The Mirrow

উৎসবের সর্বজনীনতা ও তার অর্থনীতি

Share the Article

অভিজ্ঞান সেনগুপ্ত

 “মানুষের উৎসব কবে? মানুষ যেদিন আপনার মনুষ্যতের শক্তি বিশেষভাবে স্মরণ করে, বিশেষভাবে উপলব্ধি করে, সেইদি্ন ..  প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র, দীন, একাকী – কিন্তু উৎসবের দিনেও মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একাত্ম হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ।” (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘উৎসবের দিন’)

দূ্র্গাপূজা ঠিক কবে থেকে জমিদার বাড়ির চৌহদ্দী ছেড়ে জনগনের মাঝখানে প্রতিষ্ঠিত হলো, ইতিহাস খুঁজলে তার স্পষ্ট কোন দিনতারিখ পাওয়া যায় না। তবে নিশ্চিতভাবেই সে গত শতাব্দীর প্রথমভাগের কথা। ছোটবড় নানান মাপের রাজ অনুগ্রহ পরিত্যাগ করে মানুষের উৎসব হয়ে ওঠা মোটামুটিভাবে সাত-আট দশকের ঘটনা। ধনীর দুয়ার ছেড়ে পাড়ার বারোয়ারি পূজায় পরিনত হওয়া, অগনিত মানুষের যাপনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া .. এককের বৃহতের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ওঠা দূর্গাপূজাকে বাঙ্গালির অন্যতম শ্রেষ্ট উৎসবে পরিনত করেছে অনেকদিন থেকেই, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উভয় পরিসরেই। অপরটি অবশ্যই ঈদ, যদিও সংখ্যালঘুত্বের বৃত্ত অতিক্রম করে ঈদ-উল-ফিতর্‌ কখনই সমগ্র বাঙ্গালিকে এক করে তুলতে পারেনি। বা বাঙ্গালি এক করে নিতে চায়ওনি। যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, এবং কিছুটা হিন্দু বাঙ্গালির উৎসব পালনের আড়ম্বরের প্রভাবে ঈদের সামাজিক চরিত্রের অনেক বদল হয়েছে। ব্যক্তিগত পালনের জায়গা থেকে সরে ঈদও পাড়া মহল্লার সবার উৎসবে রূপান্তরিত।

দূর্গাপূজার ইতিহাস ঘাঁটলে এই বিবর্তনের ধারা স্পষ্ট হয়। এমনিতে মার্কণ্ডেয়পুরাণ অনুযায়ী রাজা সুরথ প্রথম বাংলাদেশে দুর্গাপূজা করেছিলেন। তবে বাংলায় সর্বপ্রথম সাড়ম্বরে দুর্গাপূজার প্রচলন করেন সম্রাট আকবরের আমলে বাংলার বারভূঁইয়ার অন্যতম রাজশাহী জেলার তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ণ। ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দে রাজা কংসনারায়ণ এই শারদীয় দুর্গোৎসবে তখনকার দিনে সাড়ে আট লাখ টাকা ব্যয় করেছিলেন। তার দেখাদেখি ভাদুড়িয়ার জমিদার জগৎনারায়ণ ওই বছরই বসন্তকালে বাসন্তী দুর্গোৎসব করেছিলেন ৯ লাখ টাকা ব্যয়ে। কিন্তু তার পূজা কংসনারায়ণের অনুরূপ জনপ্রিয়তা পায়নি। আবার কালীপ্রসন্ন সিংহ লিখেছেন, “বোধহয় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমল হতেই বাংলায় দুর্গোৎসবের প্রাদুর্ভাব বাড়ে।” ১৭২৮ সালে নদিয়ার সিংহাসনে বসেন রুদ্র রায়ের প্রপৌত্র কৃষ্ণচন্দ্র রায়। কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের আগে তাঁর পূর্বপুরুষেরা দুর্গাপূজা করতেন, কিন্তু তাঁর হাত ধরেই জাঁকজমক সহকারে দুর্গাপূজার প্রচলন হয়। মতান্তরে বাংলায় বারোয়ারি পুজোরও উদ্ভব এই সময়েই।

এই সময়েই অন্য এক চিঠিতে জানা যায়, ‘এবার পুজোর সময় লর্ড ক্লাইভ আমার বাড়িতে অনুগ্রহ পূর্বক প্রতিমা দর্শন করিতে আসিবেন। তাঁহার সহিত কোম্পানির বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত থাকবে তোমার আসা চাই’___ শোভাবাজার রাজবাড়ির রাজা নবকৃষ্ণ দেব তাঁর বন্ধুকে চিঠিতে একথা লিখছেন। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হন। সেই পরাজয়ের অন্যতম উল্লসিত ব্যক্তিরা হলেন নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও কলকাতার রাজা নবকৃষ্ণ দেব। ক্লাইভের পরামর্শে তারা পলাশীর যুদ্ধের বিজয় উৎসব করেন দুর্গোৎসবের মধ্য দিয়ে। আর তাতে তাঁরা প্রচুর অর্থ খরচ করেন। এর পর থেকে প্রতিবছর শরৎকালে দুর্গা পূজা করে তারা পলাশীর যুদ্ধের স্মারক উৎসব পালন করতেন। আরও মজার ব্যাপার হলো তাদের দেখাদেখি অন্যান্য হিন্দু জমিদার বা ব্যবসায়ীরাও দুর্গোৎসব পালন করতে শুরু করেন।

যদিও বাংলায় দুর্গাপূজা দশম অথবা একাদশ শতকেই প্রচলিত ছিল। কংসনারায়ণ কিংবা কৃষ্ণচন্দ্রের সময় থেকে তা জাঁকজমকের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হতে থাকে। উনিশ শতকে কলকাতায় মহাসমারোহে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হতে  শুরু করে। অষ্টাদশ শতকের শেষ অব্দি ইউরোপীয়ানরাও দুর্গোৎসবে অংশগ্রহণ করত। হান্টারের ‘Anals of Rural Bengal’ এর উল্লেখিত  জন চিপস সাহেব বা বীরভূমের জনপ্রিয় ‘শ্রীযুক্ত চিক বাহাদুর’ সুরুলে কোম্পানির দেওয়া সাহেবের কুঠিতে ধুমধাম করে পূজা শুরু করেন । চিপস সাহেবের পূজা বাবদ বছরে ৫০ টাকা পুজোর খরচ ও ১৭ টাকায় গাঁয়ের লোককে নতুন কাপড় দেওয়া হতো আর খাওয়ানো হতো। এই উপলক্ষ্যে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ধনীদের গৃহে বাইজি, নর্তকী এবং গায়িকারা অংশগ্রহণ করত। কোথাও কোথাও যাত্রাগান,পাঁচালি ও কবিগানের আসর বসত। দুর্গাপূজাকে ঘিরে ধীরে ধীরে একটা উৎসবের সুত্রপাত দেখা যাচ্ছিল। যদিও এইসব পুজোর সঙ্গে আমজনতার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ বিশেষ ছিল না বললেই চলে। তারা আনন্দ পেয়েছে, তবে সেটা প্রসাদ খাওয়ার, বাদ্য-বাজনা শোনার, দূর থেকে দেখার আনন্দ। পূজার আয়োজন প্রধানত সীমাবদ্ধ ছিল বিত্তশালী পরিবারগুলির মধ্যে। শুধু অর্থনৈতিক অসাম্য নয়, জাতপাতও  ছিল সমাজের তথাকথিত ‘উচ্চ শ্রেণির’ বাড়ির পুজোতে সাধারন মানুষের যোগদানের অন্যতম বাধা।

ঊনিশ শতকে রামমোহন-বিদ্যাসাগর প্রমুখের হাত ধরে বাংলার সামাজিক আন্দোলনের ফলে ইংরেজি ও পাশ্চাত্য ধারার শিক্ষার প্রসার ঘটে। পাশাপাশি ঘটে সমাজের নিম্নশ্রেণী ও মেয়েদের শিক্ষার প্রচলন। এতকাল সামাজিক ক্ষেত্রে যে কর্তৃত্বের রাশ ছিল বিত্তবানদের হাতে, শিক্ষার ব্যপক বিস্তারের ফলে সাধারণ মানুষও বলশালী হয়ে উঠতে আরম্ভ করল। অন্য দিকে রাজনৈতিক পরিসরে ইংরেজদের অপশাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ থেকে তৈরি হয়েছে নীল বিদ্রোহের মত নানা জনসংগ্রাম। ওই সমস্ত বিদ্রোহ-আন্দোলন অনেক ক্ষেত্রেই দেশীয় অভিজাত বিত্তশালীদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের দূরত্ব কমিয়ে আনার কাজে সহায়ক হয়েছিল। বিংশ শতকের ‘স্বদেশি আন্দোলন’ বাংলার শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলকে একত্রিত হবার সুযোগ এনে দিল। রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রের এই নৈকট্য সাধারণ মানুষকে সাহস জোগাল কেবলমাত্র ধনী বাড়ির পুজো, এই তকমা থেকে সরে এসে দুর্গাপুজোর সর্বজনীন পুজোয় উত্তরণে। এই ইতিবৃত্ত মোটামুটি একশো বছরের পুরনো। গত শতকের বিশের দশকের গোড়ার দিকে এই বিবর্তনের শুরু।। মোটামুটিভাবে ১৯১০ সালে কতিপয় যুবক ও ব্যবসায়ী মিলিত হয়ে ‘ভবানীপুর সনাতন ধর্মোত্সাহিনী সভা’ প্রতিষ্ঠা করে। আরম্ভ করে দুর্গাপুজো। শহর কলকাতার প্রথম বারোয়ারি পুজো। ঘরের পূজা নেমে এল রাজপথে। বারোয়ারি বা সার্বজনীন দুর্গাপূজা, যার পরিচালনা করে বিভিন্ন সংঘ বা সমিতি। “বারোইয়ারি” বা “বারোয়ারি” শব্দটির উৎপত্তি “বারো” (১২) ও “ইয়ার” (বন্ধু) শব্দদুটি থেকে। ১৭৯০ (বাংলা ক্যালেন্ডারে ১১৬৬ সালে) সালে হুগলির গুপ্তিপাড়ায় বারোজন যুবক একটি সর্বজনীন পূজা করবেন বলে মনস্থ করেন। প্রতিবেশীদের থেকে চাঁদা তুলে আয়োজিত হয় সেই পূজা যা লোকমুখে “বারোয়ারি পূজা” নামে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

১৯৪০ এর দশকে এই পূজা বিস্তৃত রূপ গ্রহন করে। এ সময়ে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, মন্বন্তর, এবং বৃহত্তর সামাজিক প্রেক্ষিতে যৌথ পরিবারগুলি ভেঙে যাওয়ার মধ্য দিয়েই কমে আসে বাড়ির পুজোর সংখ্যা, আর ম্লান হয় তার জৌলুস। ফলে পাড়ার পুজার প্রচলন বাড়ে। মুলত মন্বন্তরের প্রেক্ষিতে ১৯৪৩-এর শারদীয় আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লেখা হয়, “যিনি অন্নপূর্ণা, কুবের যাঁহার ভাণ্ডারী, তিনি কাঙ্গালিনীর বেশে ভিক্ষাপাত্র করে লইয়া তোমার দ্বারে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন।” যুদ্ধের কারনে বাঙালির অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পরে, মধ্যবিত্ত বাঙালির ক্রয়ক্ষমতায় চিড় ধরে, জামাকাপড় আর খাদ্যদ্রব্যের দাম হয় আকাশছোঁয়া। ১৯৪৬ এর দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ, স্বাধীনতা সংগ্রামের তীব্রতা পুজোর জাঁকজমককে খানিকটা ম্লান করলেও, সর্বজনীন পুজো হিসেবে দুর্গাপুজোর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এক নতুন আঙ্গিকে পূজা প্রচলিত হয়। বদলে যাওয়া সেই উৎসবের আদলটা ভেঙেচুরে দেয় সামাজিক স্থবিরতাকেও। নিম্নবর্গীয় হিন্দুরাও শুরু করেন সর্বজনীন পুজোর আয়োজন। আবার অভিজাত পরিবারের সদস্যরাও বিশেষ করে মহিলারাও সর্বজনীন পুজোর উৎসবের শরিক হতে শুরু করে। পূর্বে বড় বাড়ির পূজায় বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের আংশগ্রহন শুরু হতে থাকলেও পূজার অধিকার সীমাবদ্ধ ছিল উচ্চবর্ণের ধনীদের হাতে। যেমন কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সময় কুম্ভকারেরা প্রতিমা তৈরি করত, মুসলমান শিল্পীরা এঁকে দিত দেবীর চোখ, মুখ, নাক। বাগদি শ্রেণির লোকেরা এনে দিত পূজার পদ্মফুল। দুলে শ্রেণির লোকেরা হত দেবীর বাহক .. ইত্যাদি। কিন্তু সর্বজনীন উৎসবের মধ্যে দিয়ে ধনী-নির্ধন, হিন্দু ও অ-হিন্দু, উচ্চ-নীচ নির্বিশেষে সকল মানুষ সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারল, ধর্মীয় আচরণ সেখানে গৌণ উপকরণ মাত্র। স্বাধীনতার পর শহর কলকাতা ছাড়িয়ে সুদুর মফস্বলে, উত্তরবঙ্গের চা বাগান এলাকায়, পশ্চিমের কোলিয়ারি অঞ্চলে সর্বজনীন দুর্গাপূজা প্রচলন বিস্তৃতি লাভ করে। আর একশ বছরের এপারে বড় শহর থেকে ছোট শহর, মফস্বল থেকে গ্রাম বাংলা, বারোয়ারি দুর্গাপূজা সর্বজনীন উৎসবে রূপান্তরিত।

পশ্চিমবঙ্গে শারদোৎসবের চেহারা চরিত্র কালক্রমে কী ভাবে বদলাইয়াছে, এই বিষয়ে উৎসবের অর্থনীতি সম্পর্কিত আলোচনা অত্যন্ত জরুরি কিন্তু নিতান্তই বিরল। দুর্গাপূজার অর্থনৈতিক ইতিহাস বাঙালি সমাজের বিবর্তনের চরিত্র বুঝিবার পক্ষে বিশেষ উপযোগী। ইতিহাসের পথ ধরেই নানা লৌকিক দেবদেবীর আরাধনাকে সমাজের নিম্নস্তরের মানুষজন অঞ্চলভেদে তাদের ধর্মাচরনের প্রধান উপজীব্য করেছে। কিন্তু দূর্গাপূজার ন্যায় আদতে উচ্চশ্রেনীর, সামন্ততান্ত্রিক সমাজের একটি ধর্মীয় প্রথা বাঙ্গালীর প্রধানতম উৎসবে রূপান্তরিত হওয়ার পেছনে সামাজিক কারনের পাশাপাশি তার অর্থনৈতিক বাস্তবতারও ভুমিকা বর্তমান। সপ্তদশ শতক থেকেই ইংরেজদের সঙ্গে বাণিজ্য করে বা তাদের ব্যবসা-সহায়ক হয়ে এক শ্রেণির মানুষের হাতে জমে উঠতে থাকে প্রভূত ধনসম্পত্তি। আর সে যুগে যেহেতু বিত্ত ভোগ করার প্রচুর আয়োজন বিশেষ ছিল না তাই দুর্গাপুজো ক্রমশ হয়ে ওঠে বিত্তবান শ্রেণির বৈভব প্রদর্শনের অন্যতম মাধ্যম। কলকাতায় যত বাড়তে থাকে ধনীর সংখ্যা, সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দুর্গাপুজোর সংখ্যাও। কলকাতা প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র হওয়ায় আশপাশের জেলাগুলিতেও তার প্রভাব পড়ে। আবার ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়াও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তোর কারণে গ্রামাঞ্চলেও এক শ্রেণির বিত্তশালী জমিদার গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটল। শুরুতেই এইসব রাজারাজরা, জমিদার, বাংলার ধনীক শ্রেণীর উদ্যোগে অনুগ্রহে প্রচলিত হওয়ায় দু্র্গাপূজা জনজীবনে একটা সামাজিক মান্যতা লাভ করতে থাকে। এর সঙ্গে অবশ্যই অর্থনৈতিক ক্ষমতার একটা সরাসরি সম্পর্ক ছিল। শহর বা গ্রামে প্রতিষ্ঠিত বিত্তবান বাবুদের পূজাকে কেন্দ্র করে কিছু পেশাজীবি মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরী হয়। কুম্ভকার, তন্তুবায়, ঢাকি থেকে সাজসজ্জা তৈরি, দেবীর বাহক, জোগানদার, বাজনাদার, মালী, মজুর, পাচক, কবিয়াল … এরকম নানান কাজে নিম্নশ্রেনীর ও মুসলমান প্রজারা নিযুক্ত হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যত দুর্গাপুজা সর্বজনীন উৎসবের রূপ পরিগ্রহ করেছে, ততই অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের প্রসার ঘটেছে। যেমন ঢাকি, বাজনা, প্রতিমাসজ্জা, অলংকরন, মুদ্রণ শিল্প, মৃৎশিল্প, আলোকশিল্প, ডেকোরেটর, ফলফুল-মিষ্টি, সঙ্গীত থেকে নানা সাংস্কৃতিক শিল্প, রেস্তোরা-পর্যটন, জামাকাপড়, নানান ভোগ্যপণ্য থেকে বিলাসদ্রব্য, পরিবহন, মিডিয়াশিল্প ইত্যাদি অর্থনীতির নানা ক্ষেত্রে সমৃদ্ধি আসে।

বাংলার দুর্গাপুজো এক বিরাট বিকল্প অর্থনীতি, সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হওয়ার সঙ্গে মানুষ অর্থনৈতিক দিক দিয়েও নানাভাবে উপকৃত হয় এই দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে। একই কথা ঈদের ক্ষেত্রেও সত্য। দুর্গাপূজার সঙ্গেই ঈদ বাঙালির অন্যতম প্রধান উৎসব। তবে ধর্মীয় জাঁকজমকের বিচারে এই বাংলায় কিংবা আসাম, বিহার, দিল্লী ইত্যাদি রাজ্যে যেখানে বাঙালি হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ, ঈদ স্বাভাবিকভাবেই ততটা অর্থনৈতিক ঢেউ তৈরী করে না যা দূর্গাপূজায় তৈরী হয়, এমনকি বাঙালি হিন্দুর অন্যান্য উৎসব যেমন কালিপূজা, জগদ্ধাত্রী পূজা বা অন্যান্য ধর্মীয় আয়োজনে অঞ্চলভেদে জাঁকজমক হলেও এই মাপের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বা সর্বজনীনতা তৈরী হয় না। একসময় অবশ্য গ্রাম বাংলায় নতুন ফসল ওঠার সঙ্গে সঙ্গে নগদ অর্থের আগমন ঘটত, ফলে নবান্ন হয়ে উঠত একটা উৎসব। নতুন জামাকাপড়, নতুন পণ্যের কেনাকাটায় গ্রামগঞ্জের হাটবাজার গমগম করত। পাড়ায় পাড়ায় জলসা, গান-বাজনা, যাত্রা-আলকাপের সুরে মেতে থাকত পল্লীসমাজ। এখন কৃষির বিপন্নতার সঙ্গে কৃষকের অবস্থার পরিবর্তনে নগদ অর্থে টান পড়েছে, নবান্নও উৎসবের বদলে একটা গতানুগতিকতায় পরিনত হয়েছে। সুতরাং সীমানার এপারে অর্থনীতির ধারেভারে দুর্গাপূজাই বাঙালির প্রধানতম উৎসব হয়ে উঠেছে।

দুর্গাপূজায় ঠিক কত টাকার লেনদেন হয়?  ১৯৩৫ সালের একটি হিসাব থেকে জানা যায়, সে বছর পুজোয় খরচ হয়েছিল ৭০১ টাকা ৩ আনা ৫ পয়সা!  ১৯৩০-এ যে পুজোয় খরচ হয়েছিল ৩ হাজার টাকা, আজ সেখানে ১০-১৫ লক্ষ টাকা বাজেট। ১৯৫৪ সালে ‘ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি’-তে একটা প্রবন্ধ ছাপা হয় দুর্গাপুজোর অর্থনীতি নিয়ে। সেবছরও বিপর্যয়ের বছর- উত্তরবঙ্গে বন্যা, আর দক্ষিণবঙ্গে খরায় প্রচুর অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। কর্মীরা মাইনে পাননি। চারিদিকে প্রতিবাদ, স্লোগান, পুজোর বোনাসের জন্য রাস্তায় চলছে আন্দোলন। সেইবছরও পুজো যে বঙ্গজীবনকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছিল, জামাকাপড়, জূতো, উপহার-সামগ্রী ইত্যাদি বিক্রি এবং ছাড়, পূজাসংখ্যা বিক্রি প্রভৃতি অর্থনৈতিক পরিমাপের সূচকের বিচারে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না। এরপর পুজোর জৌলুস বেড়েছে উত্তরোত্তর, এমনকি দীর্ঘ বাম শাসনেও পশ্চিমবঙ্গে দুর্গাপূজা উৎসবের চেহারা গ্রহণ করেছিল। আজকের থিম পুজো, তাকে ঘিরে প্রতিযোগিতা, উন্মাদনা সবই আমাদের সমাজ-জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ এখন। দুর্গাপুজোর উৎসবকে ঘিরে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি ফুলে-ফেঁপে উঠছে কোনো সন্দেহ নাই। এর সঙ্গে যুক্ত আছে নানান ভোগ্যপণ্য কেনাকাটা, খাওয়াদাওয়া, ঘোরাঘুরি, মনোরঞ্জন, সাংষ্কৃতিক কর্মকান্ড, মিডিয়া ইত্যাদি নানা ক্ষেত্র।

২০১৩ সালে অ্যাসোসিয়েটেড চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি অব ইন্ডিয়া বা ‘অ্যাসোচ্যাম’ একটা রিপোর্ট বার করেছিল। তাতে সেই বছর পশ্চিমবঙ্গের পুজোর অর্থনীতির বহরটাকে হিসেব করা হয়েছিল ২৫ হাজার কোটি টাকা। ঈদ ও পুজো ঘিরে লেনদেন ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। মনে রাখতে হবে, সে বিশ্বজুড়ে এক সার্বিক মন্দার বা তার ঠিক পরের সময়কাল। যার আঁচ থেকে বাঁচতে পারেনি ভারতের অর্থনীতিও। তাই সার্বিক ভাবে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমেছিল নিশ্চয়ই। অবশ্য ইতিমধ্যেই জনগণের চাঁদায় পুজোর দিন ফুরিয়েছে। শহর কলকাতা বা বড় শহরের পূজোর নব্বই শতাংশ বা তারও বেশি খরচ আসে বিজ্ঞাপন থেকে। বড় শহরের পূজা কমিটির আয়ের উৎস এখন করপোরেট স্পন্সরশিপ, প্যান্ডেলের বাইরে বিজ্ঞাপন, স্যুভেনির বিজ্ঞাপন, টেলিভিশন স্বত্ব বিক্রি করা প্রভৃতি। যদিও জেলা সদর বা মফস্বলের পূজা এখনোও চাঁদা নির্ভর, গ্রামে-গঞ্জে তো বটেই। অ্যাসোচ্যামের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, দুর্গাপুজোর অর্থনীতির বার্ষিক বৃদ্ধির হার নাকি ৩৫ শতাংশ। বিস্ময়কর বৃদ্ধির হার। গত ছ’বছরে যদি তা অপরিবর্তিত থেকে থাকে, তবে এই হিসেবে উৎসবের অর্থনীতিটা ২০১৯-এ প্রায় দেড় লক্ষ কোটি টাকা, যা পশ্চিমবঙ্গের জিডিপি-র ১০ শতাংশেরও বেশি। এটি একটি অনুমান মাত্র, বাস্তবে কতটা হল তা মালুম হবে অর্থ দপ্তরের রাজস্ব আয়ের হিসাব থেকে। এই সময় ঈদ আর পূজা মিলিয়ে ৫ কোটি কর্মচারি গড়ে ৩ হাজার টাকা করে ১৫ হাজার কোটি টাকা বোনাস পায়, যার পুরোটাই খরচ হয় এবারের পুজো আর ঈদ উৎসবে। এই খরচের বড় অংশটাই হয় দুর্গাপুজোর সময়। আইএসআইয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক অভিরূপ সরকারের কথায়, ‘বছরভর পশ্চিমবঙ্গে যত ব্যবসা হয়, তার সিংহভাগই হয় পুজো ঘিরে।‘ দুর্গাপুজোকে ঘিরে পশ্চিমবঙ্গে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশী বাজার তৈরি হয় (২০১৫)। কলকাতার কোনো কোনো পূজার আয়োজনে ব্যয় হয় ১০০ থেকে ১৫০ কোটি টাকা। প্যান্ডেল, প্রতিমা, আলো, সাজসজ্জাতেই খরচ হাজার হাজার কোটি, মোট লেনদেনের প্রায় ৪০ শতাংশের বেশী। আর রয়েছে কেনাকাটা, খাবার-দাবার, বেড়ানো, কী নয়। এই সময় নতুন পোশাকের সঙ্গেই মোবাইল,টিভি, মাইক্রোওয়েভ, ফ্রিজ, নতুন আসবাব, গাড়ি .. সব কিছু কেনারই হিড়িক পড়ে। নিজেদের পণ্য চেনানোর জন্য বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলি নানান রকম ছাড় ঘোষনা করে। বিভিন্ন ছোট-বড় দোকান, শপিং মল থেকে রাস্তার ধারে হকারদের কাছ থেকেও ঢালাও কেনেবেচা চলে। আগে মানুষ বাজারের এ-দোকান ও-দোকান ঘুরে কেনাকাটা করতেন। এখন শপিং মলে কেনাকাটার ঝোঁক বেশি। অনেকে অনলাইনেও পুজোর বাজার সারেন। কেনাকাটির চরিত্র পাল্টালেও উৎসবের অর্থনীতির বহর প্রতিবছর বেড়েই চলেছে। আরেকটি হিসাবে ২০১৬ সালে খড়্গপুর আইআইটি-র সঙ্গে লন্ডনের কুইন্স মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষা অনুযায়ী, শুধু দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে বছরে ৩২,৩৭৭ কোটি টাকার লেনদেন হয়, যা রাজ্যের জিডিপি-র ২.৫৮%।” অন্তত ২০১৯ পর্যন্ত এই বৃদ্ধি হয়েছে। এর পরে করোনা অতিমারি বিগত দুই বছরে এই বাজারে থাবা বসালেও উৎসবের লেনদেনকে পুরোপুরি নষ্ট করতে পারেনি। বরং বদলে গেছে কেনাকাটার মাধ্যম। অনলাইন কেনাকাটায় বিপ্লব এসেছে। যেমন, গত বছরই উৎসব সেলের প্রথম আড়াই দিনে অ্যামাজ়ন, ফ্লিপকার্ট, স্ন্যাপডিলের মতো ই-কমার্স কোম্পানি বিক্রি করেছে ১১ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর অর্ধেকের বেশি আবার বিকিয়েছে স্মার্টফোনের ব্যবসায়। তাই ক্রেতার ক্ষমতা, আকাঙ্ক্ষা, মাধ্যম বদলের সঙ্গে উৎসবের অর্থনীতিও বদলাচ্ছে।

সাধারনভাবে পূজার কেনাকাটা, আয়োজনে কয়েক মাস আগে থেকেই শুরু হয়। কিন্তু খেটে খাওয়া, প্রান্তিক শ্রেণির মানুষদের কেনাকাটা শুরু হয় পুজোর ঠিক আগে মাস মাইনের পরে, এমনকি ঢাকি, বাজনাদার, আলো কিংবা প্রতিমাশিল্পীদের কেনাকাটা পূজার শেষ হলে হয়, মজুরি পাওয়ার পরেই।। এমন নিম্নবিত্ত মানুষদের ভরসা অসংগঠিত ক্ষেত্রের হকারেরা। কনফেডারেশন অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুশীল পোদ্দারের বক্তব্য, ‘দুর্গাপুজোয় কেনাকাটা সবে শুরু হয়। তার পর লক্ষ্মীপুজো, কালিপূজা-দীপাবলি, ভাইফোঁটা, ছট মিলিয়ে বিকিকিনির ব্যাপ্তি বিশাল। টাকাকড়ির হিসাবে এর মোট পরিমান ঠিকঠাক মালুম করা কঠিন। কেননা, প্রতিষ্ঠিত বিপণি ছাড়াও ফুটপাথের হকারদের কাছেও দেদার ভিড় হয়।‘  হকার সংগ্রাম কমিটির সুত্রে জানা যায়, কলকাতা শহরের ফুটপাথে ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করেন কমবেশি ২ লক্ষ ৭৫ হাজার জন হকার, যাদের ৪০ শতাংশই মহিলা। নিম্নমধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত মানুষের চাহিদা মেটায় ফুটপাথে সাজানো হরেক রকম পসরা। বিভিন্ন ছোটবড় শহরেও তাই। মোট ব্যাবসার প্রায় ৩৫ শতাংশ এই হকারদের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। দৈনিক যে পরিমাণ সামগ্রী হকাররা বিক্রি করেন, তাতে লভ্যাংশ থাকে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। দুর্গাপুজোর সময় হকাররা ফি বছর যে পরিমাণ ব্যবসা করেন তাতে দুর্গাপুজোর পরের ৬ মাস চলার মতো পুঁজি তাঁদের হাতে জমে। যদিও গত দুই বছর অতিমারির কারনে বর্তমান পরিস্থিতিতে হকারদের আর্থিক আবস্থা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। একদিকে আয় প্রায় শুন্য হয়ে যাওয়া অন্যদিকে মহাজনের ঋনশোধের চাপ। লকডাউন পর্বে ভারতের হকারদের দৈনিক ৮০০ কোটি টাকার ব্যবসায়িক ক্ষতি তাদের দিশেহারা করেছে। ২০২১ এ পূজায় যেটুকু ছাড় পাওয়া গেছে তাতে তারা তাদের ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে, অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে বাজার কিছুটা ওঠায় তাদের মুখে হাসি ফিরেছে।

বোনাস পেয়েছে যেমন কর্মচারিরা, তেমনই পেয়েছে উত্তরবঙ্গের সমতলের চা শ্রমিকরাও। তারা এবারও ২০ শতাংশ হারে পুজো বোনাস পাবেন। চা শ্রমিকদের বোনাস নিষ্পত্তি হওয়ায় কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে ঝিমিয়ে পড়া ডুয়ার্সের অর্থনীতি ও দুর্গাপুজোর বাজার অনেকটা‌ই চাঙ্গা হয়ে উঠবে। তবে দার্জিলিং পাহাড়ের চা শ্রমিকদের পুজোর বোনাসের এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। উত্তরবঙ্গের পাঁচটি জেলায় ৩০২টি পূর্ণাঙ্গ চা বাগান রয়েছে। এর বাইরে আছে প্রচুর ক্ষুদ্র চা বাগান। শুধু সমতলের ১৮৩টি বাগানের শ্রমিকদের বোনাস নিষ্পত্তি হয়েছে। ৩০২টি চা বাগানের সঙ্গে সরাসরি প্রায় পাঁচ লক্ষের কাছাকাছি চা শ্রমিক যুক্ত। ডুয়ার্সের চা বাগান লাগোয়া হাট ও বাজারগুলি চাঙ্গা হইয়ে উঠেছে। হাসি ফুটেছে চা শ্রমিকদের মুখেও। দীর্ঘ আন্দোলনের পর মজুরি বেড়েছে বিড়ি শিল্পেও।

বাংলার গ্রামীন উৎসব অর্থনীতির আরেকটি বিশেষ উপাদান হলো মেলা। নানান পূজা-পার্বন, পরব ইত্যাদি উপলক্ষে বিভিন্ন জায়গায় মেলা বসে। দুর্গাপূজাতেও তাই হয়, আরো ব্যাপক ভাবে। সব ধর্মের সব বয়সী মানুষ জড়ো হন মেলায়। খোলা আকাশের নিচে শামিয়ানা টানিয়ে সারি সারি বসে অসংখ্য অস্থায়ী দোকান, তাদের হরেকরকম পসরা- নানারকম খেলনা, প্রসাধনসামগ্রী, মাটির পুতুল, কাচের চুড়ি, রঙিন ফিতা, নানা পদের মিষ্টি, সুস্বাদু খাবারের দোকান,নাগোরদোলা, ভেলকিবাজি .. আরো কত কি। গ্রামের কামার, কুমার, ছুতার ও ঋষি সম্প্রদায় তাদের নিজ হাতে তৈরি সামগ্রী সাজিয়ে বসেন। কেনাবেচা চলে। শহরেও বড় পূজার আশেপাশেও নানান খাবার, খেলনা, সাজগোজের জিনিসের দোকান নিয়ে হাজির হন দোকানীরা। গত বছরের বাধানিষেধের পরে এবছর আবার মেলা বসেছে, ভালো বেচাকেনা করেছেন তারা।

এইভাবেই উৎসব অর্থনীতিতে ঢেঊ তোলে। এইভাবেই নিছক পূজার আরাধনা ও প্রার্থনার গণ্ডি পেরিয়ে শারদীয় দুর্গোৎসব রূপ নিয়েছে এক সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যম হিসেবে, বিশাল পরিধির আবর্তে আবিষ্ট করেছে দেশের অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলকে। পৃথিবীর আর কোথাও এইভাবে কোনও একটা উৎসব কোনও দেশ, রাজ্য, কিংবা জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক পরিসরকে এতটা গভীর ভাবে প্রভাবিত করতে পারেনি। ‘রিয়োকার্নিভাল’-এর মতো জগদ্বিখ্যাত উৎসবের অবদান জিডিপির ৩ শতানশেরও কম, জাপানের চেরি ফোটার উৎসব ‘হানামি’র অবদান জিডিপি-র সোয়া দুই শতাংশের আশেপাশে, মিউনিখের বিশ্ববিখ্যাত ‘অক্টোবরফেস্ট’-এর অবদান মোটামুটি ১.৩৫ শতাংশ ..। বাংলার পুজোর তুলনা কেবল ক্রিসমাস, রমজান বা চাইনিজ় নিউ ইয়ারের সঙ্গে। হাজার হাজার কোটি টাকার হাতবদল হয় এই উৎসবগুলোতে, আর সেই টাকা যতবার হাত বদল হবে ততই পরিমানে বাড়ে, ফলে একটা মাল্টিপ্লায়ার এফেক্টে তা গোটা অর্থনীতিতে ছড়িয়ে পড়ে। যদিও উৎসবের অর্থনীতি কোনো স্থায়ী মুলধনী দ্রব্য উৎপাদন করে না, কিন্তু ভোগ্যপণ্যের যে বিপুল চাহিদা তৈরী হয় এবং এর সাথে বিশাল অসংগঠিত ক্ষেত্রের যে সমৃদ্ধি ঘটে, ঋনের বাজার প্রসারিত হয়, পর্যটন-পরিবহন শিল্পের প্রসার ঘটে .. তা সমগ্র আর্থিক কাঠামোয় একটা ধনাত্বক প্রভাব তৈরী করে, বিশেষ করে এই আর্থিক মন্দার সময়।

মানুষের কর্মসংস্থান, রুটিরুজি যুক্ত থাকে উৎসবের প্রক্রিয়ায়। নিচু থেকে উঁচুতে, উৎসবকালীন অর্থনীতি দেশের আর্থিক পরিস্থিতিকে উন্নত করে। অর্থনীতি ধর্মে ধর্মে ভেদ-বিভেদও করে না৷ এখানে সবাই অর্থনীতির অংশ ও অংশীজন মাত্র। উৎসবের মুহুর্তে জাতপাত-ধর্ম নির্বিশেষে সবার সাথে লেনদেনে যেতেই হবে। সেটা ব্যক্তিই হোক বা রাষ্ট্র। অর্থনীতি বিষয়টাই সর্বজনীন, সর্বব্যাপী ও সর্বগ্রাসী। অর্থনীতিতে কোনো ভেদাভেদ নেই। উৎসবের অর্থনীতিতেও নেই। তাই উৎসব বন্ধ হলে কাজ হারাবেন বাংলার হাজার হাজার মানুষ, জাত-ধর্ম নির্বিশেষে। পুরো অর্থনীতি একটি প্যারাডক্স অফ থ্রিফটের সিচুয়েশনে চলে যাবে। সকলের ব্যয় কমবে, সুতরাং সকলেরই আয় কমবে। উৎসব আমাদের জীবনযাত্রার প্রতি স্তরে এমন ভাবে প্রভাব বিস্তার করে আছে যে, তার অর্থনীতির বহর কিংবা বৃদ্ধির হার হিসেব করা বেশ কঠিন হলেও তার ব্যাপকতা অনুমান করা অসম্ভব নয়। আমরা দেখতে পাই, দুর্গাপুজো ইতিমধ্যেই চার-পাঁচ দিনের উৎসব থেকে পুরোদস্তুর ১০-১২ দিনের জাঁকজমকে পরিণত হয়েছে। সেও আসলে অর্থনীতির প্রয়োজনেই। ধনতান্ত্রিক কাঠামোয় উৎসব এখন পুরোদস্তুর পণ্য, সবচেয়ে বড় বাজার। একে অগ্রাহ্য করে কার সাধ্য।

এইজন্যই অতিমারি’জনিত আর্থিক দূরাবস্থার প্রতিষেধক হিসাবে উৎসবকেই লক্ষ্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের বক্তব্য অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য যে-কোনও সামাজিক উৎসবই একটা সুযোগ উঠতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এই সুযোগটা নিশ্চিতভাবে দুর্গাপুজো। দুর্গাপুজো হাতে গোনা চারদিনের হলেও, তার আগে-পরে মিলিয়ে টানা দু’মাস বাংলার অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে।  করোনায়-লকডাঊনের বিধিনিষেধে সারা দেশে, পৃথিবীজুড়েই, যে আর্থিক মন্দাবস্থা থিতু হয়েছে, অর্থনীতির পরিভাষায় স্ট্যাগফ্লেশন বা মন্দাস্ফীতি – যার ফলে কাজ হারিয়েছেন দেশের প্রায় তিরিশ কোটি মানুষ, মজুরি কমে গেছে, ক্ষুদ্র থেকে মাঝারি শিল্পের ঝাঁপ বন্ধ হয়েছে, আয় কমেছে, চাহিদা কমেছে, সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অসংগঠিত ক্ষেত্র, গ্রাম-শহরের নিম্নবিত্ত মানুষ, প্রবাসী শ্রমিক .. বাজার ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন ক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় পুরো সরবরাহ শৃঙ্খল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার প্রভাব পড়েছে শহর-গ্রাম উভয় ক্ষেত্রেই। ফলে অর্থনীতি পিছু হটেছে এই বিগত দুই বছরে। খুব স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে সমাজের দুটি অর্থনীতির ছবি। একটি যেখানে বহু মানুষের হাতে পর্যাপ্ত অর্থ রয়েছে (প্রসঙ্গত, করোনাকালেই উপরের দুই শতাংশ মানুশের সম্পদ বেড়েছে, ধনী আরও ধনী হয়েছে)। দ্বিতীয় অর্থনীতি, যেখানে বহু মানুষ কর্মহীন হয়ে হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। সমাজের ওপরে যারা বাস করেন করোনা তাদের উপর অর্থনৈতিকভাবে প্রভাব ফেলতে পারেনি, যত সমস্যা নিম্ন-মধ্যবিত্ত আর আর্থিক দিকে পিছিয়ে থাকা মানুষদের। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে এই উৎসবের অর্থনীতিতে। গতবছর উৎসবের বাজার সংকুচিত হয়েছিল প্রায় ৪৫ শতাংশ। ক্ষতির পরিমান আনুমানিক ৩০ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। বহু বিখ্যাত পূজাকমিটি তার বাজেটের প্রায় ৪০ শতাংশ হ্রাস করেছে। ২০২১-এও তার কিছুটা রেশ থেকে গেছে। যদিও এই বছর সরকারের তরফ থেকে করোনা পরিস্থিতি বহাল থাকলেও এই আর্থিক মন্দা কাটানোর জন্য বিধিনিষেধে ছাড় দেওয়া হয়েছে, অর্থনীতিও তার নিয়মেই খরা কাটিয়ে উঠেছে।

‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ –  ধর্মীয় বহুমাত্রিকতা বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বোঝাতে বহুল চর্চিত শ্লোগান এটা। অথচ ইদানিং উৎসবকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের সাম্প্রদায়িক- জাতিগত বিভাজনের ঘটনা ক্রমশই বেড়ে চলেছে। যেমন বেড়েছে ধর্মীয় উৎসবের আর্থিক পরিসরের পাশাপাশি তার রাজনীতিকরণের প্রচেষ্টা। যেহেতু উৎসব একটি সামাজিক প্রক্রিয়া, বহুদিন থেকেই উৎসবের রাজনৈতিক দখলদারি বৃদ্ধি পেয়েছে .. আর ততই হ্রাস পেয়েছে উৎসবের সর্বজনীনতা, ঐক্য ও সম্প্রীতির পরিবেশ। অবশ্য রাজনীতি আর বিভাজন এখন পরস্পরের পরিপূরক, উভয়েই উভয়ের স্বার্থপূরণ করে। এবং তার পেছনেও একটা বৃহৎ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক লক্ষ্য কাজ করে থাকে, যা আসলে ধান্দা-পুঁজির স্বার্থসিদ্ধি করে। সাম্প্রদায়িক প্রতিযোগিতা তৈরী হয় সেই পুঁজির স্বার্থেই। আর এর সাথেই ব্যবস্থার ফাঁক গলে জমে যাওয়া এক বৃহৎ সমান্তরাল অর্থনীতিও (ব্ল্যাক ইকোনমি) যুক্ত হয়ে পড়ে উৎসবের স্রোতে। স্বাভাবিকভাবেই সমাজ এবং অর্থনীতির অন্তর্নিহিত বহুমাত্রিক বৈষম্যগুলি তাহাদের অবয়বে ও মেজাজে প্রতিফলিত হচ্ছে। বিভিন্ন সর্বজনীন উৎসবের উপর স্থানীয় কিছু মানুষ প্রভাব প্রতিপত্তি বিস্তার করেছে, ক্রমশ তার সঙ্গে রাজনীতির দাপট এবং আর্থিক শক্তি একসঙ্গে ক্ষমতার নতুন সমীকরণ তৈরী করেছে। সর্বজন-এর ভূমিকা বার্ষিক চাঁদা দেওয়ার অত্যাচারে পরিণত হইয়াছে— স্থানীয় আধিপত্যের অত্যাচার। 

তবুও হাজার সীমাবদ্ধতা আর বিপদ সত্ত্বেও দুর্গাপূজা বাঙালির জীবনে অঙ্গীভূত হয়ে গেছে অনেক আগেই। কিন্তু যেখানে বাঙালিই পাল্টে গেছে গ্লোবালাইজেশন নামক এক অলীক জাদুমায়ায় পা মেলাতে সেখানে, তার জীবনের অঙ্গ দুর্গোৎসব পাল্টাবে না, এই ভাবনায় কোনো বাস্তবতা নাই। তাই যেমন যেমন সমাজ পাল্টাচ্ছে, তার উৎসব পাল্টাচ্ছে, তেমন তেমন উৎসবের অর্থনীতিও পাল্টাচ্ছে। ‘এই পুজো আমাদের সকলের’, স্লোগান তুললেও পূজার সর্বজনীনতা কমেছে বই বাড়েনি। উৎসবের অর্থনীতিকে শক্তিশালি করতে হলে উৎসবের সর্বজনীনতা বৃদ্ধি করা ছাড়া অন্য কোনো রাস্তা নাই। অর্থনীতিতে যতই মন্দা আসুক, আজ হোক বা কাল, বাঙালির উৎসবের উদ্দীপনা আর ঐশ্বর্য চিরকালীন হয়েক থাকবে। প্রয়োজনে উৎসবের গতিপথকে বদলে নিয়েও, নতুন রূপে, সর্বজনে’র শক্তি নিয়ে।।

( লেখক একজন সাহিত্যকর্মী। পশ্চিমবঙ্গের মালদার বাঙ্গীটোলা হাই স্কুলের শিক্ষক। )

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!