথা গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিকাঠামোগত দিকটির পাশাপাশি স্কুলমুখী যোগাযোগ ব্যবস্থার যেটুকু উন্নয়ন সাধিত হয়েছে, নির্দ্বিধায় বলা যায় এটি  সেদিনের স্কুল পরিক্রমারই ফসল।

আরেকটি কথা এখানে উল্লেখ করতেই হয়, সময়ের স্রোতে স্কুলশিক্ষকরা পরিণত হয়েছেন ‘হলদির গুড়ায়’, জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠের দায়িত্ব তাঁদের উপরই বর্তায়। ইদানিংকালে আরও ভিন্নতর সংযোজনও ঘটেছে তাঁদের কার্যতালিকায়। সেটা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় হোক কিংবা সেন্সাস ডিউটিতেই হোক – স্কুলশিক্ষক অপরিহার্য। এসব দায়-দায়িত্বের বাইরেও ইকোনমিক সেন্সাস থেকে শুরু করে অন্যান্য গুরুদায়িত্ব তাঁদেরই সামলাতে হয়। এইসব ছাড়াও NRC’র গুরুভার থেকেও তাঁরা রেহাই পাননি। চাকরি জীবনে কোনো এক জায়গায় LRCR এর দায়িত্ব বর্তেছিল আমার উপর, সহকর্মী হিসেবে ছিলেন জনাকয়েক স্কুলশিক্ষক। তাঁদের মধ্যে প্রায় দুশো ছাত্রসংখ্যার পাঠশালায় কর্মরত তিনজন শিক্ষকের মধ্য থেকে দুইজনকেই নিয়োগ করা হয়েছিল এই নাগরিক সেবাকেন্দ্রে (NSK)। এক্ষেত্রে কচি-কাঁচাদের পড়াশোনার ব্যাপারটি বোধকরি গৌণ কিংবা অপ্রাসঙ্গিক ঠেকেছিল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে। নির্বাচন, বিভিন্ন সমীক্ষা, সেন্সাস থেকে শুরু করে নাগরিপঞ্জী নবায়ন প্রক্রিয়া এইসব কর্মযজ্ঞে কস্মিনকালেও রাজগোত্রীয়দের মাঠে-ময়দানে নামতে দেখিনি আমার সুদীর্ঘ চাকরি জীবনে।

স্কুলপরিক্রমার ক্ষেত্রে আমরা ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের স্টাফদেরকে TRP’র দায়িত্ব তুলে দেয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনার অভাব ছিল। প্রথমত তাঁরা আমাদেরকে কোনো রুটম্যাপ দেননি। সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবস্থান নিয়েও তাঁদের ধারণা খুবই সীমিত ছিল। স্কুলের লিস্ট’এ রয়েছে অত নম্বর এলপি স্কুল, কিংবা এই নামীয় এমই বা এমভি স্কুল। এখানে গ্রামের নাম বা ঠিকানার কোনো উল্লেখ নেই। বলা হয়েছিল অমুক জায়গায় গিয়ে অমুকের সাথে যোগাযোগ করবেন। অর্থাৎ আমাদেরকে দিশাহীন হাওরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। সেকারণেই প্র্যাকটিক্যাল ফিল্ডে নেমে ভরা ভাদ্রের কাঠফাটা রোদে হাওর-পাহাড় ডিঙিয়ে যে এম ই স্কুলে গিয়ে পৌঁছেছিলাম, সেই একই ক্যাম্পাসে রয়েছে অত নম্বর এল পি স্কুল, যেটির সমীক্ষার দায়িত্ব তুলে দেয়া হয়েছিল আরেকজনের উপর। স্কুলের অবস্থান নিয়ে কর্তৃপক্ষের অজ্ঞতার ছাপ এখানে স্পষ্টতই প্রতীয়মান। তাছাড়াও এটি সর্বজনবিদিত যে, সংশ্লিষ্ট বিভাগের চরম গাফিলতির জন্য আসাম-আগরতলা জাতীয় সড়কটি বছর দুয়েকের জন্য পুরোপুরিভাবে বন্ধ ছিল। ভরসা রেলপরিষেবা, সেখানেও চালে-পিঠে ঝুলে যেতে গেলেও তিলধারণের জায়গা নেই। এই যেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিস্থিতি, সেখানে একেকজনের ৭০-৮০টি স্কুল সমীক্ষার জন্য বেঁধে দেয়া হয়েছে মাত্র ১৫ দিন সময়! আমরা পাগলের মতো ছুটেছি, কখনো হাঁটাপথে বনবাদাড় ভেদ করে ইন্দোবাংলা সীমান্তের পাথারিয়ার কোলে কোলে, আবার কখনো দিগন্তবিস্তৃত হাওর পেরিয়ে দোহালিয়ার আনাচে-কানাচে।

স্কুলপরিক্রমায় নেমে যোগাযোগের ব্যবস্থাটি যেমন ছিল আমাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে, ঠিক সেভাবেই সমীক্ষার নির্যাস উপস্থাপনের ব্যাপারটিও সামলাতে হয়েছিল নিজেদেরই উদ্যোগে।

এতো ঝক্কি-ঝামেলা, কায়ক্লেশ স্বীকার করেও মানসিক শান্তি লাভ করেছিলাম এটা দেখে যে, আমাদের স্কুলপরিক্রমার ফসলই হলো আজকের শিক্ষা ও শিক্ষাঙ্গণের সার্বিক পরিকাঠামোগত উন্নতি সাধন, গ্রাম-গ্রামান্তরের বিদ্যালয় অভিমুখী পথঘাটের আমুল পরিবর্তন। এই পরিক্রমায় বেরিয়ে আমার ফেলে আসা দিনগুলোর স্পর্শও অনুভব করেছিলাম এবং সান্নিধ্য লাভ করেছিলাম কচি-কাঁচাদের। মাটিতে আসন পেতে বসে পড়ুয়াদের কোরাসের সুরে নামতা পড়ার যেমন সাক্ষী হয়েছিলাম, তেমনি আর্তের পরিষেবায় রত ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিত্বের মহানুভবতার পেলব স্পর্শও পেয়েছিলাম। আর পেয়েছিলাম তপোবনাশ্রমের ঋষিতুল্য ব্যক্তিত্বের নিকট সান্নিধ্যলাভ। সেটাই বা কম কিসের!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!