The Mirrow

আমাদের পাঠশালা পরিক্রমা – প্রথম পর্ব

Share the Article

বিবেকানন্দ মোহন্ত

-এক-

বরাক উপত্যকার শহর কিংবা গ্রাম-গ্রামান্তরের প্রায় প্রতিটি সরকারি  শিক্ষাঙ্গণের পরিকাঠামোগত দিক দিয়ে  আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে গত কয়েক বছরে। পরিবর্তন সাধিত হয়েছে পীঠস্থানের প্রবেশপথ কিংবা শ্রেণিকোঠার সার্বিক চিত্রেও। সরকারি কারিগরি বিভাগগুলোর সময়োচিত  ক্ষেত্রঅধ্যয়ন এবং যথাযথ সমীক্ষাই যে এই যুগান্তকারী উন্নয়নের পেছনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল,  সেটা বোধহয়  বলার অপেক্ষা রাখেনা।

এ ব্যাপারে উল্লেখ করতে হয় বিগত দিনের কিছু কথা। উপত্যকার আনাচে-কানাচে শিক্ষাব্যবস্থার হাল-হকিকত জানাটা জরুরি, এবং এক্ষেত্রে কারিগরি বিভাগের সহায়তা নেওয়াটাও দরকার। তাই,  জেলাপ্রশাসনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমরা পিএইচই, পিডব্লিউডি, ফ্লাড্-কন্ট্রোল, ইরিগেশন এবং টাউন এণ্ড কান্ট্রি প্ল্যানিং বিভাগের ইঞ্জিনিয়ারিং স্টাফরা গিয়ে হাজির হয়েছিলাম সার্কিট হাউসে। সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় শিক্ষাদপ্তরের উর্দ্ধতন আধিকারিক এবং কর্মীরাও। সেখানে উপস্থিত কর্তৃপক্ষরা আমাদেরকে জানিয়ে  দিলেন যে, প্রতিটি স্কুলের বর্তমান পরিকাঠামোগত দিকটি যেমন আমাদের সমীক্ষায় থাকবে, তেমনি গুরু-শিষ্যের হাজিরার বিষয়টিও আমাদের ক্ষেত্র-অধ্যয়নের মধ্যে পড়বে (সিলেটি ভাষায় যাকে বলে — পাঞ্জিত কয়জন আর গুটিত কয়জন)। গোটা চিত্রটি স্টিল ক্যামেরায়ও ধরে আনতে হবে, সেরকমই নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল আমাদেরকে । সভায় শিক্ষাবিভাগীয় আধিকারিক এও জানালেন যে,  ক্লাশ চলাকালীনই আমাদের স্কুলে যেতে হবে। এবং সমীক্ষা শেষ করতে হবে দিন পনেরোর মধ্যেই, বিষয়টি খুবই জরুরি। সেটা ২০০৪-০৫ সালের ঘটনা।

সভা চলাকালীনই আমাদের একেকজনের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল রুটম্যাপ, ঠিকানাবিহীন স্কুলের তালিকা। যাবতীয় খতিয়ান লিপিবদ্ধ করে রাখার জন্যও হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল স্কুলপ্রতি  ১৫-১৬ পৃষ্ঠার এক-একটি বেশ বড় মাপের চওড়া বুকলেট। এছাড়াও  দেওয়া হয়েছিল গুটিকয়েক ক্যামেরার রিল – যাতে সঠিক চিত্রটি চোখের সামনে ভেসে উঠে। যন্ত্রটি আমাদেরকেই যোগাড় করতে হবে, সেরকমই নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

আমার উপর দায়িত্ব বর্তেছিল দক্ষিণ করিমগঞ্জ শিক্ষাখণ্ডের অন্তর্গত সুবিশাল পরিসরের মধ্য থেকে সত্তর-আশিটি পাঠশালা পরিক্রমা (এলপি ও এমভি মিলিয়ে)। যার ভৌগলিক সীমারেখা ছিল পোয়ামারা-বারৈগ্রাম অন্তর্বর্তী পূর্বে দোহালিয়া পাহাড় এবং পশ্চিমে ভারত-বাংলা সীমান্তবর্তী পাথারিয়া শৈলশ্রেণি। করিমগঞ্জ-চুরাইবাড়ি জাতীয় সড়কের এপার-ওপার মিলিয়ে এই উপত্যকার আড়াআড়ি দূরত্ব/প্রস্থ হচ্ছে ন্যূনতম বারো থেকে চৌদ্দ কিলোমিটার।

সময়-আবদ্ধ ব্যাপার কিনা! তাই গুরুত্ব উপলব্ধি করে ভাদ্রের তালপাকা রোদে বেরিয়ে পড়েছিলাম এই সমীক্ষায়। কাঁধে ঢাউস সাইজের ভারি ব্যাগ, যার মধ্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়াও রয়েছে ক্যামেরা, জলের বোতল, ছাতি, গামছা মায় টর্চ্চও। কিন্তু আমাদের এই ক্ষেত্রপরিক্রমায় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ালো জাতীয় সড়ক। সহৃদয় পাঠক সমাজের হয়তো মনে আছে যে, রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট দপ্তরের চরম ঔদাসীন্যেই ২০০৪-০৫ সাল থেকে বছর দু’একের জন্য পুরোপুরি বন্ধ হয়ে পড়েছিল এই জাতীয় সড়কটি। সুতরাং বিকল্প শুধুমাত্র রেলগাড়ি। এখানেও তিল ধারণের কোনো জায়গা নেই! অগত্যা বলে কয়ে, ম্যানেজ করে,  কোনোক্রমে দাঁড়াবার সুযোগ পেতাম RMS কম্পার্টমেন্টে রাখা চিঠিপত্রের গাঁট-মটরির এক কোণে। এভাবেই কখনো বারৈগ্রাম, কখনো কায়স্থগ্রাম আবার কখনো সুপ্রাকান্দি কিংবা নিলামবাজার স্টেশনে গিয়ে নেমে পড়তাম। এরপর শুরু হত এক হাঁটু কাদা ভেঙ্গে দীর্ঘ পথ পরিক্রমা, কখনো বাংলাদেশ সীমান্তের পাথারিয়া,  তো কখনো দুহালিয়ার পার্বত্য পরিসরে। কখনো গামছা পরে এক কোমর কাদায় ডুবে পেরিয়েছি সাঁকো বিহীন অপ্রশস্ত খাল কিংবা ছোট্ট নদি। আবার কখনো বা প্রশস্ত নদী পেরোতে গিয়ে  এক বাঁশের সাঁকো অবলম্বন করে কাত হয়ে থাকা শীর্ণকায়া হাতলটিতে আঙ্গুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে কোনোক্রমে ব্যালান্স রেখেছি মাত্র। এভাবেই লঙ্গাই পেরিয়ে কায়স্থগ্রাম থেকে দাঁড়ারপার-ঘোগরাকোনার সমীক্ষা চালিয়েছিলাম। এই সব বিপদসংকূল পথ বেয়েই তো পাঠশালার ক্ষুদে শিশুরাও আসা-যাওয়া করতো! ক্ষেত্রপরিক্রমায় স্কুলের সার্বিক পরিকাঠামোর তেমন কোনো আশাপ্রদ চিত্রটি পরিলক্ষিত হয়নি, বরং বহুলাংশে সেটির নেতিবাচক রূপটিই প্রতীয়মান হয়েছিল আমার চোখে।

-দুই-

তেপান্তরের মাঠে-ঘাটে

এখানে উল্লেখ করতে হয় যে, নিলামবাজার-কায়স্থগ্রাম সন্নিহিত এলাকার ভৌগোলিক চিত্রটি নখদর্পণে ছিল আমাদের বিভাগীয় কর্মী অচিন্ত্য ভট্টাচার্যের। কায়স্থগ্রামের এই সহৃদয় ব্যক্তির সহায়তায় বেশ উপকৃত হয়েছিলাম এই পর্বে। আজ মনে পড়ে তাঁকে নিয়ে একদিন বেরিয়েছিলাম দূরগাঁয়ে ক্ষেত্রপরিক্রমায়। আমাদের এদিনের সমীক্ষায় ছিল দুহালিয়ার কোলে কোলে দাঁড়িয়ে থাকা একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। স্কুলের  অঙ্গন-বহিরাঙ্গনের সার্বিক চিত্রটি তেমন আশাপ্রদ ঠেকেনি এই অঞ্চল পরিক্রমায়ও। দেখেছিলাম একজন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীকে যে কতটুকু প্রতিকূল পরিস্থিতি, প্রতিবন্ধকতা এবং প্রভাবশালীদের দাপট ডিঙিয়েও    পালন করে যেতে হচ্ছিল তাঁদের নৈতিক দায়িত্ব। এই প্রসঙ্গে পরবর্তীকালের এক খণ্ডচিত্র আজ চোখে ভাসছে। কর্মজীবনে কোনো একসময় বরাক উপত্যকার অন্য এক জায়গায় ছিলাম বেশ ক’বছর। সেখানে একদিন কাজে যেতে হচ্ছিল দূরবর্তী কোনো এক স্থানে, পথে এক পাঠশালার সামনে দিয়ে যেতে যেতে দেখেছিলাম ওখানে বেশ বড়সড় জটলা, রয়েছেন জনাকয়েক নিরাপত্তা কর্মীও।  ঘন্টা তিনেক পর এই পথ ধরেই আবার ফিরে আসতে গিয়ে বিরাট যানজটের মধ্যে আটকে গেলাম। চারদিকেই নাগাড়ে আতশবাজি ফুটছে, আর ওদিকে ডালা নামানো সুসজ্জিত লরির উপর সদর্পে দাঁড়িয়ে রয়েছেন কেউকেটা একজন। রং-বেরংয়ের মালার ভীড়ে তাঁর মুখমণ্ডল প্রায় দেখাই যাচ্ছিল না। লরিটির আগে-পিছে, ডানে-বায়ে চেঁচিয়ে যাচ্ছিল কচি-কাঁচারা, জিন্দাবাদ-জিন্দাবাদ সুর তুলে ওরা মহামিছিলে পায়ে-পা মিলিয়ে চলছে। এক দোকানিকে জিজ্ঞেস করে জানলাম যে,  আজ উনি স্কুল পরিচালন সমিতির একজন মেম্বার হয়েছেন। অবাক বিষ্ময়ে তাকিয়ে থাকলাম। মনে মনে ভাবতে লাগলাম, মারকাটারি ভোটযুদ্ধের এই জয়লাভ কী নিছক সামাজিক স্বীকৃতি আদায় কিংবা আধিপত্যবাদের প্রতীক? পোড়খাওয়া স্কুলপ্রধানরা হয়তো বলতে পারবেন এজাতীয় উন্মাদনার অন্তর্নিহিত অর্থটা কী হত পারে। কেন জানি মনে হল, সেদিনের সেই নিষ্ঠাবান অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীর গুরুদায়িত্ব পালনে সম্যক প্রতিকূলতার সাথে এজাতীয় মহাযুদ্ধের কোনো যুগসূত্র নিহিত রয়েছে কী না!

যাই হোক, আমরা সেদিন এক এক করে বেশ কয়টি স্কুলের সমীক্ষা শেষ করে প্রায় পড়ন্ত বেলায় গিয়ে পৌঁছেছিলাম খাগাইল গ্রামে। যথারীতি কাজ সম্পন্ন করে এই গাঁ ছাড়তে না ছাড়তে প্রায় সন্ধ্যা নেমে এসেছিল। সহযাত্রী ভট্টাচার্য বললেন তাড়াতাড়ি যেতে হলে পাহাড়ি পথ ধরে না গিয়ে বরং কোনাকুনি হাওরের আল বেয়ে যাওয়াটাই ভালো।

ভুলবশত এদিন সাথে টর্চও নিয়ে আসিনি, কায়স্থগ্রাম অনেক দূর। ঘন অন্ধকার, তা আবার মেঘাচ্ছন্ন আকাশ, রাতে কর্দমাক্ত পথ বেয়ে হাঁটা-চলাও দুষ্কর। অন্ধকারের মধ্য দিয়ে চলতে গিয়ে হোচট খাচ্ছি বারবার। এর মধ্যে অচিন্ত্যবাবু বলে উঠলেন  – ‘ দাদা, বিপদে পড়ে গেলাম, আমি তো এখন আর কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা’। আমাকে হতবাক করে দিয়ে তিনি আরও  বললেন – ‘রাতে চলতে ফিরতে আমার বড় সমস্যা হয়।’ অর্থাৎ রাতকানা রোগ! সর্বনাশা সেই রাতে তাঁকে ধরে ধরে কোনোক্রমে গ্রাম পেরিয়ে সুবিস্তৃত হাওরে এসে পৌঁছলাম। এবার বেশ প্রত্যয়ের সুরে তিনি বললেন- ‘এখন আর চিন্তা নেই, আপনি শুধু খেয়াল রাখবেন সিঙ্গারিয়া বাজারের মশাল চোখে পড়ছে কি না।’ আত্মবিশ্বাসে ভর করে তিনি এবার বেশ জোরেই হাঁটা শুরু করলেন, আমি পেছন পেছন। কিছুদূর চলার পর ভট্টাচার্য বাবু সটান গিয়ে পড়লেন একবুক কাদাভরা ডোবায়। কাঁধের ভারি বোঝাটি  ক্ষেতের আলের উপর রেখে অনেক ক্লেশ স্বীকার করে তাঁকে খাল থেকে টেনে তুললাম। সর্বাঙ্গ পাক-কাদায় মাখামাখি-জবুথবু হয়েও তিনি বলে উঠলেন ‘এই নালাটিই বাজারের পাশে বড় খালে গিয়ে পড়েছে,  আর চিন্তা নেই দাদা, এবার পথ খোঁজে পেয়েছি, এখান থেকে সোজা পূর্ব-দক্ষিণ কোণ বরাবর কিছুদূর এগিয়ে গেলেই কাঁঠলআলা-সিঙ্গারিয়ার রাস্তা।’ কিন্তু বিপত্তি এখানেই, ঘোর তমসাচ্ছন্ন আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছিল কিন্তু সৃষ্টিকর্তার কম্পাস যন্ত্রটির কোনো খোঁজই পেলাম না, এমনকি চোখে পড়েনি মশালের কোনো নামগন্ধও! তাহলে দিক নির্ণয়ই বা করি কীভাবে! ‘ আউরি লাগা ‘ কথাটি সম্ভবত নিশুতিরাতের দিশাহীন হাওর থেকেই উৎপত্তি হয়েছিল। তেপান্তরের মাঠ নিয়ে অনেক গল্প শুনেছি, পড়েছি কত হাঁড় হিম করা ভুতুড়ে সব গল্প। এমনকি এধরণের ভূতের খপ্পরে পড়ে সারারাত ধরে আমাদের বাড়ির পশ্চিমদিকের হাওরে ঘুরচক্করে পড়ার গল্পও শুনেছি বিস্তর। মনে হল আমরাও বুঝি এবার এদেরই পাল্লায় পড়ে গেছি! আমার আশঙ্কাকে শতগুণ বাড়িয়ে দিল অচিন্ত্যবাবুর রামনাম জপ। অশরীরী কিংবা শরীরীর ভয়তাড়িত দুরু দূরু বুকে আমরা দ্রুতলয়ে হাঁটা শুরু করলাম ক্ষেত-জমিনের পিচ্ছিল আল বরাবর এবং হুড়মুড়িয়ে গিয়ে পড়লাম বর্ষাকালীন খামার ঘেরা একবেড়ার উপর। অচিন্ত্যবাবু গম্ভীরমুখে বললেন – ‘আবারও ভুল পথে এসে পড়েছি দাদা, আরও একটু বা-দিকে এগিয়ে কিছুদূর গিয়ে ডানদিকে মোড় নিলেই হয়তো বড় রাস্তাটি পেয়ে যাব।’ এভাবেই তেপান্তরের মাঠজুড়ে বারকয়েক চক্কর কেটে কেটে, ডান-বাম-সোজা হয়ে, ঈশান-অগ্নি-নৈঋত কোণ হাতড়ে হাতড়ে এবং বলাবাহুল্য  হোচট খেতে খেতেই একসময় হদিশ পেলাম বড় রাস্তার। অবশেষে এই পথ ধরেই সিঙ্গারিয়ায় গিয়ে পৌঁছলাম রাত-গভীরে। অন্ধকারের মধ্যদিয়ে এক হাঁটু কাদা মাড়িয়ে কায়স্থগ্রাম যাওয়াটা আর সম্ভব নয়, তাই অচিন্ত্যের পরিচিত সজ্জন ব্যক্তি তথা কীর্তনীয়া গোস্বামী মশায়ের বাড়িতেই সে রাতটুকু কাটিয়েছিলাম।

-তিন-

দোয়াইর ভীতি

দুহালিয়া পরিক্রমার দিন-চারেক পর কায়স্থগ্রামের অদূরবর্তী এক পাঠশালায় গিয়ে উঠেছিলাম। যথারীতি টিচারদেরকেও পেয়েছিলাম স্কুলে। কমনরুম থেকে একটু চোখ বুলিয়ে নিয়ে বুঝলাম কচি-কাচাদের হাজিরা রীতিমত বেশ আশাপ্রদই। তবে কেমন যেন থমথমে গুমোট পরিবেশ রয়েছে শ্রেণিকক্ষে! যাই হোক, ওখানে বসেই আনুষঙ্গিক অন্যান্য কাজগুলো সেরে নিচ্ছিলাম, এবং দেখলাম পড়ুয়ারা একটু যেন সন্দেহের দৃষ্টি নিয়ে আমাকে খেয়াল করছে। এরই ফাঁকে দু’একটি ছাত্রকে দেখে যেন  মনে হল, ওরা পালাবার সুযোগ খুঁজছে।

 কমনরুমের কাজ শেষ করে এবার  ব্যাগ-পত্তর নিয়ে এগোলাম শ্রেণিকক্ষের দিকে, সাথে শিক্ষকরাও। ক্ষুদে পড়ুয়ারা আমাকে আসতে দেখে ওরা যে যেদিকে পারল দৌড়ে পালাতে লাগালো। আমি হতভম্ব! এর কোনো কারণ খোঁজে পাচ্ছিলাম না। মুখ কাচু-মাচু করে দু’জন টিচারও দাঁড়িয়ে রয়েছেন আমার পাশে। হেড মাস্টার মশাইকেও তো দেখছিনা, উনিই বা গেলেন কোথায়!

একটু এদিক-ওদিক ঘুরে স্কুলটির পেছনে যেতেই চোখে পড়ল ক্ষেতি-জমির আল ধরে পালাচ্ছে সব বাচ্চাগুলো। তাদের পেছন পেছন দু-হাত তুলে দৌড়োচ্ছেন হেডমাস্টার মশাই, দু’একবার পিচ্ছিল রাস্তায় হোচট খেয়েও প্রাণপণ চিৎকার করে বলছেন  ‘ দোয়াই নায়রে, দোয়াই নায়রে … তোমরা যাইওনা, ঘুরিয়া আও, ঘুরিয়া আও।’ কে কার কথা শুনে, বাচ্চারা পেছন ফিরে তাকাচ্ছে আবার সামনে দৌড়োচ্ছে।

ব্যাপারটি এবার বোধগম্য হল। ভারি ব্যাগ-ট্যাগ নিয়ে অপরিচিত একজনকে স্কুলে আসতে দেখেই কচি-কাচারা ধরে নিয়েছিল ‘খুচু দেওয়ার’ ডাক্তার এসে পড়েছেন। বাড়ি থেকে নিশ্চয়ই তাদেরকে পই পই করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল খুচু’র ডাক্তার দেখলেই যেন ওরা পালিয়ে আসে। সমসাময়িক কালে একটি গুজব ভর করেছিল সমাজ মননে যে,  একটি প্রজন্মকে পঙ্গু করার উদ্দেশ্য নিয়েই স্কুলে স্কুলে বাধ্যতামূলকভাবে ভ্যাকসিন-টিকা প্রদান কর্মসূচী হাতে নেওয়া হয়েছে।সেই জুজুর ভয়তাড়িত অভিভাবকদের একাংশই নিশ্চয় তাদের শিশুদেরকে এরূপ ভয়ঙ্কর উৎপাত থেকে শত যোজন দূরে থাকার পাঠ দিয়েছিলেন। এবং আজ এটিরই এক প্রতিফলন উপলব্ধ হল এখানে এসে।

স্কুলে ছাত্র-শিক্ষকদের হাজিরার বিষয়টিও যে আমাদের ক্ষেত্র অধ্যয়নের এক অন্যতম অঙ্গ এবং  ফটোর মাধ্যমেও যে সেই চিত্রটি তুলে ধরার কথা রয়েছে, সে সংবাদটি যথারীতি স্কুল অবধি পৌঁছেছিল। সুতরাং গোটা বিষয়টি নেতিবাচক হলে তার জল যে কতদূর গড়াতে পারে, সেই ভীতি গ্রাস করে রেখেছিল মাস্টারমশাইকেও। তাই তিনি একরকম মরিয়া হয়েই ছুটছিলেন খুচুর ভয়ে পলায়নপর কচি-কাচাদের পেছন পেছন এবং প্রাণপণে চেচাচ্ছিলেন – ‘দোয়াই নায়রে – দোয়াই নায়রে —-।’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!