The Mirrow

নিউ শিলচরে পানীয় জলের সমস্যার সাতকাহন

Share the Article

দিলীপ কুমার দে

বেশি আগের কথা বলছি না। ১৯৬০ সালে কলেজে পড়াশোনা আরম্ভ করার সময় শিলচর শহরের সীমা ছিল দক্ষিণে রাঙ্গিরখাল বা রাঙ্গিরখাড়ি। আশ্রম রোড, ন্যাশনাল হাইওয়ে, লিঙ্ক রোড ইত্যাদির অস্তিত্ব ছিল না। রংপুর ছিল গ্রাম, জুড়িন্দা নৌকায় পারাপার ছিল নিত্য যাত্রীদের একমাত্র ভরসা। লক্ষীপুরের সাথে যোগাযোগ ছিল ফাটকবাজার মধুরবন্দ হয়ে। বাজারের একাংশে  ওয়াটার ওয়ার্কস রোড – সেখানে ছিল শিলচরের পৌরসভা চালিত সবেধন নীলমণি একমাত্র জল পরিষ্কার করা ও সরবরাহের কেন্দ্র। শহরের কিছু অংশে মাটির নীচে বসানো পাইপ আর  টেঙ্কবাহী গাড়ি দিয়ে জল সরবরাহ হত। গোলদিঘির পারে বড় জেনারেটর বসিয়ে বরদা কোম্পানি শহরে বিদ্যুৎ দিত।

তখন পৌরসভা রাস্তায়ও জল ছিটিয়ে ধূলার উপদ্রব থেকে নাগরিকদের রক্ষা করত। অম্বিকাপট্টি, ইটখোলা, মালুগ্রাম, মধুরবন্দ অঞ্চলে প্রায় প্রতি বাড়িতে পুকুর ছিল।

কয়েক বছরের মধ্যে শিলচর গায়ে গতরে প্রায় আড়াই গুণ হয়ে গেছে, পুকুর বুজে তার উপর বহুতল হয়েছে, ব্যবসায়িক অঞ্চল বেড়েছে, নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। আজকের পৌরসভা অঞ্চলের

বাইরেও শহরাঞ্চল রয়েছে। এই বর্ধিত অঞ্চলের জন্য প্রয়োজন আরেকটি পৌরসভা কিংবা নগর সভা (করপোরেশন)।

শিলচর পৌরসভার সামনে সদরঘাটে কয়েক বছর আগে বৃহত্তর জল পরিশোধন কেন্দ্র গড়ে তোলার পরও শিলচরের জল সমস্যা মিটেনি। তাই পুরোনো শহরে পাবলিক হেল্থ আরেকটি বড় কেন্দ্র গড়ে তুলেছে।

দক্ষিণ শিলচর বা নিউ-শিলচর যেভাবে ব্যাপ্তি লাভ করেছে, সোনাই রোড, হাইলাকান্দি রোড, ন্যাশনাল হাইওয়ে, দাস কলোনি প্রভৃতির লেন-বাইলেনের সংখ্যা শতাধিক হয়েছে।এই বিশাল অঞ্চলের অর্ধ লক্ষাধিক মানুষের বিপুল সমর্থন পেয়ে তৎকালীন বিজেপি বিধায়ক ও অত্যন্ত সম্মানিত নেতা বিমলাংশু রায় মহাশয় অনেক চেষ্টা করে হাইলাকান্দি রোডে স্থাপন করান ‘আসাম আরবান ওয়াটার সাপ্লাই এন্ড স্যুয়ারেজ বোর্ড’ পরিচালিত এক জল পরিশোধন ও সরবরাহ কেন্দ্র। ওভার হেড জলের ট্যাংক ছাড়াই পাম্প করে সরবরাহ শুরু করিয়ে দেন, কারণ আশু প্রয়োজন মেটাতে এটা খুবই আবশ্যক ছিল। পুরোনো লোকরা এখনো এটাকে ‘বিমলাংশু বাবুর জল’ বলেন। তারপর পনেরো বছর অতিক্রান্ত হল, আজও ওভার হেড ট্যাঙ্ক হল না, গুণগত উন্নয়নও হল না, কেবল সাপ্লাইয়ের কানেকশন বাড়ল। পরবর্তী বিধায়ক ও সাংসদরা, এমনকি বিমলাংশু বাবুর সাংসদ পুত্রও, এর কোনও সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন ঘটালেন না।

নিউ শিলচরের বাড়িগুলোতেই শুধু টাকার বিনিময়ে জল কানেকশন রয়েছে,রাস্তার পাশে বিনে পয়সার কোন টেপ নেই। কানেকশনের জন্য, আধুনিক মিটার বসানোর জন্য বড় অঙ্কের টাকা জমা দিতে হয়,নইলে জল মিলবে না। গরিবের জন্য রাস্তার পাশে কোনও বিনে পয়সার টেপ (কল) বসানোর ব্যবস্থা ওই ‘আরবান ওয়াটার’ বোর্ডের নেই। মাসে ১১২ টাকা ছিল মাসিক ন্যুনতম আদায়, দিনে দুবার করে জল দেবার বিনিময়ে। এখন দিনে একবার জল দিয়েও সেই রেট্ বাড়াতে বাড়াতে ন্যুনতম মাসিক তিনশত টাকা (৩০ দিনের মাসের ক্ষেত্রে) অথবা তিন শত দশ টাকা (৩১ দিনের মাস হলে) দিতেই হয়। আপনি বাড়িতে দুমাস না থাকলেও ওই টাকা দিতে হবে। তারপর মিটার রিডিং অনুসারে মাসিক বিল হাজার টাকা পর্যন্ত উঠে যায়। অথচ পুরোনো শিলচরে মিটার ব্যবস্থা নেই, দিতে হয় বাড়ির কানেকশন পিছু নির্দিষ্ট একশত টাকা। একই শিলচর শহর, একই পৌরসভার মধ্যে থেকেও দু-ধরনের নাগরিক সেবা।

আর নিউ-শিলচরবাসীদের মাসিক জলের বিলের টাকা ‘আরবান ওয়াটার’ অফিসে গিয়ে একটি মাত্র লাইনে দাঁড়িয়ে নগদে দিতে হয়।নারী, পুরুষ, যুবক, বৃদ্ধ – সকলের জন্য একটি মাত্র লাইন। এখানে ব্যাঙ্ক চেক, ইলেকট্রনিক ট্রান্সফারের কোন ব্যবস্থা হয়নি। বলা হচ্ছে হবে। মানুষকে যত খুশি সময় লাইনে দাঁড়  করাতে বাধ্য করা যেন এই সরকারের এক আক্রোশমূলক নির্দয় ব্যবস্থা।

আর ‘আসাম আরবান ওয়াটার এন্ড স্যুয়ারেজ বোর্ড’ এর প্রধান কার্যালয় দিসপুরের গণেশগুড়িতে। শিলচর ও জোড়হাটের প্লান্ট থেকে যে অর্থ আদায় হয় তা দিসপুরীয় একাউন্টে জমা হয়। সেখান থেকেই বেতন দেওয়া হয়, পরিচালন ইঞ্জিনিয়ার গণেশগুড়িতে বসে শিলচর ও জোড়হাটের শ্রমিক দের বঞ্চিত করে গণেশগুড়ির কর্মীদের বেতন দিয়ে থাকেন বলে অভিযোগ। রাজধানীর মন্ত্রী বিধায়কদের বাসভবন ও সরকারি কার্যালয়ের জলের বিল সহজে আদায় হয় না।

ছবিঃ তমোজিৎ সাহা

নিউ শিলচরে কোন বিধায়ক বা সাংসদের বাড়ি নেই, ছিলও না। আর শিলচরের কোন দৈনিক নিউ শিলচর থেকে বের হয় না। কোন কেবল চ্যানেলের কেন্দ্রও এখানে নেই। তিন দিন জল সরবরাহ বন্ধ হলেও সঠিকভাবে এ অঞ্চলের জনগণের অসহায়তার সংবাদ পরিবেশ করানো এক কঠিন সমস্যা।ধরাধরি করে খবর ছাপালেও দেখবেন তা তৃতীয় বা অষ্টম পৃষ্ঠার কোন অবহেলিত জায়গায় স্থান পেয়েছে। অথচ কোন এক নেতা জেলার এক কোণায় গিয়ে কী অমৃতবাণী পরিবেশন করলেন, কিংবা বরাকের কোন নেতা গিয়ে কোথায় টিকিট পাচ্ছেন, গুয়াহাটি থেকে কোন নেতার অবতরণে এখানকার কতটি বাইক, কার, ট্রাক  গেছে, ফুলের মালা নিয়ে আর ফুলম  গামছা নিয়ে এইসব দিসপুরীয় নেতাদের পাশে কে কে হুড়মুড়িয়ে পড়েছেন তার সচিত্র বিবরণ শিলচরীয় সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠা থেকে ভাল ভাল স্থানে পাবেন। এখন সংবাদ জনগণের জন্য নয়, জনগণের কথা বলার জন্য নয়। আমি ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত শ্রদ্ধেয় বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় মহাশয় সম্পাদিত পত্রিকায় শিলচর থেকে খবর পাঠাতাম, লিখতাম। এই লাইনের পুরোনো লোকরা জানতেন। এমন এক ব্যবস্থা আমার নাগালে ছিল যে সবার আগে আমার খবর টেলিফোনে পৌঁছে যেত, পত্রিকা দপ্তরের বাংলা স্টেনোগ্রাফার প্রস্তুত থাকতেন।বিবেকানন্দবাবু বলেছেন, জনগণের সুখ দু:খকে গুরুত্ব না দিলে সাংবাদিকতা মূল্যহীন। বিজ্ঞাপনের ইঁদুর দৌড়ে অনেকে সেটা ভুলে যান। সেকথা আরেক দিন সুযোগ পেলে আলোচনা করা যাবে।

নিউ শিলচর (বা দক্ষিণ শিলচর)  অঞ্চলে জলের তীব্র সমস্যা নিয়ে কতবার যে ই-মেল, ওয়াটস আপ, চিঠি পাঠিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। বিধায়ক, সাংসদ প্রাপ্তি স্বীকার পর্যন্ত করেননি। ডিসির অফিস থেকে আমাকে একবার ফোন করে বলা হয়েছিল – আমি যেন একটা উত্তর ঐ অফিসে গিয়ে নিয়ে আসি। কী চূড়ান্ত অভদ্রতা। আমি এর  উত্তরে যা বলেছিলাম তা আর এখানে উল্লেখ করছি না।

আমি এই বুড়ো বয়সেও দুটি সত্তা হারাইনি- একটি শিক্ষক সত্তা, আর আরেকটি অযথা না জাহির করে প্রতিবাদ করার সত্তা।

শিলচরে পলিটেকনিক, মেডিকেল কলেজ, নিট (ইঞ্জিনিয়ারিং ডিমড্  বিশ্ববিদ্যালয়), আসাম কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় সহ বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়েছে। কিন্তু সৎসাহসী সজ্জন, পরহিতব্রতী শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা যেন অপসৃয়মান। তাই মনে হয় পরিশোধিত জলের সমস্যা দূর হতে আরও কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে।

( অধ্যাপক দিলীপ কুমার দে একজন প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মী। তিনি শিলচর টিটি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ। এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্ত নিজস্ব। )

5 thoughts on “নিউ শিলচরে পানীয় জলের সমস্যার সাতকাহন”

  1. এঁরা নমস্য। এই বয়সেও জোরে কণ্ঠ ছেড়ে প্রতিবাদী সত্তাকে জিইয়ে রাখার মানসিকতাকে সম্ভ্রমের সঙ্গে শ্রদ্ধা জানাই।
    মিরো’র উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি কামনা করছি।

    1. তমোজিৎ সাহা

      একদম ঠিক বলেছ। স্যরের এই ভূমিকাকে সকলের শ্রদ্ধা জানানো উচিত। তিনি আমাদের বিবেক।

    2. তমোজিৎ সাহা

      একদম ঠিক বলেছ দিদি। স্যরের এই ভূমিকাকে সকলের শ্রদ্ধা জানানো উচিত। তিনি আমাদের বিবেক।

  2. শান্তনু গঙ্গারিডি

    আজকের সময়ে দাঁড়িয়েও নূন্যতম পরিষেবা না পাওয়াটা দুঃখজনক।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!