The Mirrow

বিশ্বজিৎ চৌধুরি : যেমন দেখেছি, শুনেছি

Share the Article

বিবেকানন্দ মোহন্ত

-এক-

রামকৃষ্ণ বিদ্যাপীঠ, হায়ার সেকেণ্ডারি স্কুলে ক্লাশ নাইন-টেন-এর ছাত্র ছিলাম, সময়টা ১৯৭৬-‘৭৭ সাল। স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে প্রায়দিনই দেখতাম পরনে ধবধবে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা এবং হাতে ডায়েরি টাইপ গোটা দু’এক নোটবুক নিয়ে এক তরুণ যুবক মাথা উঁচু করে হেঁটে যাচ্ছে স্কুলের সামনের পথ ধরে। মনে কৌতুহল জাগে একসময়। সহপাঠী দু’একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম কলেজ পড়ুয়া সুবেশ যুবাটির নাম বিশ্বজিৎ চৌধুরি , থাকেন স্কুলের পিছনে কালীবাড়ি টিলায়, তাঁর পিতা স্থানীয় ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিসের বড়বাবু। সাহিত্য-টায়িত্ব, লেখালেখিও করেন। “মাটির কাছাকাছি” নামে একটি ম্যাগাজিনও আছে তাঁদের। পরে দেখলাম আমাদের স্কুলের উঁচু ক্লাশের ছাত্র, বিশেষত যারা স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নাটক-টাটক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকে, তাদের সাথে যুবকটির পরিচয়-পরিচিতিও রয়েছে এবং বেশ ঘনিষ্ঠই বলা যেতে পারে। এভাবেই নিজের অজান্তেই একদিন  তিনি আমাদের মত তরুণদের ম্যাটিনি আইডল হয়ে পড়লেন। একসময় তাঁর সাহিত্যের পরিচিতি ধর্মনগর অবধি গিয়ে পৌঁছেছিল। ফলে রামকৃষ্ণনগর ও ধর্মনগরের যৌথ উদ্যোগে আত্মপ্রকাশ করেছিল “ঐকতান সাহিত্যগোষ্ঠী” পরিচালিত “মাটির মা” শীর্ষক সাহিত্যপত্র। পরবর্তীতে ১৯৮৫ সালে  তিনি রামকৃষ্ণনগর ভূ-বাসন অফিসের কর্মী তথা সাহিত্য-সংস্কৃতিমননশীল ব্যক্তিত্ব চিন্ময় চক্রবর্তীকে নিয়ে যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশ করা শুরু করেন ত্রৈমাসিক সাহিত্যপত্র “শরিক সাহিত্য”।  এই লিটিল ম্যাগাজিনটি পূর্বাঞ্চল সহ পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতনামা সাহিত্যিদের লেখনিসমৃদ্ধ হয়ে দীর্ঘ তেত্রিশ বছর অবধি নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছিল।

উপরোক্ত তিন তিনটি  সাহিত্যপত্র সম্পাদনার সমান্তরালে বিশ্বজিৎদা লিখে গেছেন বহু কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক, রম্যরচনা, ছোটগল্প এবং ভ্রমণ কাহিনি। তাঁর রচিত “প্রেমে অপ্রেমে” নামক কাব্যগ্রন্থটির খ্যাতি একসময় দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পৌঁছেছিল বহির্ভারতের কাব্যপিপাসু-বৌদ্ধিক পরিসরে। অপরদিকে  তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত অনেকগুলো বই আন্তর্জাতিক স্তরেও সমাদৃত হয়েছিল। এছাড়া আন্তর্জাতিক স্তরের সংকলনগ্রন্থেও তাঁর লেখা বেশ কিছু ছোটগল্প ও কবিতা স্থান পেয়েছিল। এসবের পাশাপাশি তাঁর রচিত কবিতা অনূদিত হয়ে  প্রকাশিত হয়েছিল লণ্ডন ভিত্তিক দ্বিভাষিক আন্তর্জাতিক সংকলনেও। প্রাবন্ধিক হিসাবেও বিশ্বজিৎদার খ্যাতি সর্বজনবিদিত। এবিষয়ে তাঁর  “প্রগতিশীল জাতীয়তা ও অন্যান্য” শীর্ষক প্রবন্ধ সংকলনটি এক সময় খুব প্রশংসা কুড়িয়েছিল বৌদ্ধিক মহল থেকে। তাঁর নিরলস সাহিত্যচর্চার স্বীকৃতিস্বরূপ  ১৯৯৬ সালে ঝাড়খণ্ডের চক্রধরপুরে সিংভূম সাহিত্য পরিষদ তাঁকে “আশালতা স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার”-এ ভূষিত করেছিল। এছাড়াও বহু আন্তর্জাতিক কবি সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে কবিতা পাঠ করেছিলেন। অনেকবার আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন সাহিত্য আসরে সংবর্ধিত হয়েছিলেন। কর্মজীবনে পেয়েছেন অগণিত নাগরিক সম্মান এবং মানপত্র।

-দুই-

বিশ্বজিৎদা ছিলেন সত্যিকার অর্থেই একজন আদর্শ শিক্ষক। দীর্ঘকাল শিক্ষকতা করেছিলেন রাকেশনগরের মহাদেব হায়ার সেকেণ্ডারি স্কুলে। পরবর্তীতে ১৯৯৩ সাল নাগাদ বদলি হয়ে আসেন আনাইর হাওরের কূলঘেষা প্রাচীন জনপদ ঘোড়ামারায়, যোগদান করেন স্থানীয় ঘোড়ামারা হাইস্কুলে। এখান থেকেই অবসর নেন ২০১৬ সালে। কর্মজীবনে উভয় স্কুলেই রেখে গেছেন নিষ্ঠার স্বাক্ষর এবং এর পাশাপাশি লোকায়ত পরিসরের সাথেও জন্মেছিল তাঁর নিবিড় সম্পর্ক এবং আত্মিক বন্ধন। খুব কাছে থেকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বঞ্চিত পরিসরের দুঃখ-দারিদ্রকাতর  দিন-গুজরানের হাল হকিকত। এই চিন্তাধারা থেকেই জন্ম নিয়েছিল ঘোড়ামারা কেন্দ্রিক গণমুখী নাট্যসংস্থা “গণমঞ্চ”র। সাথে পেয়েছিলেন সমমননশীল স্থানীয় শিক্ষিত সমাজের অগ্রগণ্য ব্যক্তিবর্গদের এবং তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন করিমগঞ্জ ইলেকট্রিসিটি বোর্ডের অ্যাসিস্ট্যান্ট এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার শ্রী নির্মল দাস। গণমুখী নাটকগুলোর স্ক্রিপ্ট লিখতেন বিশ্বজিৎদা, নির্দেশনায় থাকতেন নির্মলবাবু। অভিনয়ে স্থানীয় পরিসরের কুশীলবদের পাশাপাশি সপরিবার বিশ্বজিৎদাও অংশগ্রহণ করতেন। অবসরপ্রাপ্ত বিদ্যুৎ বিভাগের ইঞ্জিনিয়ার নির্মলবাবুর সাথে আলাপচারিতায় জানতে পারলাম ১৯৭৭-‘৭৮ সাল থেকে প্রায় আট বছর অবধি  বিশ্বজিৎদা এবং তাঁদের হাত ধরে উপরোক্ত নাট্যসংস্থাটির ব্যানারে বিভিন্ন ইস্যুভিত্তিক গণমুখী নাটক নিয়ে তাঁরা অভিনয়ে মেতে উঠতেন ঘোড়ামারা, রাকেশনগর, ভাঙ্গা, চরগোলা প্রভৃতি অঞ্চলের অস্থায়ী রঙ্গমঞ্চে। ঐ পর্বে একবার শিলচর ডিস্ট্রিক্ট লাইব্রেরিতে “রূপম নাট্য সংস্থা” আয়োজিত প্রতিযোগিতামূলক নাট্যানুষ্ঠানে “যুদ্ধ নয় শান্তি চাই” শীর্ষক নাটকটি মঞ্চস্থ করেছিল বিশ্বজিৎ-নির্মলবাবুদের নাট্যসংস্থা এবং বলা বাহুল্য যে, সেই সময় সুধী সমাজের ভূয়সী প্রশংসাও কুড়িয়েছিল। এ প্রসঙ্গে আরও বলা যায় যে, সামাজিক নাটক ছাড়াও দস্তুরমত ঢাল-তলোয়ার নিয়ে ঐতিহাসিক যাত্রাপালা মঞ্চস্থ করা থেকেও  পিছিয়ে থাকেনি “গণমঞ্চ নাট্যসংস্থা”।

-তিন-

বিশ্বজিৎদার নিকট সান্নিধ্য লাভের সুযোগ ঘটে ২০০২ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে। করিমগঞ্জ শম্ভুসাগর পার্কের উল্টোদিকের মডার্ণ প্রিন্টার্স-এ যেতাম সুহৃদবর হবিবুর রহমানের কাছে, সেখানেই একদিন দেখা হল তাঁর সাথে। দেখলাম এতকাল পরও  তেমন পরিবর্তন ঘটেনি তাঁর  সাজসজ্জা-পরিচ্ছদে – সেই ধবধবে ফিনফিনে ধুতি-পাঞ্জাবী, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা এবং ঠোটে নাসিরুদ্দিন। ততদিনে হয়ে উঠেছেন উত্তর-আধুনিক সাহিত্যতত্ত্বের একজন সফল প্রবক্তা, দিকপাল কবি, সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক। তাঁর সুযোগ্য সম্পাদনায় তখন নিয়মিতই প্রকাশিত হচ্ছে ‘শরিক সাহিত্য’র এক একটি সংখ্যা। দেখেছিলাম বিশ্বজিৎদার পাশের চেয়ারে  বসে  মাথা নীচু করে একনাগাড়ে কলম চালিয়ে যাচ্ছেন কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক তথা তুখোড় সাংবাদিক তরুণ যুবক মিহির দেবনাথ।

মডার্ণ প্রিন্টার্সে গেলে দেখতাম রোজ সন্ধেবলায় এখানে জমজমাট আসর বসেছে প্রতিষ্ঠিত কবি-সাহিত্যিক-লেখকদের। আসতেন দিগ্বলয়ের অধ্যাপক ড. কামালুদ্দিন আহম্‌দ, স্বদেশ সাহিত্য’র মাশুক আহমদ, শ্রীহট্টজ্যোতি’র দীপঙ্কর ঘোষ, কলিকুসুমের আতিকুর রহমান চৌধুরি , আমলা তথা বিশিষ্ট কবি,সাহিত্যিক কমল ঘোষ, সাহিত্যিক নির্মল দাস, সাহিত্যিক তথা শরিক সাহিত্যের যুগ্ম সম্পাদক চিন্ময় চক্রবর্তী, কবি-সাহিত্যিক মুজিব স্বদেশী, কবি দিলীপ বিশ্বাস সহ আরও বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। সময় সময়  এসে বসতেন প্রয়াত অধ্যাপক ড. সুবীর করও।

আমি ব্যক্তিগতভাবে সাহিত্য-টায়িত্য তেমন বুঝিসুঝিনা, তবে মাঝে মধ্যে দু’একটি গল্প এবং প্রবন্ধ বেরোত শ্রদ্ধেয় শ্যামলেন্দু চক্রবর্তীর সম্পাদনায় যুগশঙ্খের রবিবাসরীয় ক্রোড়পত্রে, এই যা। হবিবুর রহমানের মজলিশে গিয়ে আঁটোসাটো হয়ে এক কোণায় বসে থাকতাম। দিকপাল লিখিয়েদের কথাবার্তা শুনতাম, বেশ ভালোই লাগত।

 এরকমই একসন্ধ্যায় নাসিরুদ্দিনে সুখটান দিয়ে বিশ্বজিৎদা আমায় বললেন – ‘ বিবেক, তোমার খবর টবর  আমরাও রাখি, এবার পূজো সংখ্যায় শরিকের জন্য লেখা চাই। গল্প তো থাকবেই, তার সাথে ইতিহাস বিষয়ক প্রবন্ধও লাগবে, হাতে সময় নেই।’ তাঁর আদেশটি ফেলে দেবার নয়, বিশেষত শরিক সাহিত্য বলে কথা!

বললাম – ‘আচ্ছা, ঠিক আছে।  গল্প হয়ে যাবে, তবে প্রবন্ধটির পরিবর্তে একটি অসমাপ্ত আত্মজীবনী ছাপালে কেমন হয়? এটা লিখেছিলেন আমার দাদাশ্বশুর, যিনি মহারাজা বীরেন্দ্রকিশোর মাণিক্য পর্বে ত্রিপুরার রাজদরবারে একসময় চাকরি করতেন। পাণ্ডুলিপিটি শেষ করে যেতে পারেননি, মারণব্যাধি ক্যানসারে অকালেই চলে গিয়েছিলেন।’

প্রস্তাবটি লুফে নিলেন সম্পাদক মশায়, বললেন –  ‘চমৎকার! লেখাটি অসমাপ্ত হলেও সেটা মৌলিক ইতিহাসের আকর গ্রন্থ, পরদিন ১২ পনি সাইজের হার্ডবোর্ডে বাঁধানো ১০ নম্বরী পাণ্ডুলিপির খাতাটি নিয়ে হাজির হলাম সম্পাদক সকাশে। তিনি খাতাটি নিয়ে ভিতরের কোঠায় চলে গেলেন। সেখানে  বসে নিবিষ্টমনে পাঠে মগ্ন হলেন। মাঝে মাঝে  বিড়ির অবশেষটি রিপ্লেস করে সুখটান দিচ্ছিলেন নতুনের মধ্য দিয়ে, বিরতি বলতে শুধু এটাই। নাগাড়ে কয়েক ঘন্টায় পাঠ শেষ করে একটা কাগজে সম্পাদকীয় Intro লিখে আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন – ‘ বিবেক, একেবারে অবিকৃত অবস্থায় এটি প্রকাশ করতে হবে। পুরোনো বানান রীতি মেনটেইন হওয়া দরকার। এই কাজে মাতাবুরকে engage করতে হবে এবং এর দায়িত্বে  থাকবে তুমি, কেননা বিষয়টির গুরুত্ব তুমি ভালো বুঝবে।’

চিরকুটে লেখা সম্পাদকীয় Intro টি ছিল –

[ “——– এটির সাহিত্যমূল্য তো আছেই তদুপরি সে-সময়ের ইতিহাসের উপাদান হিসেবেও ব্যবহৃত হতে পারে বিবেচনা করে এটি অবিকৃতরূপে ছাপিয়ে দেওয়া হল। এতে সেই সময়কার ত্রিপুরা রাজ্যের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, শৈক্ষিক ও অন্যান্য অবস্থার চিত্র রয়েছে। ——। – সম্পাদক ]

যাই হোক, সেদিন শরিক সাহিত্যের সহ-সম্পাদকের দায়ভার কাঁধে নিয়ে সাহিত্যরসিক মাতাবুর রহমানের সাথে বসে পড়েছিলাম কম্পিউটারের সামনে। দেখলাম টাইপিস্ট হিসেবে “গফর গরু গাছো উঠে”র রচয়িতা  মাতাবুরের কোনো জুড়ি নেই, আমার ডিক্টেশনে একপ্রকার নির্ভুলভাবেই তিনি তাঁর দায়িত্ব যথাযথ পালন করে গিয়েছিলেন।

১৪০৯ বাংলার (অক্টো: 2002) শরিক সাহিত্য’র শারদীয়া সংখ্যাটি সবদিক দিয়ে খুব ঋদ্ধই ছিল বলা যেতে পারে। সংখ্যাটিতে অরুণ চন্দ্র মোহন্ত’র আত্মজীবনীর পাশাপাশি সাহিত্য সমালোচনামূলক অনেকগুলো প্রবন্ধ-নিবন্ধ ছাড়াও হারিয়ে যাওয়া লোকগান, মারিফতি গান, রম্যরচনা, সংবাদপত্র-বিষয়ক প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা এবং আমন্ত্রিত সম্পাদকীয় নিয়ে সমৃদ্ধ সংখ্যাটি সম্পাদনা করতে গিয়ে বিশ্বজিৎদার গভীর নিষ্ঠা, তৎপরতা এবং দায়বদ্ধতার বিষয়টি আমাকে তাক্ লাগিয়ে দিয়েছিল। A-4 সাইজের প্রায় নব্বই পৃষ্ঠার শারদ সংখ্যাটির অন্তর্গত প্রতিটি রচনার টাইপে, অক্ষরবিন্যাসের সেটআপ যথাযথ হল কি-না, মাত্রা, গ্যাপিং ঠিকঠাক হল কিনা, বানানের রীতি কিংবা ভুলভ্রান্তি থাকল কিনা সেসব তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরখ করে নিয়েছিলেন। বাদ পড়েনি যতি চিহ্নের সঠিক প্রয়োগ হল কিনা তাও দেখে নেওয়া। অসীম ধৈর্য্য সহকারে Final proof দেখার কাজটিও তিনি নিজে থেকে করে নিয়েছিলেন যাতে কোনো ধরণের ত্রুটিবিচ্যুতি না থাকে – যা এক কথায় অবিশ্বাস্য বৈকি!

প্রচ্ছদ পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও বিশ্বজিৎদার চিন্তাধারাকে সাধুবাদ দিতেই হয়। সংকলনধৃত রচনার সাথে মানানসই প্রচ্ছদ নির্মাণ ও অলংকরণের দায়িত্বটি  তুলে দেওয়া হল আমাদেরই অনুজপ্রতীম অসিত চক্রবর্তীর উপর। সে নিজেও একজন সফল আর্টিস্ট এবং কবি-সাহিত্যিক। তাই  সম্পাদকের অনুরোধ কিংবা বলা যেতে পারে নির্দেশে রামকৃষ্ণনগর থেকে ছুটে এসেছিল অসিত। তার নিষ্ঠার স্বাক্ষর যথাযথভাবেই প্রতিফলিত হয়েছিল তার কাজে।

বিশ্বজিৎদার ঐকান্তিকতা এবং একাগ্রতার বিষয়টি লক্ষ্য করেছিলাম ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারিতেও শরিক সাহিত্য’র উদ্যোগে “তপোধীর ভট্টাচার্য সম্মাননাগ্রন্থ” প্রকাশের ক্ষেত্রে। প্রকাশিতব্য সংকলন গ্রন্থের অন্তর্গত প্রতিটি মূল্যায়নধর্মী প্রবন্ধ-নিবন্ধ, কবিতা, চিঠিপত্রাদি ছাড়াও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ক রচনার প্রতিটি হরফ, বর্ণ, লাইন, পংক্তি মায় যতি চিহ্নের সাথে সুযোগ্য সম্পাদক বিশ্বজিৎদার দায়বদ্ধতা নিদর্শনের সাক্ষী হয়ে থেকেছিলাম সেদিন। মডার্ণ প্রিন্টার্সের স্বত্বাধিকারী সুহৃদবর হবিবুর রহমান, মাশুক আহমদ, মিহির দেবনাথ সহ  গোটা প্রেস পরিবারও সেদিন দাঁড়িয়েছিল শরিক সম্পাদকের পাশে। অনেক নামীদামী, খ্যাতনামা লেখক-চিন্তাবিদদের ভিড়ে সেদিন বিন্দুসম হয়ে ঠাঁই নিতে পেরেছিলাম সম্মাননা গ্রন্থ সংকলনে – ছোট্ট একটি নৈবেদ্য নিবেদনের মধ্য দিয়ে। এটাই ছিল আমার পরম প্রাপ্তি।

-চার-

আজ বিশ্বজিৎদা আমাদের মধ্যে নেই, তবে আমার মত আরও  অনেক আনকোরা এবং সাধারণ পাঠকের মননে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন তিনি তাঁর রেখে যাওয়া গ্রন্থিত অগণিত সৃজনশীল সৃষ্টি কর্মের মধ্য দিয়েই। দিশারী হয়ে থাকবেন তাঁদের কাছে,  যাঁরা নিরলস সাহিত্য-সংস্কৃতি মননশীল চিন্তাধারার সরণী বেয়ে এগিয়ে যেতে চাইছেন সামনে – আরও সামনে।  তাঁর রেখে যাওয়া উত্তর-আধুনিক বাংলা কাব্য ও সাহিত্য বিষয় নিয়ে  গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ-নিবন্ধগুলো আগামীদিনের সুধী পাঠক-গবেষকদের কাছে একদিন নিশ্চিতরূপে পদসংবাহক হয়ে  দাঁড়াবে। এছাড়া বিশ্বজিৎদার সম্পাদিত লিটিল ম্যাগাজিন / সাহিত্য/ সাময়িকীগুলো আগামী প্রজন্মের সম্পাদকদের কাছেও  অনুকরণীয় এবং যথার্থ পথনির্দেশিকা হিসেবে বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখবে, এ-কথা হলফ্ করে বলা যেতে পারে। অপরদিকে এই প্রবাদপ্রতীম ব্যক্তিত্ব বরাক উপত্যকার পৌর ও লোকায়ত তথা  শৈক্ষিক পরিসর সহ আন্তর্জাতিক স্তরের সাহিত্য-সংস্কৃতি মননশীল সুধী সমাজের কাছ থেকে যতটুকু স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন, সে তুলনায় সরকার ও প্রশাসনের তরফ থেকে তিনি যথাযথ স্বীকৃতি পেয়েছিলেন কী না সে-ব্যাপারে আমরা সাধারণ পাঠক সমাজ অবগত নই।

অগ্রজপ্রতীম বিশ্বজিৎদার পুণ্য স্মৃতির উদ্দেশ্যে জানাই  সশ্রদ্ধ প্রণাম  এবং বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।  ইহলোকে রেখে যাওয়া তাঁর শোকাহত পরিবার, পরিজন এবং অগণিত স্বজন-শুভানুধ্যায়ীদের প্রতিও রইল আমার আন্তরিক সমবেদনা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!