সব্যসাচী রায়
‘পরিবর্তন’ আজ বহুশ্রুত এক শব্দ। কিন্তু, কেন যেন মনে হয় নিজের গণ্ডিতেই শব্দটি আবদ্ধ হয়ে রয়েছে। আবার একটা সময় মনে হয়, কালস্রোতে যেন তার ভাষ্য পাল্টেছে।
পরিবর্তন তিনি এনেছিলেন, সমাজিক রীতিনীতিতে তিনি সংস্কার আনতে পেরেছিলেন। “যে দেশের লোক দলে দলে না খেতে পেয়ে প্রত্যহ মরে যাচ্ছে, সেদেশে আবার রাজনীতি কী?” ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের জন্মের পর এই মন্তব্য করেছিলেন তিনি। তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০ — ২৯ জুলাই ১৮৯১)। দর্শন ও সংস্কৃত বিষয়ে পাণ্ডিত্যের কারণে তাঁকে “বিদ্যাসাগর” উপাধি দেওয়া হয়েছিল। আজ তাঁর প্রয়াণ দিবসে এই সমাজ-সংস্কারককে প্রণতি জানাই।
অশিক্ষা-কুশিক্ষা, কুসংস্কার, অবিদ্যা ও কূপমণ্ডুকতায় নিমজ্জিত বাংলাকে মুক্তির পথ দেখাতে চেয়েছিলেন তিনি। বাংলা সাহিত্যের প্রসার, সংস্কৃতের সরলীকরণ, নারী শিক্ষা বিস্তারে সেই সময় তিনি ছিলেন এক একক সত্তা। মুখস্থ নয়, ছাত্রেরা যাতে পড়াটা বুঝতে পারে এরজন্য বাংলায় সংস্কৃত ব্যাকরণ পড়ানো চালু করেছিলেন তিনি। প্রথমে বিরোধিতা হয়েছিল, পরে সবাই তাঁর দেখানো পথে হাঁটতে বাধ্য হয়েছিলেন।
“নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে, ক্লীবে চ পতিতে পতৌ” (পরাশর সংহিতা) অর্থাৎ স্বামী নিখোঁজ হলে বা তাঁর মৃত্যু হলে, নপুংসক আর পতিত হলে তাঁর স্ত্রী আবার বিয়ে করতে পারেন। এই যুক্তির পক্ষে তিনি দু’টি বই লিখলেন। তিনি সেখানেই নিবৃত্ত হননি। হিন্দু বিধবা পুনর্বিবাহ, বাল্য বিবাহ রোধ ও বহুবিবাহ রোধ নিয়ে জনমত গঠনে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি শুরু করলেন। পাশে পেয়েছিলেন বাংলা ভাষার প্রথম অভিধান লেখক, ব্রাহ্ম সমাজের প্রথম আচার্য রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয়কুমার দত্তের মতো মনীষীদের। বিধবা বিবাহ চালু করতে আইন প্রণয়নের জন্য তিনি স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে মাঠে নেমেছিলেন। কিন্তু, তাঁর প্রস্তাবের পক্ষে স্বাক্ষর ছিল ৯৮৭টি, বিপক্ষে ছিল হিন্দু রক্ষণশীল সমাজ যারা ৩৬,৭৬৩টি সই সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু, ঈশ্বরচন্দ্র দমে যাননি, নিজের লক্ষ্যে ছিলেন অবিচল। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, “শাস্ত্রের অর্থ না বুঝিয়া অথবা ভুল অর্থ বুঝিয়া কিংবা অভিপ্রেত সিদ্ধির নিমিত্ত স্বেচ্ছানুরূপ অর্থান্তর কল্পনা করিয়া, শাস্ত্রের দোহাই দিয়া যথেচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিধবাকাণ্ড বৈধ বলিয়া প্রচার করিলে নিরপরাধ শাস্ত্রকারদিগকে নরকে নিক্ষিপ্ত করা হয়।” শেষে, তাঁর অদম্য ও উদার আবেদনের কাছে নতি স্বীকার করতে হয়েছিলেন রাধাকান্ত দেবের মতো হিন্দু রক্ষণশীল সমাজের নেতারা। অতঃপর, ১৮৫৬ সালের ২৬ জুলাই দ্য হিন্দু উইডো’স রিম্যারেজ অ্যাক্ট, ১৮৫৬ প্রণয়ন হয়েছিল।
আইন পাশ হওয়ার পর তিনি থেমে থাকেননি। সামাজিক বুনোটকে পরিবর্তন করতে তিনি বিধবা বিবাহের পৃষ্ঠপোষকের রূপে আবির্ভাব হলেন। এই জন্য চাকরির উপার্জন, পুস্তক রচনা করে বিক্রিত অর্থ সমস্ত কিছু ব্যয় করে আর্থিকভাবে ঋণগ্রস্ত হয়েছিলেন তিনি। এমনকি, শারিরীকভাবে আক্রান্তও হতে হয়েছিল তাঁকে। তবুও তিনি দমেননি। গোটা নারী সমাজকে পথ দেখিয়ে নিজের পরিবারের ক্ষেত্রেও তিনি এক অনন্য নিদর্শন সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। তিনি তাঁর নিজের ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন এক বিধবার সঙ্গে, পরিবারের সবার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে। যদিও পরবর্তীতে সেই ছেলেকেই ত্যাজ্য করেছিলেন তিনি।
কোনও ব্যাপারেই গোঁড়ামি ছিলনা তাঁর। গোঁড়া প্রাদেশিকতাকে প্রশয় দিতেন না বিদ্যাসাগর। সোজা কথা সোজাভাবে ভাবতেন, বলতেন। যা উচিত বলে মনে করতেন তার জন্য কোনও কারণেই পিছপা হতেন না। প্রসঙ্গত, ১৮৬৯ সালে বিদ্যাসাগরের গ্রামেই একটি বিধবা বিবাহ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিশেষ কোনও কারণে বিয়েটা না হওয়ায় তিনি এতটাই মনঃক্ষুন্ন হয়েছিলেন যে তিনি রাগে দুঃখে গ্রাম ত্যাগ করেছিলেন। এবং, মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত নিজের গ্রামে আর যাননি।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন এক অক্ষয় মনুষ্যত্বের অধিকারী, বিনয়ী কিন্তু দৃঢ়চেতা। স্কুলবেলায় পড়া তাঁর উক্তি আজও মনে আছে — “আমাদের নিজেদের স্বার্থ দেখার আগে দেশ ও সমাজের স্বার্থ দেখা উচিত, সেটাই হল প্রকৃত বিবেকধর্ম।” আজ একুশ শতকে ধর্মের রাজনৈতিক বয়ানের কাছে সামাজিক পরিবর্তনের ধারাটি বেলাগাম বলেই মনে হচ্ছে। আজ সমাজ ও দেশের স্বার্থে বিবেকধর্মকে প্রাধান্য দেওয়া হয় কি? বা, দেওয়ার সুযোগ সেরকম আছে কি? তাই, সমাজ ও দেশকে এক উদার বিবেকধর্মের পাটাতনে নিয়ে গিয়ে স্থাপন করতে হলে ঈশ্বরচন্দ্রের জীবনাদর্শে বিশ্বাস রাখাটা প্রয়োজন। পাশাপাশি, “যথার্থ সাধুদিগকেও সঙ্গদোষে বিপদে পড়িতে হয়” — ঈশ্বরচন্দ্রের এই কথাটি আজ মনে রাখাটাও আবশ্যক। সঙ্গদোষের হাতছানি যে আজ প্রবল।