শংকু চক্রবর্তী // ২৩ অগাস্ট ২০২১
‘বিরোষইতোর বারবেলা’ এটাও এরা মানতে নারাজ।
তিন বছর থেকে কোমর ভেঙে বিছানায় পড়ে থাকা গপেশ নমঃশূদ্র, অলম্যান গোত্র’র কান্না ভেসে আসছিল : আমারে অখন কে চাইব রে বা। বুড়িগুরে নিও না রে বা।
খবরটা গ্রামে রটে যেতে সময় লাগেনি। ছোট বড় মাঝারি সবাই এসে ভিড় করেছে। বাচ্চা কাঁখে পেট ফোলা বউরাও একহাত ঘোমটা টেনে, কেউ কেউ আবার মলিন জোড়াতালি দেওয়া শাড়ির একদিক সরিয়ে চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো স্তন বাচ্চার মুখে গুঁজে দিয়ে বাচ্চার কান্না থামাবার চেষ্টা করে নিজেদের কান্নাটা সেরে নিচ্ছিল । বড়দের চোখে মুখে উৎকণ্ঠা, ছেলে ছোকরাদের চোখে নাটক দেখার কৌতূহল।
সুষমাবালার তিন ছেলে। তাদের দিকের নাতি নাতনি বউ সবাই বাড়িতে। দুই মেয়ের কবে বিয়ে হয়ে গেছে, তাদের কাছে এই খবর গিয়ে পৌঁছাতে পারেনি হয়তো বা আর পৌঁছে গিয়ে থাকলেও এত তাড়াতাড়ি আসা তো অসম্ভব। বারান্দায় পা ছড়িয়ে মাটিতে বসে বাঁশের খুঁটিকে জড়িয়ে ধরে কপাল চাপড়িয়ে চিৎকার দিয়ে কেঁদেই চলেছেন সুষমাবালা। নাতি নাতনিরা বুঝে না বুঝে ঠাকুরমার সঙ্গে গলা মিলিয়ে টান দিচ্ছিল। কেবল সুষমাবালার অতি আদরের ‘টুকটুকি’ হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তার মুখের দিকে।
দুজন মহিলা পুলিশ এসে হাত ধরে টানা হ্যাঁচড়া করে তাকে উঠোনে নামালে সমবেত জনতার কান্নার শব্দ বহুগুণ বেড়ে যায়। টুকটুকিও তার পিছু নেয়। পুরুষ পুলিশরা চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছিল।
টুকটুকির জন্মের তিনদিন পর তার মা ট্রেনে কাটা পড়ে। সেই থেকে সুষমাই তার সব। ঘুমায় ওনার কাছেই, বস্তার ভেতর শুকনো খড় ঢুকিয়ে বানানো ‘জাজিম’-এ। একজন পুলিশ হাতের লাঠিটা দিয়ে একে তাড়াতে গেলে সুষমা কান্না থামিয়ে কাতর মিনতি করে ওঠেন, আমার টুকটুকিগুরে আমার লগে আইতে দেইন রে বা। মহিলা পুলিশ একজন ধমক দিয়ে ওঠে, ডিটেনসন ক্যাম্পো যাইতাছ, বেয়াইর বাড়িত যাইতাছ না যে ছাগি গরু হক্কোলতা লইয়া যাইতায়। তারাতারি চলো আর নাটক কইর্য না।
বাড়ির সামনে রাস্তার কাছাকাছি এক বিশাল বটগাছ। নীচটা মাটি দিয়ে বাঁধানো। গাছটার শিকড় ও ডালে অসংখ্য লাল সুতো ও কাপড় বাঁধা। এটা বাবা ভৈরবের ‘থান’। শুধু এ গ্রাম নয় আশপাশের গ্রাম থেকেও মানুষ এসে পুজো দেয় এখানে। সুষমা ওইদিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ওঠেন – আমারে লইয়া যাইত্রাগি রে বা বাবা, তুমি বিচার করিও। জন্মিলাম ওউ দেশো অখন বুলে বিদেশি।
দু’জন মহিলা পুলিশ দু’হাতে ধরে টানতে থাকে। অন্য একজন কোমরের দিকে ঠেলে ঠেলে গাড়িতে নিয়ে ওঠায়। ঠিক তখনই ভিড়ের মধ্য থেকে কেউ একজন হঠাৎই ‘জুকার’ দিয়ে ওঠে। মুহুর্তে অনেকে গলা মেলায়। দু-তিন বারের পর সমবেত উলুধ্বনিটা কান্নার রূপ নেয়।
ইঞ্জিন শব্দ করে ওঠতেই টুকটুকি দৌড়ে গিয়ে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে ওঠে।
এই ডি-তাড়িত যন্ত্রণার কবে শেষ হবে কেউ জানে না।