৪ জুলাই, ১৯৫২ সাল। সংসদে পরিকল্পনা মন্ত্রকের কাজকর্ম নিয়ে আলোচনা চলছে, ছিলেন পরিকল্পনা মন্ত্রকের মন্ত্রী গুলজারিলাল নন্দা। পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার সম্পর্কে তাঁর কিছু ‘জ্ঞান’ আছে জানিয়ে মেঘনাদ সাহা সংসদে প্রশ্ন তুললেন, “কেন এই বিষয়ে সরকারের পরিকল্পনা সাংসদ ও সাধারণ নাগরিকদের কাছে গোপন রাখা হচ্ছে?” মন্তব্য করলেন, “এই মানসিকতা বলে দিচ্ছে, ক্ষমতাসীন দল ফ্যাসিবাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।’’ ‘ফ্যাসিবাদ’ শব্দটি বিতর্কের আগুনে ঘৃতাহুতি দিল। জবাবে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু বললেন, ‘‘ডক্টর সাহা ফ্যাসিবাদ শব্দটির অর্থ জানেন না। … তিনি বিজ্ঞানকেও অসম্মান করেছেন।’’ পিছু হঠার পাত্র নন মেঘনাদ সাহা। কৌটিল্য-শ্লোকের উদ্ধৃতি দিয়ে ফ্যাসিবাদের ব্যাখ্যা করলেন তিনি, বললেন – ‘‘আমি বলিনি সরকার ফ্যাসিবাদী হয়ে গিয়েছে। বলেছি, ফ্যাসিবাদী প্রবণতার দিকে চালিত হচ্ছে।’’
১৯৫১ সালের স্বাধীন ভারতের লোকসভা নির্বাচনে উত্তর-পশ্চিম কলকাতা নির্বাচনচক্রে ইউনিয়ন অব সোসালিস্টস্ এন্ড প্রগ্রেসিভ দলের প্রার্থী হয়ে মেঘনাদ সাহা প্রতিদ্বন্দিতা করেন। নির্বাচনের খরচ সঙ্কুলানের জন্য তাঁর সেই বিখ্যাত আকরগ্রন্থ ‘এ ট্রিটিজ অন হিট’-এর প্রকাশকের নিকট পাঁচ হাজার টাকা অগ্রিম নিয়েছিলেন তিনি। সেই নির্বাচনে মেঘনাদ সাহা বিপুল ভোটে জয়ী হোন। সংসদে শিক্ষা, উদ্বাস্তু পুনর্বাসন, পারমাণবিক শক্তি ও দেশের নদী-বাঁধ পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল মেঘনাদ সাহার।
সাংসদ হওয়ার আগে-পরে, সব সময়ই তিনি বিজ্ঞানের মানবিক রূপের বিকাশে সচেষ্ট ছিলেন। জাতীয়তাবোধের স্ফূরণ ও এক শ্রেণিবিভাজনমুক্ত রাষ্ট্র গঠনে তিনি বিজ্ঞানকে সার্থকভাবে ব্যবহারে সচেষ্ট ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু বোমার ব্যবহারে চমকে যায় সারা পৃথিবী। ব্রিটেন, জার্মানির মতো শক্তিধর দেশগুলি পরমাণু গবেষণায় মনযোগী হয়। মেঘনাদ সাহা বোমা বানানোর পরিবর্তে পরমাণুর শক্তিকে কাজে লাগিয়ে জ্বালানির চাহিদা মেটানো বেশি জরুরি বলে মনে করে দেশে স্বাধীন একটি পারমাণবিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান চালু করার পরিকল্পনা শুরু করেন। তার ছাত্র বাসন্তী দুলাল নাগ চৌধুরী ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলেতে আর্নেস্ট লরেন্সের সাথে কাজ করছিলেন সেই সময়। তিনি ফিরে এসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সাইক্লোট্রন তৈরি করেন। পরবর্তীতে জাহাঙ্গীর রতনজী দাদাভাই টাটার পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৪৯ সালে মেঘনাদ সাহা কলকাতায় নিউক্লিয়ার ফিজিক্স ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন যা এখন সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স (এসআইএনপি) নামে সুপরিচিত। সেই ইনস্টিটিউট ১৯৫০ সালের ১১ জানুয়ারি ইরেন জোলিও-কুরির হাত ধরে পুরোদমে যাত্রা শুরু করে। আজ সারা দেশের গুটিকয়েক গবেষণাগারের মধ্যে এই ইনস্টিটিউটটি অন্যতম প্রধান।
বিজ্ঞানচর্চার বাইরে তাঁর জীবন ও কর্মের বর্ণময় দিকগুলো ইতিহাসের পাতায় সবসময় উজ্জ্বল থাকবে। দেশের সাধারণ জনসাধারণের দুঃখ-দুর্দশা নিম্নবর্গীয় সমাজের বেদীমূল থেকে উঠে আসা মেঘনাদ সাহাকে ভাবিত করত। আর তাই, যখনই সুযোগ পেতেন তিনি তাদের প্রয়োজন নিয়ে সোচ্চার হতেন। দেশভাগের বলি ছিন্নমূল উদ্বাস্তুদের আর্তনাদে সাড়া দিতেও পিছপা না হয়ে তাদের পাশেও দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। উদ্বাস্তুদের জন্য ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজ নিয়মতান্ত্রিক ভিত্তিতে পরিচালনা করার লক্ষ্যে তিনি বেঙ্গল রিলিফ কমিটি গঠন করেছিলেন। নিজের উদ্বাস্তু পরিচয়েও তিনি অকুন্ঠ ছিলেন। সংসদে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উচ্চারণ করেছিলেন, “আমি নিজে একজন উদ্বাস্তু, তাই এখানে আমি উদ্বাস্তুদের প্রতিনিধি।” ১৯৫৫ সালে তিনি ছুটে এসেছিলেন বিভাজিত সিলেটের ভারতে সন্নিবিষ্ট অংশ করিমগঞ্জে (তৎকালীন আসামের কাছাড় জেলায় অন্তর্ভুক্ত, সম্প্রতি এই করিমগঞ্জের নাম পরিবর্তন করে শ্রীভূমি রাখা হয়েছে), সঙ্গে ছিলেন আরেক সাংসদ ত্রিদিব চৌধুরী। করিমগঞ্জে এসে তিনি উদ্বাস্তু বাজারের উদ্বোধন করেছিলেন। ফিরে গিয়ে কাছাড়ের উদ্বাস্তুদের যন্ত্রণাগাথা নিয়ে সংসদে দীর্ঘ বক্তব্য রেখেছিলেন (২৪ মার্চ ১৯৫৫ সাল)।

বিজ্ঞানে ব্যক্তিগত সাফল্যের ঊর্ধ্বে মেঘনাদ স্থান দিয়েছিলেন দেশকে, জাতিকে, দেশের অর্থনীতিকে। প্রয়োজন বিবেচনায় অনেকক্ষেত্রেই তিনি প্রতিষ্ঠানবিরোধী অবস্থান গ্রহণে দ্বিধা করেননি। উদ্বাস্তুদের প্রতি তাঁর সহমর্মিতার মূলে ছিল নিখাদ মানবিকতা, তাতে মেকি হিন্দুত্বের আভরণ অবশ্যই ছিল না। মেঘনাদ সাহার হৃদয়বত্তা, সত্যসন্ধান, জাতীয়তাবাদ, ন্যায়নিষ্ঠা এবং দেশ-গঠনে তাঁর মতামত ও পরিকল্পনা সম্পর্কে জানার-বুঝার প্রয়োজনীয় উৎস হচ্ছে তাঁর লোকসভায় প্রদত্ত বক্তৃতামালার সঙ্কলন— Meghnad Saha in Parliament, edited by Santimay Chatterjee and Jyotirmoy Gupta, The Asiatic Society, Calcutta (1993)।