সব্যসাচী রায়
লোকে বলে ছোটবেলা খুব ডানপিটে ছিলাম। হবে হয়তো ! সেই উচ্ছল শৈশবের কীর্তিগাথা গাইবার বয়স এখন হয়নি যে তা বুঝি, বয়স এখনও যে মাত্র দুই কুড়ি পেরিয়ে কয়েক বছর। সে নাহয় আরও কিছুকাল পর স্মৃতিরোমন্থন করা যাবে। কিন্তু, শরতের এই উৎসবমুখর মুহূর্তে ছোটবেলার পুজোর দিনগুলোর কথা বারবার আজ মনে পড়ছে।
বয়স তখন কত আর হবে, মেরেকেটে ১২/১৩ বছর। করিমগঞ্জ শহরের শিববাড়ি মন্দিরের ঠিক পেছনের গলিতে নিবাস তখন। তাই স্টেশন রোডের সবগুলো লাইব্রেরি পায়ের নাগালের মধ্যেই ছিল। বিশেষ করে বলতে হয় দিব্যেন্দু ভৌমিকের লাইব্রেরির কথা। ইন্দ্রজাল কমিক্স আর অমর চিত্রকথার কোনও সংখ্যা বাদ পড়ত না। যাকে বলে, প্রাইম সাবস্ক্রাইবার। কিন্তু আকর্ষণে সেইসকল পাক্ষিকগুলোকে ছাপিয়ে যেত আনন্দমেলার পুজোসংখ্যা, শৈশবে দুর্গাপুজোর আমেজ উপভোগের প্রধান উপাদান ছিল যে সেটাই। যেন ছুটির হোমোয়ার্কের বাইরে সে-এক অবশ্যকরণীয় ছুটির সিলেবাস।
পুজোর বহুদিন আগে থেকেই এই আনন্দমেলার পুজোসংখ্যার জন্য টাকা জমানো শুরু হত। বলা বাহুল্য, সেই সঙ্গে দিব্যেন্দুদার লাইব্রেরিতে অগ্রিম বুকিং হয়ে যেত। বই এসেছে কিনা তা জানতে রোজ সেখানে একবার তাগ্দা দেওয়া সেই সময়টাতে রুটিন হয়ে পড়ত। পুজোর দিন পনেরো আগেই হাতে এসে যেত বই। যেদিন পুজোসংখ্যা হাতে আসত সেদিন মনটা ‘সাতওঁয়া আসমানে’ ভাসত।
সংগ্রহের পর একছুটে বইটা নিয়ে বাড়িতে। পুজোসংখ্যার সেই বইয়ের প্রথম আকর্ষণ ছিল গন্ধ। সেই নতুন বইয়ের গন্ধ আজও নিজেকে মাতাল করে। যাইহোক, বইটি খুলে প্রথমে কমিক্সের পালা, সেটা বাধ্যতামূলক ছিল। কোনও বছর অরণ্যদেব, কোনও বছর শার্লক হোম্সের পুরো গল্প থাকত। মিনিট দশেকের মধ্যেই কমিক্সের পুরো এপিসোড শেষ। তারপরের চয়েস্গুলো একে একে পাণ্ডব গোয়েন্দা, কাকাবাবু-সন্তু, সত্যজিৎ রায়ের গল্প ইত্যাদি। পুজোর আগেই সেই আনন্দমেলার সিংহভাগ সাবাড় হয়ে যেত। করতেই হত, পুজোর দিনগুলোতে বন্ধুদের সাথে কাটানোর যে টাইট-প্যাক্ড পরিকল্পনা থাকতই। সেটার সাথেও যে আপস করা যায় না।
কলেজে ওঠার পর পরবর্তীতে আনন্দমেলার সাথে যোগ হয় দেশ, আনন্দবাজার পত্রিকার পুজোসংখ্যা। কিন্তু, আনন্দমেলা বাদ পড়ে নি। শৈশবের পুজোর আমেজের কেন্দ্রবিন্দু যে ‘আনন্দমেলার পুজোসংখ্যা’ সেটাকে কি ছেড়ে দেওয়া যায়, সেই আমেজকে কি ম্লান হতে দেওয়া যায় !
আসলে, বাঙালির অকালবোধনের সঙ্গে শারদ-সাহিত্য সংপৃক্ত হয়ে আছে সেই যুগ-যুগান্তর থেকে, তা সেই ঠাকুর পরিবারের ‘সাধনা’ ও উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুকুমার রায়, সত্যজিৎ রায়ের ‘সন্দেশ’ পত্রিকার পুজোসংখ্যাই হোক, আজকের দিনের আনন্দমেলা, দেশ, আনন্দবাজার পত্রিকা, সানন্দা, নবকল্লোলের পুজোসংখ্যাই হোক বা কোনও পুজো কমিটির ম্যাগাজিনই হোক। বাঙালির সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার এক একান্ত-নিজস্ব অনবদ্য উপাদান এই শারদসংখ্যাগুলো। বাঙালি ছাড়া বোধহয় আর কোনও জাতিরই এই পুজোসংখ্যা বা উৎসব-পত্রিকা নিয়ে এত তৎপরতা বা উৎসাহ নেই। এখানেই বাঙালির সাহিত্য-সংস্কৃতির অনন্যতা অন্তর্নিহিত। সারা বছর যাদের বইয়ের সাথে বিশেষ যোগাযোগ থাকে না, তারাও এই বিশেষ সময়ে একখানা পুজোসংখ্যা বগলদাবা করে নেন। লেখক, পাঠক, সম্পাদক, প্রকাশক এবং সর্বোপরি বিপণন — সব মিলিয়ে এই পুজোসংখ্যাগুলোর সঙ্গে অর্থনীতিরও এক বিরাট সম্পর্ক রয়েছে।
পরিশেষে, এটা আমরা সবাই অনুভব করতে পারি যে বাঙালির শারোদৎসব আজ লোকাচার বা ধর্মীয় রীতি-নীতির বেশ খানিকটা উর্ধে উঠে এক সর্বজনীন রাষ্ট্রীয় মহোৎসবের রূপ নিয়েছে। আর, এই মহোৎসবে এক সুনির্দিষ্ট স্থান দখল করে রয়েছে শারদ-সাহিত্য। এটা বাঙালির লোকায়ত জীবনের ক্ষেত্রে কম শ্লাঘার ব্যাপার নয়!
আহা! আমাদের কৈশোরের দিনগুলোতে নিয়ে গেল লেখাটি। সব্যসাচীর কলম কেমন নস্টালজিক আবেশ তৈরি করেছে। পূজার পর এমনি আরেকটির দাবি রাখছি।
ধন্যবাদ আপনাকে।