The Mirrow

জাতির ‘রক্তমাংসের জনক’ গান্ধী

Share the Article

রাহুল রায়

আজ মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিন। মহাত্মা গান্ধীর কথা বললেই যে পরিচয় আমাদের মননে সর্বাগ্রে আসে তা হল দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সেনাপতি, স্বপ্নদর্শী এক ঋষিসদৃশ মানুষ। তাঁকে সত্যি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের মুকুটহীন সেনাপতি বলা যায় কি? আবেগের বশে তাঁকে সেই আখ্যান দিতে অনেকেরই আপত্তি হবে না। কিন্তু ইতিহাস সেই শিরোপা দিতে অতিমাত্রায় গররাজি। স্বাধীনতা প্রাপ্তির আড়াই দশক আগে থেকেই তিনি কংগ্রেসের কার্যকরী সমিতি থেকে নিজেকে আলাদা করে নিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ সময়ে তিনি নিষ্ক্রিয় নতুবা কারাবন্দি ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে শুরু হওয়া ভারত ছাড়ো আন্দোলন একটা সময়ে কার্যত পরিকল্পনাবিহীন গণআন্দোলনে পরিণত হয়ে আপনা থেকেই স্তিমিত হয়ে যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী থাকা ক্লিমেণ্ট এটলিকে পরবর্তীতে যখন মহাত্মী গান্ধীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করা হয় তখন তাঁর নিরুদ্বেগ কণ্ঠের উত্তর আমাদের কাছে একটা কথা পরিষ্কার করে দেয় যে ব্রিটিশ রাজ তাঁকে প্রধান শক্র বলে ভাবত না। বার বার কারারুদ্ধ হলেও তিনি ব্রিটিশদের থেকে সেই সমীহ আদায় করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। অহিংসার আমৃত্যু পূজারি নিজেও এই দাবি খারিজ করে দিয়ে বলে গেছেন, ভারত যা অর্জন করেছে তা হিংসা এবং অহিংসা উভয় পথের মধ্য দিয়েই পেয়েছে। অর্থাৎ তাঁর পথ বা তিনি, কেউই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে একমাত্র পথ বা কেন্দ্র ছিল না। তাহলে আমরা কি তাঁকে রামমোহন, বিদ্যাসাগরের মতো প্রাতঃস্মরণীয় সমাজ সংস্কারকদের তালিকায় দেখতে পারি?

তাঁর অবদানকে মাথা নিচু করে মেনে নিলেও বলতে হয় ইতিহাস এখানেও আপত্তি জানাচ্ছে। ভারত আজও অস্পৃশ্যতার অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারেনি। বিহার, উত্তরপ্রদেশ সহ মধ্য ভারত, গুজরাটে আজও জাতপাতের নামে কত প্রাণ যে অকালে ঝরে যায় তার কোনো ইতি ইয়ত্তা নেই। স্বচ্ছ ভারত অভিযানে সরকার তাঁর চশমা লাগিয়ে প্রচার চালাচ্ছে। শত সহস্র কোটি টাকার প্রচার চালিয়ে সরকার তাঁর রাজনৈতিক অভিসন্ধি পূরণ করে নিচ্ছে কিন্তু পাশাপাশি এটাও প্রমাণ হচ্ছে যে গান্ধীর প্রদর্শিত স্বচ্ছতার পথ এই দেশের মানুষ নেয় নি। যদি নিত তাহলে সহস্রাধিক কোটি টাকা খরচ করে তাঁর ছবি লাগিয়ে দেশ স্বচ্ছ রাখার প্রকল্প হাতে নিতে হত না।

তিনি স্বত্তগুণ বিশিষ্ট কোনো দেবসদৃশ মানুষ ছিলেন না। সাধারণ মানুষের মতো তাঁর মধ্যেও হীনমন্যতা, রাগ, দ্বেষ, দ্বিচারিতা কাজ করত। এই মানবিক বোধগুলো তাঁর মধ্যে ছিল বলেই তিনি চৌরিচৌরার ঘটনার পরিপেক্ষিতে একান্ত নিজের ইচ্ছায় দেশব্যাপী চলা ‘অসহযোগ আন্দোলন’ বন্ধ করে দেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের দধীচি যতীন দাসের জীবনত্যাগে তিনি নিন্দাবাচক শব্দ ব্যবহার থেকে সযত্নে নিজেকে বিরত রাখেন। প্রকাশ্যে সুভাষচন্দ্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। এই তালিকা দীর্ঘায়িত করা কঠিন নয়। কিন্তু যা কঠিন তা হল এই মানুষটিকে ইতিহাসের পাতা থেকে ঝেড়ে ফেলে দেওয়া।

তাঁর পথের অনুসারী না হলেও তাঁকে অস্বীকার করা যায় না। জওহরলাল নেহরু, বল্লভভাই প্যাটেল, আচার্য বিনোবা ভাবের মতো গান্ধীবাদী বা সুভাষ বসুর মতো স্বতন্ত্রধারার মানুষ, কারোর পক্ষেই গান্ধীকে অস্বীকার করা সম্ভব হয় নি। তাঁরা যে বাগানে নিজেদের রঙের ছটা, সৌরভে মোহিত করে রাখতেন সেই বাগান যে এই লোকটির হাতেই গড়ে উঠেছিল। দেবপ্রতিম নয়, একান্ত রক্তমাংসের হৃদয় নিয়ে তিনি দেশের মানুষকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখাতে পেরেছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে নবীন-প্রবীণের দ্বন্দে বাতিলের খাতায় যেতে বসা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে সজীব করে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মঞ্চ করে তুলেছিলেন। একের পর এক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তাঁর মতাদর্শকে কেন্দ্র করেই।

তিনি মানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখতেন, সেই স্বপ্নকে নিয়ে বাঁচতেন, সেই স্বপ্ন তিনি সহস্র মননে সঞ্চার করাতে পারতেন। সেখানে কোনো আপস, কলুষতা, ভণ্ডামি ছিল না। আরও পাঁচজন বাবার মতোই তিনিও জীবনে ভুল করেছেন, ভুল শোধরানোর চেষ্টাও করেছেন, সারাটা জীবন ত্যাগ করেছেন, ভবিষ্যতের জন্য স্বপ্ন দেখেছেন। পরিবারে পিতাকে যেমন অস্বীকার করা যায় না, তাঁকে অস্বীকার করা যায় না। তাই আজও দেশে দলমত নির্বিশেষে সবার কাছেই তিনি পূজিত। দেশের বাইরে আজও দেশের প্রতিছবি হয়ে তিনি স্বীকৃত। 

সময় বদলেছে, দেশ বদলেছে, মতাদর্শ বদলেছে। কিন্তু ভারতদেশের গান্ধীর স্বীকৃতি সেই একই থেকে গেছে। সেখানে কোথাও কোনো দ্বিমত নেই। পিতৃপরিচয়কে তো অস্বীকার করা যায় না। তাই তো অনেক আগেই বিশ্বযুদ্ধের রণাঙ্গন থেকে তাঁর একসময়ের ‘বখাটে’ ও শেষ সময়ের ‘অভিমানী ছেলে’ সুভাষ তাঁকে ‘জাতির জনক’ আখ্যা দিয়ে গেছেন। এদেশে ইতিহাসের পরিপেক্ষিতে মহাত্মা গান্ধীর জন্য এর চেয়ে অভ্রান্ত পরিচয় আর কিছুই বোধহয় হতে পারে না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!