The Mirrow

জীবন্মৃত বিধবাদের আলোকিত জীবন দিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর

Share the Article

তমোজিৎ সাহা

বাঙালি তথা ভারতবাসীর জীবনে বিদ্যাসাগর এক মেরুদণ্ডের নাম। আজীবন সংগ্রামী, দৃঢ়চেতা, মানবপ্রেমী,  উনিশ শতকের মানবরূপী ঈশ্বর যিনি নিজেই একটা যুগের নাম, এ দেশে এনেছিলেন পার্থিব মানবতার বার্তা। সমস্ত অমানবিক অন্যায়, অশিক্ষা-কুশিক্ষা এবং ধর্মীয় অন্ধতার বিরুদ্ধে সমাজসংস্কার এবং শিক্ষাসংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তিনি স্ত্রীশিক্ষা ও নারীমুক্তির পথ প্রশস্ত করেছিলেন। সেই বিরল একক মেরুদণ্ডবিশিষ্ট মহামানব যুগপুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মের দু’শ বছর ইতিমধ্যে অতিক্রান্ত।

নবজাগরণের পথিকৃৎ বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি হল বিধবা বিবাহ। ১৮৫৬ সালের ১৬ জুলাই বিধবা বিবাহ আইনি স্বীকৃতি লাভ করে। এই মহত্তম কাজ করতে গিয়ে বিদ্যাসাগরকে সেই যুগে যে কী ভীষণ লড়াই করতে হয়েছিল তা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। বর্তমান ভারতবর্ষের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশে দাঁড়িয়ে আমরা কল্পনাও করতে পারব না বিদ্যাসাগর তাঁর জীবন বাজি রেখেও ন্যায়, সত্য, মানবতা এবং নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কী অসম্ভব লড়াইটাই না করেছিলেন! এক্ষেত্রে অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের জন্য তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম এবং ত্যাগের ইতিহাসের কথা। আসলে গোটা উনিশ শতক জুড়েই বাংলার বুকে গড়ে ওঠা সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা এবং ধর্মীয় প্রগতিশীল আন্দোলন বাংলা তথা ভারতবর্ষকে কুসংস্কারের অন্ধকার থেকে মুক্ত করে এক উদার আলোকিত ভুবনের পথ দেখিয়েছিল। রাজা রামমোহন রায়, হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও, অক্ষয়কুমার দত্ত, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভগিনী নিবেদিতা প্রমুখ মনীষী এক মুক্তমনা উদার মানবিক সমাজের জন্য জীবন উৎসর্গ করে গেছেন।

সেকালের হিন্দুসমাজে কুলীনপ্রথার কারণে বহুবিবাহ প্রথা ছিল সমাজস্বীকৃত এক ভয়ঙ্কর অন্যায়। এই কুপ্রথা যুগ যুগ থেকে চলছিল। গোঁড়া  ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের আধিপত্যবাদী পুরুষরা একাধিক তো বটেই, শতাধিক বিবাহও করতেন। তাছাড়া বাল্যবিবাহ ছিল মেয়েদের জীবনের এক কাল-অভিশাপ। মেয়েদের বাল্যবয়সে কুলীন ব্রাহ্মণের সঙ্গে বিবাহের ফলে তাদের জীবনে নেমে আসত অকাল বৈধব্য। কবি ঈশ্বর গুপ্তের কবিতায় আছে —- “শতেক বিধবা হয় একের মরণে।” অর্থাৎ একজন কুলীন বৃদ্ধ মারা গেলে শতাধিক বালিকা-কিশোরী বিধবা হয়ে মৃতের মতো বেঁচে থাকতেন। এইসব বিধবার আশ্রয় হত বাবার বাড়ি অথবা কাশী। যতদিন পর্যন্ত সতীদাহ প্রথার নামে অমানবিক বর্বরোচিত নৃশংস প্রথা চালু ছিল ততদিন  স্ত্রীকে জীবন্ত অবস্হায় স্বামীর সঙ্গে চিতাকাঠে পুড়ে মরতে সমাজ বাধ্য করত। কিন্তু যখন রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা বন্ধের জন্য সামাজিক আন্দোলন ও তর্ক বিতর্ক শুরু করলেন এবং অবশেষে ব্রিটিশের দ্বারা সরকারি আইন প্রণয়ন করে তা বন্ধ করতে সফল হলেন তখন থেকেই বাল্যবিধবা মহিলাদের জীবনযন্ত্রণা দুর্বিষহ আকার ধারণ করল।

সমাজের লাথি-ঝাঁটা খেয়ে জীবন কাটানো জীবন্মৃত এইসব মহিলার হয়ে নতুন লড়াই শুরু করলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। শুরু হল বিধবা বিবাহ আন্দোলন বাস্তববাদী এবং যুক্তিবাদী বিদ্যাসাগর স্হির করলেন হিন্দুশাস্ত্রের মতবাদ দিয়েই সামাজিক এবং ধর্মীয় এই অমানবিক প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করবেন, যুক্তি তুলে ধরবেন।

অবশেষে বিস্তর অনুসন্ধান এবং অধ্যয়নের পর সংস্কৃত সাহিত্য ও হিন্দুশাস্ত্রে পণ্ডিত বিদ্যাসাগর পরাশর সংহিতায় একটি শ্লোক খুঁজে পান, যেখানে বিধবাদের পুনরায় বিবাহের অধিকার দেওয়া হয়েছে। তিনি শাস্ত্র অনুসারে যুক্তি উত্থাপন করে একটি প্রবন্ধ রচনা করেন। ১৮৫৫ সালে ছোট পুস্তিকারূপে প্রবন্ধটি মুদ্রিত হয়। নাম ছিল — ‘বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’।

দেশের মানুষের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা বিশেষত নারীর প্রতি, তাদের দুঃখ দুর্দশার প্রতি আন্তরিক দরদ বিদ্যাসাগরকে সমাজসংস্কারের কঠিন সংগ্রামের পথে নিয়ে গিয়েছিল। অসহায় নারীর দুঃখে তাঁর প্রাণ কাঁদত, চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ত। সেই নারীসমাজের জীবন থেকে কুপ্রথার অন্ধকার দূর করার জন্য তিনিই অত্যন্ত কঠোর মন নিয়ে সাহসের সঙ্গে বিধবা বিবাহ আন্দোলন গড়ে তোলেন। সমাজের রক্তচক্ষু থেকে শুরু করে কোনও বাধা বিপত্তিই তাঁকে এই সংগ্রামের মহৎ পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। বিধবা বিবাহ প্রচলন সংক্রান্ত বিদ্যাসাগরের বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি হল, ভীষণভাবে আঘাত করল প্রগতিবিরোধী গোঁড়া হিন্দুসমাজকে। তারাও নিজেদের আধিপত্য এবং কায়েমি স্বার্থ বজায় রাখার জন্য পাল্টা যুক্তি দিয়ে প্রচার শুরু করল। শোভাবাজারের তখনকার রাজা রাধাকান্ত দেব বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে গোঁড়া হিন্দুসমাজকে নেতৃত্ব দেন। তিনি নিজের বাড়িতে বিদ্যাসাগর ও অন্যান্য পণ্ডিতদের মধ্যে বিধবা বিবাহ নিয়ে দু’টি বিতর্কসভার আয়োজন করেন। রাধাকান্ত সরাসরি বিদ্যাসাগরের আন্দোলনে বাধা সৃষ্টি করতে শুরু করেন। রক্ষণশীল বাঙালি হিন্দুসমাজেও তাঁকে নিয়ে কুৎসিত নিন্দা ইত্যাদি চলতে থাকে। লেখা হয় অনেক গান কবিতা বই। এই কঠিন বিরুদ্ধ সময়ে বিধবাদের চোখের জল মুছবেন বলে সংকল্পবদ্ধ দৃঢ়চেতা বিদ্যাসাগর তাঁর সমাজসংস্কারের লড়াইয়ে পাশে পেলেন ব্রাহ্ম নেতাদের এবং ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর আধুনিক উদারমনস্ক যুক্তিবাদী ব্যক্তিদের। ধর্মের নামে কুসংস্কার তৈরি করে যে নারী নির্যাতন চলত তার বিরুদ্ধে বিদ্যাসাগর সে যুগে নারীমুক্তির ঐতিহাসিক সংগ্রাম করেছিলেন।

সরকারি আইনের সাহায্যে সতীদাহ প্রথা যেভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা হয়েছিল, বিদ্যাসাগর বুঝেছিলেন সেভাবেই বিধবা বিবাহকেও আইনসম্মত করা প্রয়োজন। তিনি বিধবা বিবাহ আইন প্রণয়নের জন্য একটি আবেদনপত্র তৈরি করে জনমত সংগ্রহ করেন এবং  ৯৮৭ জনের স্বাক্ষর নিয়ে ইন্ডিয়ান লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে পাঠান। বিদ্যাসাগরের আন্দোলনের সমর্থনে এগিয়ে আসেন বহু রাজা, মহারাজা, জমিদার সহ  শিক্ষিত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। ১৮৫৫ সালের ১৭ নভেম্বর জেপি গ্রান্ট নামের একজন সদস্য কাউন্সিলের সভায় বিধবা বিবাহ বিল উত্থাপন করেন। অবশেষে ১৮৫৬ সালের ১৬ জুলাই ঐতিহাসিক বিধবা বিবাহ আইন পাস হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে বিধবা বিবাহ  শুরুও হয়। প্রথম বিবাহটি হয়েছিল রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলকাতার বাড়িতে। পাত্র ছিলেন শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন এবং পাত্রী বারো বছরের বিধবা কালীমতী। বিদ্যাসাগর নিজের দায়িত্বে সব ব্যয়ভার বহন করে অনেকগুলি বিধবা বিবাহ দিয়েছিলেন। এমনকী নিজের একমাত্র পুত্র নারায়ণচন্দ্রকেও একজন বিধবার সঙ্গে বিবাহ দিয়ে দৃষ্টান্ত স্হাপন করেছিলেন। আইন পাসের পরও প্রবল সামাজিক রক্ষণশীলতার বাধার বিরুদ্ধে লড়াই করে বিদ্যাসাগরকে বিধবা বিবাহ আইন কার্যকর করতে হয়েছিল। দৃঢ়তার সঙ্গে দাঁড়িয়ে তিনি সমস্ত বাধা এবং অপমানের মোকাবিলা করেছিলেন। সত্য এবং ন্যায় রক্ষার জন্য তিনি আত্মবলিদান দিতেও প্রস্তুত ছিলেন।

এখানে এ কথাও মনে রাখা প্রয়োজন, রক্ষণশীল হিন্দুসমাজের নেতা রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বে ৩৬,৭৫৩ জনের স্বাক্ষর সহ বিধবা বিবাহের বিরুদ্ধে আবেদনপত্র  ভারত সরকারের কাছে জমা পড়ে। সেখানে বিদ্যাসাগরের সমর্থনে স্বাক্ষর করেছিলেন মাত্র ৯৮৭ জন। কিন্তু সংখ্যার বিচারে নয়, বিধবা বিবাহ আইনসিদ্ধ হল বিদ্যাসাগরের দেওয়া তথ্যপ্রমাণ, প্রবল যুক্তি এবং গণতান্ত্রিক-মানবিক ন্যায়বোধের ভিত্তিতে। জয় হল বিদ্যাসাগরের সংগ্রামের, জয় হল সত্যের। এই ঐতিহাসিক তথ্য এ কথা প্রমাণ করে যে,সত্য এবং ন্যায়বিচার কখনও সংখ্যার ওপর নির্ভর করে না। সংখ্যালঘু জনমতের কাছেও সত্য থাকতে পারে এবং ন্যায়বিচারের শক্তি থাকতে পারে। 

বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে ‌আমরা যেন ভুলে না যাই প্রায় দু’শ বছর আগে আপসহীন কর্মপুরুষ মহামানব ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নবজাগরণের আলোকে সমাজসংস্কার ও শিক্ষাসংস্কারের মাধ্যমে যে ঐতিহাসিক অবদান রেখে গেছেন, নারীমুক্তির দরজা খুলে দিয়েছিলেন, সেই মানবিক ঘটনাবলির জন্যই আমরা আজকের সমাজ পেয়েছি, যেখানে মেয়েরা উচ্চশিক্ষা লাভ করে আত্মসম্মানের সঙ্গে তাদের নিজস্ব ব্যক্তিত্বের প্রতিভার ওপর দাঁড়িয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারছে। তারপরও বলতে হয় ধর্মীয় গোঁড়ামি আমাদের মনের ভেতরে বাসা বেঁধে আছে, বিদ্যাসাগরের কাঙ্ক্ষিত মেয়েদের উপযুক্ত সমাজ এবং বিধবাদের প্রতি সমাজের সম্পূর্ণ সম্মানজনক দৃষ্টিভঙ্গি কিন্তু আজও আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। দু’‌শ বছরের দূরত্বে আজ বিদ্যাসাগরের জন্মদিনে দাঁড়িয়ে আমরা কি নতুনভাবে তাঁর আদর্শ এবং স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার শপথ নিয়ে এগিয়ে যেতে পারি না!

2 thoughts on “জীবন্মৃত বিধবাদের আলোকিত জীবন দিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর”

  1. খুব একটা লিখেছ। তথ্যের উপর ভিত্তি করে সুন্দর করে নিবন্ধটি সাজিয়েছ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!