যশোবন্ত রায়
১৮৯৩ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগো ধর্ম মহাসম্মেলনে হিন্দু ধর্মকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। সেখানে তিনি পাশ্চাত্যের মানুষের কাছে ভারত তথা ভারতবাসী সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণা নির্মূল করে দিয়েছিলেন। ভারতবর্ষ যে অসভ্য, বর্বর জাতির দেশ নয়, তার একটা গৌরবময় ইতিহাস, সভ্যতা ও সংস্কৃতি রয়েছে স্বামীজী সেদিন তা বিশ্ববাসীর কাছে সগৌরবে তুলে ধরেছিলেন। শিকাগো ধর্ম সম্মেলনে স্বামীজী তাঁর ভাষণে হিন্দু ধর্মের ত্যাগ, সমন্বয় ও বিশ্বকল্যাণকর মানবপ্রেমের কথা শুনিয়েছিলেন। তিনি তাঁর ভাষণে বলেন, “আমি সেই ধর্মের অন্তর্ভুক্ত বলে গৌরব বোধ করি, যে ধর্ম জগৎকে শিখিয়েছে সহিষ্ণুতা ও সর্বজনীন গ্ৰহীষ্ণুতার আদর্শ।….যে জাতি পৃথিবীর সব ধর্মের ও সব জাতির নিপীড়িত ও আশ্রয়প্রার্থী মানুষকে চিরকাল আশ্রয় দিয়ে এসেছে, আমি সেই জাতির অন্তর্ভুক্ত বলে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি”। শিকাগো ধর্মসভায় স্বামীজী দেখালেন যে নিজের ধর্মের প্রতি সম্পূর্ণ অনুগত থেকেও কিভাবে মানুষ অন্য ধর্মকে মর্যাদা দিতে পারে। একটি ধর্মে নিবদ্ধ থেকেও মানুষ কিভাবে নিজেকে বিশ্বজনীন ধর্মের উন্মুক্ত আঙিনায় প্রসারিত করে দিতে পারে। শিকাগো ধর্মসভার শেষ ভাষণে স্বামীজী এক বিশ্বজনীন ধর্মের আদর্শ উত্থাপন করলেন যা কোন দেশ, কাল বা ধর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। তিনি বললেন, “যদি কখনও এক সর্বজনীন ধর্মের উদ্ভভ হয়, তবে তা কখনও কোনও দেশে বা কালে সীমাবদ্ধ থাকবে না।…. সেই ধর্মের সূর্য, কৃষ্ণভক্ত, খ্রিস্টভক্ত, সাধু, অসাধু সবার উপর সমানভাবে কিরণ দিয়ে চলবে; সেই ধর্ম শুধু ব্রাহ্মণ বা বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বা মুসলমান ধর্ম হবে না–হবে সব ধর্মের সমষ্টিস্বরূপ অথচ তাতে উন্নতির সীমাহীন অবকাশ থাকবে; সেই ধর্ম অসংখ্য বাহু প্রসারিত করে পৃথিবীর সমস্ত নরনারীকে আলিঙ্গন করবে।….সেই ধর্মের নীতিতে কারও প্রতি বিদ্বেষ বা উৎপীড়নের স্থান থাকবে না। সকল ধর্মকে সমন্বিত করেই হিন্দু ধর্ম–একথাটা স্বামীজী শিকাগোর ধর্মমহাসভার মঞ্চ থেকেই সারা বিশ্বে প্রচার করলেন।
সারা বিশ্বের যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক মনীষিগণ বুঝতে পেরেছেন যে বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে একটা বিশ্বজনীন ধর্মবোধের প্রয়োজন রয়েছে। তাঁরা উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে জড়বাদ পুষ্ট ভোগ সর্বস্বতা ও স্বার্থপর ভোগ মানুষকে শান্তি দিতে পারবে না। মানবিক বিশ্বশান্তির জন্য এমন একটা নীতি ও ধর্মবোধে প্রতিষ্ঠিত হওয়া প্রয়োজন—যেখানে বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যায় সমুন্নত মানুষ আনন্দে সকলকে নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে। এই আশ্রয় কোন সাম্প্রদায়িক বা সংকীর্ণ ধর্ম হতে পারে না। শিকাগো ধর্ম মহাসভায় স্বামী বিবেকানন্দ হিন্দু ধর্মের যে স্বরূপ উদ্ঘাটন করেছেন–তা-ই হলো বিশ্বমানবের চিরন্তন ধর্মাদর্শ। ত্যাগ ও সেবাকে ভিত্তি করে আত্মমুক্তি ও জগদ্বিতের সাধনার দ্বারাই ব্যষ্টি ও সমষ্টি জীবনের চরিতার্থতা লাভ করা যায়। এরূপ উদার ও সর্বমানব কল্যাণকর ধর্মবোধই বর্তমান বিশ্বের অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারে।
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে আজ শিকাগো ধর্ম সম্মেলনের ১২৮ বছর পরও এখনও আমরা স্বামীজীর সেদিনের বক্তব্যের নির্যাস আত্মস্থ করতে পারিনি। সেদিন স্বামীজী হিন্দু ধর্মের যে মহান আদর্শ–সহিষ্ণুতা ও গ্ৰহিষ্ণুতার কথা বলেছিলেন আজ তা প্রহসনে পরিণত হয়েছে। ধর্ম ব্যবহৃত হচ্ছে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে। ধর্মকে নিয়ে যুদ্ধ ও হানাহানির অন্ত নেই। আজও বহু মানুষ তাদের নিজস্ব আশ্রয়ের খোঁজে দিশেহারা। যেভাবে আজ বিশ্ব চলছে তাতে আগামী দিনে মানব সমাজ অত্যন্ত বিপন্ন জায়গায় চলে যাবে। আজ শুধু ধর্ম নয়, রাজনীতি, সমাজ, শিক্ষা, সংস্কৃতি সব জায়গাতেই অবক্ষয়ের চিহ্ন স্পষ্ট। আর এর থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় স্বামীজির ভাবনায় ভাবতে শেখা এবং প্রায়োগিকভাবে তার বাস্তবায়ন করা। আজকের সময়ে তাই স্বামীজির শিকাগো ভাষণের গুরুত্ব অপরিসীম। যদি আমরা সকলে তাঁর মতাদর্শকে কাজে লাগিয়ে এ বিশ্বকে আগামী প্রজন্মের জন্য শান্তিপুর্ণভাবে বাসযোগ্য করে যেতে পারি তাহলেই ১২৮ বছর আগে শিকাগো ধর্ম মহাসম্মেলনে দেওয়া স্বামী বিবেকানন্দের ভাষণ সার্থকতা লাভ করবে।
( যশোবন্ত রায় রাধামাধব কলেজ, শিলচর-এর দর্শন বিভগের অবসরপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধান। )