The Mirrow

সর্বোদয় এবং মহাত্মার রাষ্ট্রভাবনা

Share the Article

সব্যসাচী রায়

১৯০৪ সাল, জুন মাসের মাঝামাঝি কোনও এক দিন। কিন্তু আর পাঁচটি দিনের মত সেই দিনটি মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর জন্য সাধারণ ছিল না। গান্ধীজি জোহান্সবার্গ থেকে ডারবানে যাবেন, ট্রানে চেপেছেন। ট্রেন ছাড়বে — ঠিক সেই সময় বন্ধুবর হেনরি পোলক তাঁর হাতে একখানি বই চাপিয়ে দিল, ট্রেনে সময় কাটানোর রসদ। জন রাস্‌কিনের ‘আনটু দ্য লাস্ট (Unto The Last)’। পোলক জানতেন না সেই বইটি গান্ধীজির জীবনকে এক নতুন মোড়ে এনে দাঁড় করিয়ে দেবে।

১৯২০ সালে প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনীর (The Story of My Experiments with Truth) একটি পরিচ্ছদে (The magic spell of a book) গান্ধীজি এই বইটি সম্পর্কে বলেছেন, “যা আমার জীবনে একটি তাত্ক্ষণিক এবং ব্যবহারিক রূপান্তর এনেছিল ……… এই বিখ্যাত বইটিতে আমার কিছু গভীর বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটেছে।”

‘Unto The Last’ গ্রন্থে বর্ণিত রাস্‌কিনের তত্ত্ব থেকে প্রভাবিত হয়েই গান্ধীজি ‘সর্বোদয়’ তত্ত্বের উদ্ভাবন করেছিলেন। গ্রন্থটির সার কথা গান্ধীজি তিনটি সূত্রে আবদ্ধ করেছিলেন — সামগ্রিক কল্যাণেই ব্যক্তির কল্যাণ নিহিত, উকিল ও নাপিতের কাজের মূল্য সমান – সকলেরই জীবিকা-অর্জনের সমান অধিকার রয়েছে, শ্রমিকের জীবনই আদর্শ জীবন। এই বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করেই গান্ধীজি সর্বোদয় সমাজ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন যেখানে কোনা ধনিক শ্রেণির হাতে পুঁজি কেন্দ্রীভূত হবে না, যেখানে ব্যক্তি, গোষ্ঠী কিংবা শ্রেণি নির্বিশেষে সকলের কল্যাণই সাধিত হবে।

গান্ধীজির রাষ্ট্রচিন্তা ও দর্শনের আঙিনায়ও সর্বোদয় বিশেষ স্থান করে নিয়েছিল। তবে সেখানে টলস্টয় এবং ডেভিড থোরো-র চিন্তা-দর্শনের প্রভাব দেখা যায়।  টলস্টয়ের The Kingdom of God is Within You এবং  হেনরি ডেভিড থোরো-র Civil Disobedience গ্রন্থ দু’টি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর মতামত গঠন করেছিলেন। তাঁর আত্মজীবনীতে রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি উল্লেখ করেছেন, রাষ্ট্র হল কেন্দ্রীভূত শক্তি বা হিংসার বহিঃপ্রকাশ। আর তাই, তিনি রাষ্ট্রের কার্যাবলীকে খুবই সীমিত রাখার পক্ষপাতী ছিলেন।

“The State represents violence in a concentrated and organised form. The individual has a soul, but as the State is a soulless machine, it can never be weaned from violence to which it owes its very existence. Hence I prefer the doctrine of trusteeship ….. The fear is always there that the State may use too much violence against those who differ from it. I would be very happy, indeed, if the people concerned behaved as trustees.” (The Mind of Mahatma Gandhi, Encyclopedia of Gandhi’s Thoughts, Compiled & Edited by: R. K. Prabhu & U. R. Rao. https://www.mkgandhi.org/)

গান্ধীজি শ্রেণিবিভাজনমুক্ত অহিংস সমাজ প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতী ছিলেন। যে সমাজ ব্যবস্থায় রাজনৈতিক ক্ষমতা হবে বিকেন্দ্রীভূত এবং স্বনিয়ন্ত্রিত। এই অহিংস গণতান্ত্রিক সমাজই তো গান্ধীজির প্রত্যাশিত ‘রামরাজ্য’। গান্ধীজির স্বরাজের তত্ত্বটিও সেই চিন্তার বেদীমূল থেকেই উদ্ভূত বলে মন্তব্য করা যায়।  তিনি ব্যক্তি স্বাধীনতাকে প্রকৃত গণতন্ত্রের ভিত্তি বলে প্রত্যাশা করেছিলেন এবং তাই রাষ্ট্রহীন গণতন্ত্র গড়ে তোলার কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “In the ideal State, therefore, there is no political power because there is no State. But the ideal is never fully realized in life. Hence the classical statement of Thoreau that Government is best which governs the least.” 

এটা ঠিক, গান্ধীজির সর্বোদয় তত্ত্বে যে আদর্শ ও দর্শনের উল্লেখ রয়েছে আজকের রাষ্ট্রভাবনা সেখান থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। হয়তো বা আমরাই বিগত দিনে তাকে এত দূরে সরিয়ে দিয়েছি যে আজ এর প্রয়োজন অনুভব করলেও সেই গান্ধী-কল্পিত সর্বোদয় ও রামরাজ্যের ভাবনাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভবপর হয়ে উঠবে না। সেজন্য, বহুত্ব থেকে বহুত্ববাদ (Plurality to pluralism) পথে আমরা যে পিছিয়ে যাচ্ছি তা আজকের কঠিন সময়ে আমাদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে মনে করিয়ে দিতে হয়। রাষ্ট্রনেতা নয় ন্যায়াধীশকে আজ বলতে হয় — “Dissent is the safety valve of democracy” বা “A Prophet is without honour in his own country. Substitute ‘Citizen’ for ‘Prophet’ and you will get the gist …”।

কিন্তু, গান্ধীজির সেই ভাবনাগুলো পুরোপুরি মুছে যায়নি। মুছে দেওয়া যায় না। কালের গতিতে হয়তো গান্ধী দর্শনের তাৎপর্য ও গুরুত্ব আমরা সঠিক অনুভব করব, আমাদের নিজেদের টিকে থাকার তাগিদে। সেই শ্রেণিহীন, শোষণহীন সাম্যের ভিত্তিতে রামরাজ্য গঠনে আমরা আবার এগিয়ে যাব।

পরিশেষে, গান্ধীজি সম্পর্কে আইনস্টাইনের একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করছি, ‘হাজার বছর পর মানুষ অবাক হয়ে ভাববে যে এমন একজন মানুষ পৃথিবীর মাটিতে একদিন বিচরণ করেছিলেন।’ সহশ্রাব্দের শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে গান্ধীজিকে তিনি ঠিক চিনতে পেরেছিলেন। আমরা পেরেছি কি?

1 thought on “সর্বোদয় এবং মহাত্মার রাষ্ট্রভাবনা”

  1. Sanjib Deblaskar

    এর চেয়ে সহজ আন্তরিক মূল্যায়ন আর হয় না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!