The Mirrow

স্মৃতিমেদুর পুজো

Share the Article

দেবোপম বিশ্বাস

বাঙালির সম্বৎসরের উৎসব এই দুর্গাপূজা আমাদের প্রত্যেকের মনেই জাগিয়ে তোলে কিছু না কিছু অনুভূতি, রূপে গন্ধে বর্ণে যা অনন্য | তবে নিজের কথা যদি বলি তো স্বীকার করে নিতেই হয় যে এই আনন্দোৎসব আমাকে, এই মাঝবয়সের দোরগোড়ায় পৌঁছে, করে তোলে কেবলই স্মৃতিমেদুর | কোলাহলমুখর জনতার হুল্লোড় থেকে পালিয়ে মন কেবলই পাড়ি দিতে চায় শৈশবে | সেই শৈশবের কথা বলি |

আমার ছেলেবেলা ব্যাপ্ত হয়ে আছে বিগত শতকের সত্তর দশকের শেষ থেকে আশির দশক অব্দি | আর এই সময়টাতে আমার বেড়ে ওঠা বরাক উপত্যকার করিমগঞ্জ শহরে, দাদুর বাড়িতে | যদিও ছবির মতো ছিমছাম ছোট্ট সেই শহরে সর্বজনীন পুজোর আধিক্য ছিল লক্ষণীয় এবং তা নিয়ে আমাদের মতো বালখিল্যদের উন্মাদনার কোনো শেষ ছিল না, তবু মনের কোণে এক বিশেষ আগ্রহ ছিল ওখানকার রামকৃষ্ণ মিশনের পুজো নিয়ে | আর সে বিষয়ে আমার উৎসাহ আর আনন্দ ছিল সহপাঠীদের থেকে কিছুটা বেশি, কারণ রোজই আমার অবসর সময়ের অনেকটা কাটত ওই প্রতিষ্ঠানে | এর কারণ ছিল দ্বিবিধ | প্রথমত দাদু ছিলেন ওখানকার ভারপ্রাপ্ত চিকিৎসক আর দ্বিতীয়ত সেটি ছিল আমাদের বাড়ির একেবারেই কাছে | কাজেই ওখানে যখন তখন যাতায়াতে আমার ছিল অবারিত দ্বার |

তা পুজোর অনেক আগে, অর্থাৎ আষাঢ়-শ্রাবণ মাস থেকেই মিশনে শুরু হত প্রতিমা গড়ার কাজ | কারা গড়তেন সেই প্রতিমা এখন আর মনে নেই, কিন্তু বেশ মনে আছে খড়ের কাঠামো তৈরি করে তার ওপর এঁটেল মাটি চাপিয়ে কী করে ধাপে ধাপে ফুটিয়ে তোলা হত মায়ের মৃন্ময়ী রূপ | মনে থাকবে নাই বা কেন, আমি যে তখন ছিলাম ওই বিশাল কর্মযজ্ঞের একনিষ্ঠ দর্শক | আর ওই শিল্পীদের মধ্যে কেউ যদি দৈবাৎ বলতেন সামান্য কিছু একটা কাজ করে দিতে, মনে হত জীবন যেন বা সার্থক হল | রাত্রে আধো ঘুমে মনে পড়ত ওই তো সিংহের কেশর লাগানো হল, ওই তো অসুরের গোঁফটা ঠিকভাবে মুচড়ে দেওয়া হল | আর দুঃখও হত এই ভেবে যে এবার গণেশের ইঁদুরটা বেশ ছোট হল, গত বছরেরটা কিন্তু বেশ হৃষ্টপুষ্ট ছিল | কেন কে জানে, ওই বয়সে মা দুর্গা ও তাঁর পুত্রকন্যাদের থেকে আমার বেশি আগ্রহ ছিল তাঁদের বাহনগুলোকে নিয়ে, আর সেই সঙ্গে একমেবাদ্বিতীয়ম অসুর মহাশয় তো ছিলেনই আগ্রহের মধ্যমণি হয়ে | সে যাই হোক, শেষ পর্যন্ত যখন দেখতাম মা দুর্গা ঠিকভাবে অসুরনিধন করছেন আর লক্ষ্মী সরস্বতী কার্তিক গণেশ-রাও ঠিকঠাক দাঁড়িয়েছেন স্ব স্ব বাহন নিয়ে, তখন মন খুশিতে নেচে উঠত আর সব উৎকণ্ঠারও হত অবসান |

অন্যদিকে পুজো উপলক্ষে তখনকার মিশনে আরম্ভ হত অন্য এক প্রস্তুতিও| আমাদের মতো কচিকাঁচাদের জড়ো করে মহড়া দেওয়া হত নানা আগমনী গান ও ভক্তিগীতির | বেশ মনে পড়ে, আমাদের যিনি গান শেখাতেন দিদিমণিকে | ছোটখাটো চেহারা, তেলোচুলে আঁট করে বাঁধা বিনুনি, কালো মোটা ফ্রেমের চশমা পরা দিদিমণি মিশনের লাইব্রেরির মাদুর-পাতা হলঘরে বসে গান শেখাচ্ছেন আমাদের | দিদিমণির উচ্চকিত কণ্ঠের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারতাম না আমরা হলভর্তি শিক্ষার্থীর দল | তাও তিনি শেখাতেন অতি যত্ন নিয়ে | আমাদের মতো সুর-কানা গাইয়েদের গলায় সুর ঢেলে দেবার ব্রত নিয়েছিলেন যেন তিনি, তাই তাঁরই আগ্রহে শেখা হল অনেকগুলো গান | যেমন, আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে, ডুব ডুব ডুব রূপসাগরে, আমরা যে শিশু অতি, মন চল নিজ নিকেতনে, একবার বিরাজ গো মা, মন রে কৃষি কাজ জান না, গিরি গণেশ আমার শুভকারী, কেমন করে হরের ঘরে, আজি শঙ্খে শঙ্খে, ইত্যাদি এবং তৎসঙ্গে গা তোল গা তোল বাঁধ মা কুন্তল গানটি | মনে আছে এই শেষোক্ত গানটি বেশ কৌতূহল উদ্রেক করেছিল আমার মনে, বুঝতে না পারার দরুন | তাই ঘরে ফিরে দিদাকে শুধিয়েছিলাম এর অর্থ, আর তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন এই আগমনী সংগীত | অবশ্য আরো অনেক গানের অর্থও তিনি বুঝিয়েছেন প্রাঞ্জল করে, সে কথা আজ বলতেই হয় শ্রদ্ধায় আনত হয়ে | তা ছেলেবেলার সেই সংগীতের পাঠ এতটাই গভীর প্রভাব ফেলেছিল আমার মনে যে এখন এই বয়সে পৌঁছে হেঁড়ে গলায়ও দেখি দিব্বি গেয়ে ফেলতে পারি সেই সব গানের দু’কলি, সঠিক সুরে আর তালে |     

পুজোর দিনগুলো আমার মূলত কাটত মিশনে, মাঝে মাঝে হয়তো বড়দের হাত ধরে যাওয়া হত এদিক ওদিক, শহরের পুজো দেখতে | তবে সেটা বড় কিছু নয়, তাই মিশনের পুজোতেই ফিরি | পুজোর দিনগুলোতে ওখানে মানুষের ভিড় উপচে পড়ত | সারাদিন পুজো ও প্রসাদ বিতরণের পর সন্ধ্যায় প্রথমে হত মা দুর্গার আরতি, এর পাশাপাশি ওখানকার আবাসিক ছাত্ররা করত ঠাকুর ও শ্রীমার সন্ধ্যার্চনা কোনো মহারাজের তত্ত্বাবধানে | এরপর শুরু হত আমাদের ক্ষুদে বাহিনীর সংগীতের মাধ্যমে ভক্তি নিবেদন | এই ‘ভক্তি নিবেদন’ কথাটি বারবার ব্যবহার করতেন আমাদের গানের দিদিমণি, সম্ভবত আমাদের একাগ্র করে তুলবার জন্য | আমরা যে যতটুকু পারি গলা ছেড়ে গাইতাম সদ্য-শেখা ভক্তি বন্দনা, তা কেমন শোনাবে বাইরের লোকের কাছে তার বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে | মা দুর্গা কী ভাবতেন জানি না, তবে সেসব ভেবে আজকে একটু হলেও সংকুচিত হই বৈকি | এরপর শুরু হত মিশনের সংগীতজ্ঞ মহারাজদের সুললিত কণ্ঠের মাতৃবন্দনা | বড়দের সঙ্গে বসে বসে মুগ্ধ হয়ে শুনতাম অপূর্ব সেইসব গান, বোঝা না-বোঝার সীমানা পেরিয়ে হারিয়ে যেতাম সুরের জগতে | সে বয়সে পুজোর ব্যাপারটা হয়তো অত বুঝতাম না, কিন্তু সেই প্রতিমা, আরতি আর সন্ধ্যাসংগীতের আকর্ষণ ছিল বড় প্রবল | আর এর পাশাপাশি মিশনের পুজোর আরেকটি আকর্ষণ ছিল দুপুরে খিচুড়ি প্রসাদ খাওয়া | আহা ! সে যে কী অমৃত, বলে বোঝানো মুশকিল | দুপুরের রোদে সারিবেঁধে আগুন-গরম খিচুড়ি আর লাবড়া নেওয়া, আর হাপুস হুপুস করে সেসব সাবাড় করা, আহা, তার মজাই ছিল আলাদা |

এইভাবেই দেখতে দেখতে কেটে যেত পুজোর ক’টা দিন, আনন্দে আর উত্তেজনায় | কিন্তু দশমীতে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে পড়ত | মিশনের প্রতিমা নিরঞ্জনে আমার যাবার অনুমতি ছিল না, সেটা বোধহয় দাদুর কঠিন ব্যক্তিত্বের জন্য | তাই বিজয়ার সকালে মা দুগ্গাকে নমো করে আমায় এক বছরের জন্য সব চাহিদাগুলোকে নিবেদন করতে হত নিজের ভাবে, নিজের ভাষায় | আর এই সব পর্ব পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত এই শিশুমন খুশিতে ভরে উঠত যখন আমাদের বাড়ির সামনে দিয়েই যেত মা দুর্গার বিসর্জনের শোভাযাত্রা | শহরের দেখা আর না-দেখা সব প্রতিমা মিলিয়ে সেই শোভাযাত্রা হয়ে উঠত একটি ছোট ছেলের সামগ্রিক পূজা-বিনোদনের আরেক অনন্য মাধ্যম, মিশনের পূজার সঙ্গে মিলিয়ে এক অনন্য ইচ্ছাপূরণ |

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!