The Mirrow

সত্তর, আশি ও নব্বই–এর দশকে বরাক উপত্যকার ছাত্র আন্দোলনের নীরব বহিঃপ্রকাশ // প্রসঙ্গঃ সংস্কৃতি এবং লিট্‌ল ম্যাগাজিন

Share the Article

ড০ স্বরূপা ভট্টাচার্য্য

বরাক উপত্যকার ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, বিভিন্ন সময়ে ছাত্র আন্দোলনের বহিঃপ্রকাশ বিভিন্ন রকম ছিল। কখনো তারা পথে নেমে সক্রিয়ভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। কখনো নিয়েছে রাজনীতির আশ্রয়, কখনো সেই আন্দোলনের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে সাহিত্য- সংস্কৃতির মাধ্যমে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যে সত্তর, আশি ও নব্বই- এর দশকে ছাত্ররা যেমন প্রত্যক্ষভাবে পথে নেমে আন্দোলন করেছে, ঠিক তেমনি সাহিত্য এবং সংস্কৃতির মাধ্যমেও নীরব এবং পরোক্ষভাবে প্রতিবাদের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছে।

সময়কাল- সত্তরের দশকের শেষ থেকে আশির দশকের মধ্যভাগ। সমগ্র ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা তখন জাতিদাঙ্গায় উত্তাল। বিদেশি বিতাড়নের নামে নির্বিচারে বাঙালি নিধনযজ্ঞে উন্মত্ত ‘আসু’ নামক ছাত্র সংগঠন। হিংসাবিদীর্ণ আন্দোলনের জেরে ছাত্ররা সেদিন হারালো তাদের মূল্যবান শিক্ষাবর্ষ। এই পটভূমিতে দাঁড়িয়ে বরাক উপত্যকায় সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য IPTA বা ভারতীয় গণনাট্য সংঘ এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করল। সেই সময় বরাক উপত্যকায় ছাত্রদের মধ্যে বামপন্থী রাজনীতির প্রভাব খুব বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছিল। তারা যেমন সক্রিয়ভাবে বামপন্থী রাজনীতির সাথে যুক্ত হচ্ছিল, ঠিক তেমনি দলে দলে প্রগতিশীল ছাত্র এবং যুব সম্প্রদায় IPTA-এর মাধ্যমে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত হচ্ছিল। ষাটের দশকে ভাষা সংগ্রামের সময় এই IPTA- এর মঞ্চ থেকেই হেমাঙ্গ বিশ্বাস ও ভূপেন হাজরিকা সম্প্রীতির বার্তা ছড়াতে সঙ্গীতের আশ্রয় নিয়েছিলেন। রচিত হয়েছিল ‘হারাধন-রঙমন কথা’, ‘মানুষ মানুষের জন্য’, ‘গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা’- ইত্যাদির মত কালজয়ী গান। ‘জনগণের জন্য শিল্প’ এই আদর্শকে পুঁজি করেই আশির দশকেও IPTA সাংস্কৃতিক মেল বন্ধনের চেষ্টা করে গেছে। সেই চেষ্টার ফলেই আশির দশকে সৃষ্টি হয়েছে দিশারী, সমকাল,শিলচর কালচারেল ইউনিট, দশরূপক, গণসুর, ভাবীকাল- ইত্যাদির মত সাংস্কৃতিক সংগঠন যেখানে ছাত্র-যুব সম্প্রদায়ের যোগদান এবং উদ্যোগ উল্লেযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে ছিল।

১৯৮২- সালে ‘দিশারী’-র মৈত্রী উৎসবে যোগ দিতে কলকাতা থেকে এলেন বেশ ক’জন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। তাঁর মধ্যে উজ্জ্বলতম নক্ষত্রটি ছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। তাঁর উপস্থিতিতে বরাকের সাংস্কৃতিক আন্দোলনে জোয়ার এল। সৃষ্টি হল একের পর এক গণসঙ্গীতের দল। সঙ্গীত, নাটক এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রতিবাদের ভাষাটা ছাত্র-যুব সম্প্রদায়ের মাধ্যমে শহর থেকে গ্রাম- বরাকের প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে গিয়েছিল।

সাহিত্যের ক্ষেত্রেও উপরোক্ত সময়কালে ছাত্র-যুব সম্প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। ১৯৬০/৬১- তে ভাষা নিয়ে উগ্র- জাতীয়তাবাদ, ‘৭২-এর শিক্ষার মাধ্যম বিষয়ক গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্কুলার বা  ’৮৬-র বিতর্কিত ভাষা সার্কুলার (যার ফলশ্রুতিতে ‘৮৬-র ভাষা আন্দোলন)- এর সিদ্ধান্তকে প্রতিরোধ করতে বরাকবাসী বার বার রুখে দাঁড়িয়েছে। বার বার রক্ত ঝরেছে। তা- সত্ত্বেও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বাঙালির প্রাণ বাঁচেনি। বাস্তব অবস্থাকে স্বীকার করে বলতেই হয়, ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালি সেদিন মনের কথা প্রকাশ করতে পারেননি। সাহিত্যের মাধ্যমে প্রতিবাদ- সেটাও সঙ্গে সঙ্গে সম্ভব হয়নি। ষাট এবং সত্তরের দশকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বাংলা ভাষায় কিছু লেখার একমাত্র মাধ্যম ছিল লিট্‌ল ম্যাগাজিন । আশির দশকেও দেখা যাচ্ছে, সেখানের উগ্র- জাতীয়তাবাদী পরিস্থিতি আম-বাঙালিকে আসমিয়া ভাষা চর্চায় বাধ্য করেছে। বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলো ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় প্রায় অবলুপ্তির পথে। কলেজগুলোর বাংলা বিভাগের অবস্থাও খুবই করুণ। বহু বাংলাভাষীর পড়াশোনার মাধ্যম এখন অসমিয়া। কিন্তু একে  একটি জাতিসত্ত্বার বিলুপ্তির চিহ্ন হিসেবে না দেখে বরং বলা যেতে পারে অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম। আর এখান থেকেই রসদ নিয়ে সংবেদনশীল বাঙালি অসমীয়া গল্প- কবিতা ইত্যাদি অনুবাদে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এবং সেগুলো প্রকাশ করেছে বাঙলা লিট্‌ল ম্যাগে। বরাক- ব্রহ্মপুত্র দুই উপত্যকাতেই এসময় লিট্‌ল ম্যাগের জোয়ার দেখা গেছে। আর এভাবেই বাঙালি নিজের অজান্তেই গড়ে তুলেছে ভাষিক প্রতিরোধ। অর্থাৎ গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক, লোকসংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি ইত্যাদি নানাধরনের উপাদান যা কিছুই বিষয়বস্ত থাকুক না কেন- আসল বিষয় হচ্ছে এই সমস্ত কিছুকে মাধ্যম করে বাঙলা ভাষা চর্চা এবং তার মাধ্যমেই ভাষিক প্রতিরোধ আরো মজবুত করে তোলা। অর্থাৎ উগ্র- জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে লিট্‌ল ম্যাগকে হাতিয়ার করেই সে সময় বাঙালি আত্মপরিচয় পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হয়েছে।

যাইহোক, ষাটেক দশক থেকে সত্তরের দশকের দিকে মুখ ফেরালে দেখা যায়, আসামের দুই উপত্যকাতেই এসময় প্রচুর লিট্‌ল ম্যাগ প্রকাশিত হয়েছে। বরাক উপত্যকায় শিলচর, পয়লাপুর, বদরপুর, লালা, আল্‌গাপুর, করিমগঞ্জ, রামকৃষ্ণনগর প্রভৃতি জায়গা থেকে বেশ কিছু লিট্‌ল ম্যাগ প্রকাশিত হয়েছে। সেই পত্রিকা প্রকাশনের পেছনে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছে ছাত্র-যুব সম্প্রদায়। সত্তরের দশকের মধ্যভাগে দেশজুড়ে জরুরি অবস্থাজনিত রাজনৈতিক সংকট এবং অস্থিরতার সঙ্গে দোসর ছিল উর্ধগামী কাগজের দাম আর ছাপার খরচ। তবু- ও মূলতঃ বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার সংকট এবং ছাত্র-যুব সম্প্রদায়ের বয়সজনিত প্রবল উৎসাহ এবং আবেগের কাছে পত্রিকা প্রকাশনার বিভিন্ন বাধা হার মেনেছে।

সত্তরের দশকে বরাক উপত্যকায় প্রকাশিত লিট্‌ল ম্যাগের মধ্যে ‘শতক্রতু’ (১৯৭৩) প্রথম উল্লেখযোগ্য নাম। এই পত্রিকাটিকে বরাক উপত্যকার বাঙলা কথাসাহিত্যের জগতে ‘Landmark’ বলা যেতে পারে। বরাক উপত্যকার বাংলা গল্পের নতুন শৈলী বা আঙ্গিকের বিভিন্নরকম পরীক্ষা নিরীক্ষার অঙ্কুরোদ্গম হয়েছিল ষাটের দশকের শেষভাগে ‘অনিশ’ পত্রিকার  মাধ্যমে (সম্পাদক-শ্যামলেন্দু চক্রবর্ত্তী) যার পূর্ণ প্রকাশ হয়েছিল ‘শতক্রতু’-তে। বলাবাহুল্য তরুণ সম্পাদকদ্বয় ভাস্করানন্দ শর্মা আর মিথিলেশ ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে একঝাঁক তরুণ ছাত্র এই যজ্ঞে সামিল হয়েছিল। ‘শতক্রতু’ ছাড়া- ও সত্তরের দশকে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পত্রিকা ছিল গণেশ দে সম্পাদিত ‘বজ্র’ (১৯৭১), কামালুদ্দিন আহমদ সম্পাদিত ‘দিগ্‌বলয়’ (১৯৭৪), বিশ্বজিৎ দত্ত আর বিশ্বজিৎ চৌধুরীর যুগ্মভাবে সম্পাদিত ‘মাটির কাছাকাছি (১৯৭৬), সঞ্জীব দাস আর দিগ্বিজয় পালের যুগ্মভাবে সম্পাদিত ‘আমাদের সমকাল’ (১৯৭৮) , প্রমুখ। প্রত্যেকটি প্রকাশনার মধ্যে রয়েছে ছাত্র-যুব সম্প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য অবদান।

সত্তরের দশকের শেষে এবং আশির দশকে বরাক উপত্যকা থেকে মনে রাখার মত কিছু পত্রিকা বার হয়েছে। তার মধ্য সম্পূর্ণ ছাত্রগোষ্ঠীর দ্বারা প্রকাশিত কয়েকটি পত্রিকা হচ্ছে বদরপুরের ঝিনুক নাট্যগোষ্ঠীর মুখপত্র ‘চিন্তা (১৯৭৯), করিমগঞ্জ থেকে ‘বিজ্ঞান তরঙ্গ’ (১৯৮০) এবং ‘তৃতীয় কণ্ঠ’ (১৯৮৪) , উধারবন্দ থেকে ‘মাটি’ (১৯৮১) এবং ‘অর্ধেক আকাশ’ (১৯৮৯), শিলচর থেকে ‘প্রতিস্রোত’ (১৯৮৪), দেওয়ান চা- বাগান থেকে ‘স্রোতস্বিনী’ (১৯৮৪), ইত্যাদি। কলেজে পড়ছে বা সদ্য কলেজ উত্তীর্ণ কিছু ছেলে-মেয়ের উদ্যোগে এই ছোট পত্রিকাগুলো প্রকাশিত। ‘তৃতীয় কণ্ঠে’র (সম্পাদক-সাবর্ণি পুরকায়স্থ) উদ্দেশ্য প্রথমতঃ মানুষকে যুক্তিবাদী চিন্তা-ভাবনার দিকে আকৃষ্ট করা এবং দ্বিতীয়তঃ সৎ এবং সুস্থ চিন্তার প্রতি আগ্রহ বাড়ানো। তাদের লেখার বিষয়বস্তু মূলতঃ শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সমাজ সম্পর্কিত। একই সঙ্গে শুদ্ধ এবং ভালো গদ্যচর্চার মাধ্যমে তাদের বক্তব্য স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করা। ‘বিজ্ঞান তরঙ্গ’র (সম্পাদক –অনুপম চক্রবর্ত্তী, পার্থপ্রতিম সেন এবং আরো অনেক) মূল উদ্দেশ্য বিজ্ঞান চেতনা প্রসার ও যুক্তিবাদী চেতনায় মাধ্যমে সমাজ ব্যবস্থার উত্তরণ। বলাবাহুল্য, বিজ্ঞান চেতনা প্রসারের উদ্দেশ্যে ‘বিজ্ঞান তরঙ্গ’ই আসামের প্রথম বাংলা ছোট পত্রিকা। ‘চিন্তা’ পত্রিকা বদরপুরের ‘ঝিনুক নাট্য গোষ্ঠী’-র মুখপত্র। বছরে একবার নাট্যোৎসব করার সময় পত্রিকাটি প্রকাশ করা হত। বলা বাহুল্য, এই নাট্যগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বামপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসী প্রগতিশীল কিছু তরুণ ছাত্র যেমন পার্থপ্রতিম মৈত্র, কমল চক্রবর্ত্তী, বিশ্বরূপ ভট্টাচার্য্য, তীর্থঙ্কর চন্দ, শুভঙ্কর চন্দ প্রমুখ। এদের মধ্যে কয়েকজনের আবার নকশাল প্রেক্ষিত ও ছিলো। স্বভাবতই ‘চিন্তা’ পত্রিকাতে-ও সেই প্রগতিশীল ভাবনাসমৃদ্ধ লেখাই শুধুমাত্র প্রকাশিত হত। এখানে উল্লেখ্য যে, তাদের নাট্যোৎসবে সমকালীন রাজনৈতিক ভাবনা-সমৃদ্ধ নাটকই করা হত। উপযুক্ত নাটক না পেলে এই ছাত্রগোষ্ঠী নিজেরাই রাজনৈতিক নাটক রচনা করত। আরেকটি ব্যাপার উল্লেখ করা প্রয়োজন যে সেইসব নাটকে একজন পরিচালক না থেকে পরিচালকমণ্ডলী থাকতেন এবং পাত্র-পাত্রীর ভূমিকায় সমাজের সকল শ্রেণির মানুষ এমনকি, ‘হরিজন কলোনী’-র বাসিন্দারা ও অভিনয় করতেন। এ-সবই ছিল প্রগতিশীল চিন্তা- ভাবনার প্রতিফলন। আশির দশকের গোড়ার দিকে আসুর বিদেশী বিতাড়নের উন্মত্ততা, নির্বিচারে বাঙালি-নিপীড়ন, ১৯৮২/৮৩ সালে নেলী-গহপুরের অমানুষিক গণহত্যা ছিল ইতিহাসের এক কলঙ্কময় অধ্যায়। এর প্রতিবাদে প্রকাশিত হল ‘চিন্তা’র একটি বিশেষ সংখ্যা ‘Date line Assam 1983’। প্রতিবাদের এই ভাষাকে মানুষের আরো পৌঁছে দেওয়ার জন্য আর নেলী, গহপুরের সর্বস্ব হারানো অসহায় অনাথ মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানোর জন্য পার্থপ্রতিম, শুভঙ্কর-এরা ‘চিন্তা’র এই বিশেষ সংখ্যাটি নিয়ে শিলচর-করিমগঞ্জ রুটের ট্রেনে রীতিমত হকারীও করেছেন।

১৯৮১ সালে শুভঙ্কর চন্দ উধারবন্দ থেকে বের করলেন ‘মাটি’ পত্রিকা। এই পত্রিকার মধ্যেও প্রগতিশীল চিন্তার প্রতিফলন দেখা গেছিল। নাটক এবং ভাষা-সংস্কৃতি সংক্রান্ত সমকালীন রাজনীতি-ই ছিল ‘মাটি’র মূল উপজীব্য বিষয়। ১৯৮৪ –তে দেওয়ানবাগান থেকে সুব্রত মজুমদার নামে আরেকজন প্রগতিশীল ছাত্র বের করলেন ‘স্রোতস্বিনী’ পত্রিকা। চা-বাগানের শ্রমিকদের জীবন-যুদ্ধ, লোক সংস্কৃতি আর সমকালীন প্রগতিশীল রাজনীতির প্রতিফলন ঘটেছিল এই পত্রিকাটিতে- ও। ১৯৮৯ সালে উধারবন্দ থেকে বিজয়া কর বার করলেন ‘অর্ধেক আকাশ’। মূলতঃ নারীমুক্তি আন্দোলন ও সংগ্রামের চালচিত্র- ই ছিল এই পত্রিকাটির মূল বিষয়বস্তু।

১৯৮৪ সালের অক্টোবর। প্রকাশিত হল ‘প্রতিস্রোত’ নামক ছোট পত্রিকা। প্রকাশ স্থান শিলচর। নাম থেকেই পরিস্কার, এই পত্রিকাটির গতি স্রোত অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক ‘system’- এর বিপরীত দিকে। আদ্যন্ত প্রগতিশীল গুটি কয়েক ছাত্রদের দ্বারা প্রকাশিত এই পত্রিকাটির বিশেষত্ব-ই ছিল যে কোনো সামাজিক বিষয় এবং সাহিত্যকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা। প্রথম সংখ্যায় প্রধান সম্পাদক পার্থপ্রতিম মৈত্র সহ এগারোজনের সম্পাদক মণ্ডলী- পার্থসারথী গুপ্ত, সৌমিত্র বৈশ্য, প্রদীপ পাল, পরম ভট্টাচার্য, সুজিত দাস, ভাস্করজ্যোতি দেব, তুষার পুরকায়স্থ, প্রিয়তোষ রায় চৌধুরী, শান্তনু ভট্টাচার্য্য এবং রাহুল দাশগুপ্ত। পত্রিকাটিকে সেইসময় চিন্তা-ভাবনা ও ভাষার ক্ষেত্রে এক আন্দোলন বলা চলে। কারণ প্রথম সংখ্যাতে-ই সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছিল –  “বিষয়বস্তু বর্জিত সাহিত্য হয় না। রাজনীতি বর্জিত বিষয় হয় না। সুতরাং রাজনীতি বর্জিত সাহিত্য অসম্ভব”। অধ্যাপক সুজিত চৌধুরী এই পত্রিকাটির প্রসঙ্গে লিখছেন –  “যে রাজনীতি শিলচর শহরকে প্রায়শঃই নরকের অন্ধকারে ডুবিয়ে দেয়, তাকে তারা প্রকাশ্যে আঘাত করেছেন।” অর্থাৎ প্রথম থেকেই ‘প্রতিস্রোত’ এর প্রতিবাদী, নির্ভীক ও আপোষহীন চরিত্র বরাকের ছাত্র-আন্দোলনের এক শক্তিশালী বৈশিষ্ট্য । এছাড়া তার অন্যান্য বৈশিষ্ট্য হলো (১) আবেগিক গল্প বা কাহিনীবর্জিত লেখা, (২) সততা এবং প্রামাণ্যতা (৩) কোনো অবস্থাতেই প্রগতিশীল বামপন্থী ভাবাদর্শের সাথে আপোষ না করা এবং (৪) সমসাময়িক কালের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সমীক্ষাভিত্তিক রচনা প্রকাশ করা। উদাহরণস্বরূপ ১৯৮৫/৮৬র বন্যা, ফাটকবাজারের প্রলয়ঙ্করী আগুন, প্রাথমিক শিক্ষার দূরবস্থা, শিলচরের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জীবন সংগ্রাম, ইটভাট্টার প্রণালী ইত্যাদি। উল্লেখ্য যে, প্রতিবাদী চরিত্রের জন্য প্রতিস্রোতগোষ্ঠীকে বিভিন্ন সময়ে নিগ্রহের শিকারও হতে হয়েছে।

এখানে উল্লেখ যেতে পারে যে প্রতিস্রোত, তৃতীয় কণ্ঠ, আমাদের সমকাল ও বিজ্ঞান তরঙ্গ’র মধ্যে একটা সাদৃশ্য ছিল। সেটা হচ্ছে – প্রগতিশীলতা এবং প্রতিবাদী চেতনা। এই সাদৃশ্য উপরোক্ত গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছিল। তারা অনুভব করেছিল, কাজ চালিয়ে যেতে হলে নিজেদের মধ্যে সমন্বয় রক্ষার প্রয়োজন। সেই তাগিদ ১৯৮৫ সালে সৃষ্টি হয় ‘বরাক উপত্যকা লিট্‌ল্‌ ম্যাগাজিন সমন্বয় সমিতি।’ এর উদ্দেশ্য ছিল একে অপরকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করা যাতে প্রতিটি পত্রিকাই বেঁচে থাকতে পারে। উল্লেখ্য যে এই সমন্বয় সমিতির ব্যানারেই সম্পাদক নিরঞ্জন রায়চৌধুরীর উদ্যোগে ১৯৮৫ সালে শিলচরে প্রথম (সম্ভবত আসামেও প্রথম) ২১ শে ফেব্রুয়ারি ভাষা শহিদ দিবস পালিত হয়।

একই ভাবে নব্বই এর দশকেও কিছু নতুন লিট্‌ল ম্যাগাজিনের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। আবার কিছু পুরনো পত্রিকা কালের নিয়মে হারিয়েও গেছিল। উল্লেখযোগ্য পত্রিকার মধ্যে রয়েছে করিমগঞ্জ থেকে প্রকাশিত ‘অক্ষর’ (সুব্রত কুমার রায়,১৯৯০),  ‘অক্ষরবৃত্ত’ (কপিশকান্তি দে, ১৯৯১), ‘খ’ (যমুনা চৌধুরী, আলেখ্য ভট্টাচার্য ও পরবর্তীতে শিলচর থেকে দীপঙ্কর চন্দ, ১৯৯১), শিলচর থেকে প্রকাশিত ‘সমাহার’ (দীপালী দত্তচৌধুরী, ১৯৯১), ‘গণ আরশি’ (মহুয়া চৌধুরী, ১৯৯২), জয়পুর- রাজাবাজার-কনকপুর থেকে প্রকাশিত ‘চৈতক’ (সুশান্ত অধিকারী, ১৯৯২), করিমগঞ্জ থেকে প্রকাশিত ‘লালন’ পরবর্তীতে ‘লালনমঞ্চ’ (দিলীপকান্তি লস্কর ও সুব্রত কুমার রায়, ১৯৯৪) প্রমুখ। প্রতিটি প্রকাশনার ক্ষেত্রেই ছাত্র- যুবসমাজের উল্লেযোগ্য ভূমিকা ছিল।

গবেষণায় দেখা গেছে যে, লিট্‌ল ম্যাগের জন্মের প্রেক্ষিতে রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক বিরোধীতা বা anti-establishment thinking। প্রচলিত system-এর বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে লড়াই করতে না পারলেও মানুষ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করেছেন। হাতিয়ার হয়েছে লিট্‌ল ম্যাগ। এছাড়াও রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে লড়াই, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই, মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই, আদর্শ এবং পাল্টা আদর্শের সংঘাত এসমস্তই লিট্‌ল ম্যাগের জন্মের পেছনে প্রেক্ষিত হিসেবে কাজ করেছে। আর এগুলোকে মাধ্যম করে সাহিত্যচর্চার সাথে সাথে বরাক ও ব্রহ্মপুত্রের বাঙালি নিজের অজান্তেই ভাষিক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। সেখানে সর্বতোভাবে ছাত্র-যুব সম্প্রদায়ের যোগদান ছাত্র আন্দোলনের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বলে বিবেচিত হতে পারে।

প্রসঙ্গত, আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। সার্বিকভাবে লিট্‌ল ম্যাগাজিনের এই প্রতিবাদী চরিত্রের পেছনে অনেক ঘটনার প্রভাব রয়েছে। ষাট, সত্তর ও আশির দশকে বরাকের সম্ভবতঃ সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল ভাষিক আগ্রাসন থেকে নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতির মর্যাদা রক্ষা। এর সঙ্গে লড়াই করতে করতে বাঙালি মুখোমুখি হয়েছে নানা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যার। একদিকে দেশের আভ্যন্তরীণ নানা ঘটনা তাদের আন্দোলিত করেছে যেমন পশ্চিমবঙ্গের নকশাল আন্দোলন ও তার দমন, গণনাট্য আন্দোলনের প্রসার, ইন্দিরা গান্ধীর গরিবী হঠাও আন্দোলন, বিনোবা ভাবের ভূ-দান আন্দোলন, দেশজুড়ে জরুরী অবস্থা, পরবর্তীতে বহুদলীয় শাসন ব্যবস্থা, খালিস্তানী আন্দোলন, ইন্দিরা হত্যা, শিখ সন্ত্রাস, রাজীব হত্যা, খোলা বাজারের সূচনা, সামরিক ও মহাকাশ গবেষণায় সাফল্য, সঞ্চার ব্যবস্থার দ্রুত পরিবর্তন; অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভিয়েতনাম ও মধ্যপ্রাচ্যের সংকট, কিউবার মিসাইল ক্রাইসিস, চীন- ভারত যুদ্ধ, ভারত-পাক যুদ্ধ, শীতল যুদ্ধের অবসান, সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ার পতন, দুই জার্মানীর একত্রীকরণ- এই সমস্তকিছুর- ও  প্রচ্ছন্ন প্রভাব রয়েছে লিট্‌ল ম্যাগাজিনের প্রকাশের পেছনে। আর এভাবেই ছাত্র আন্দোলনের নীরব বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে লিট্‌ল ম্যাগাজিনের মাধ্যমে।

তথ্যসূত্র

১। অনুরূপা বিশ্বাসঃ “উজান গাঙের মাঝি”, স্মরণিকা, ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ, শিলচর শাখা, ২০১২।

২। শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদারঃ “সুরমা থেকে ভোল্‌গা”, স্মরণিকা, ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ, শিলচর শাখা, ২০১২।

৩। জ্যোতির্ময় সেনগুপ্তঃ “অসমের বাংলা লিট্‌ল ম্যাগাজিনঃ ছোটগল্প চর্চায় প্রেক্ষাপট ও ক্রমবিকাশ”, বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, কোলকাতা, ২০১২

৪। তুষারকান্তি নাথঃ “গ্রাম-কাছাড়ের সাহিত্য-পত্রিকাঃ একটি অবলোকন”, ‘উন্মেষ’, গুরুচরণ কলেজের বাংলা বিভাগের বার্ষিক বিভাগীয় পত্রিকা, দ্বাদশ এবং ত্রয়োদশ যুগ্ম সংখ্যা, ২০১৩-১৪ এবং ২০১৪-১৫

৫। বিশ্বতোষ চৌধুরীঃ “বরাক উপত্যকার বাংলা কথাসাহিত্যঃ একটি সমীক্ষা”, প্রবাহ’, ৮ম বর্ষ, ইস্যু-২, ১৯৯৪

৬। সুজিত চৌধুরীঃ “ওরে নবীন”, “সময়ের পদাবলী”, যুগশক্তি প্রকাশন, করিমগঞ্জ, ২০০৬

৭। বিভিন্ন সময়ের সাংস্কৃতিক এবং লিট্‌ল ম্যাগ আন্দোলনের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাৎকার। এই ব্যক্তিরা – কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য, সৌমিত্র শংকর চৌধুরী, শেখর দেবরায়, পার্থপ্রতিম মৈত্র, শুভঙ্কর চন্দ, পরম ভট্টাচার্য, সুজিত দাশ, রাহুল দাশগুপ্ত এবং অনুপম চক্রবর্তী । সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা ।

3 thoughts on “সত্তর, আশি ও নব্বই–এর দশকে বরাক উপত্যকার ছাত্র আন্দোলনের নীরব বহিঃপ্রকাশ // প্রসঙ্গঃ সংস্কৃতি এবং লিট্‌ল ম্যাগাজিন”

  1. বরাকের সংস্কৃতিক ও ছাত্র আন্দোলনের এক মূল্যবান ও প্রামান্য দলিল এই রচনাটি। উগ্র অসমীয়া জাতীয়তাবাদ আসাম চুক্তি ইত্যাদির বিরুদ্ধে বামপন্থী আন্দোলন সত্যি সক্রিয় ছিলো সেই সময় এবং সেই আশীর দশকেই “তৃতীয় কণ্ঠ” “প্রতিস্রোত” বিজ্ঞান তরঙ্গের মত প্রগতিশীল ম্যাগাজিনগুলির আত্মপ্রকাশ ঘটেছিলো। স্বরূপা ম্যাডামের এই রচনায় রয়েছে সততার এক স্পর্শ, এই লেখার একটা লাইনও সত্যের কোন অপলাপ নয়, একদম স্বচ্ছ এক ইতিহাস ফুটে উঠেছে ম্যাডামের কলমের স্পর্শে।
    লেখাটির প্রকাশনার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই অধ্যাপক ড সব্যসাচী রায় স্যারকে
    ম্যাডামের প্রতি অসংখ্য ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা সহ
    সঞ্জয় কুমার

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!