মিরো ওয়েবডেস্ক
বরাকসূর্য, বরাকপিতা, বরাকমাতা, বরাকের লৌহপুরুষ –- এই বিশেষণগুলো আজ আর বরাকের বাতাসে শুনতে পাওয়া যায় না। বরাকের নীল-দিগন্তে সেই চরিত্রগুলো হারিয়ে গেছেন, অস্তমিত হয়েছেন। নতুন সূর্যোদয়ের ঈঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না, নিদেনপক্ষে অদূর ভবিষ্যতে। বরাক আজ যেন এক কলোনি – ভোটদাতাদের বিচরণক্ষেত্র।
বিগত এক দশকে বা তারও অধিক সময়ে দ্রুত অবনমন হয়েছে বরাক উপত্যকার। এই তো, খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, একটা সময় বরাক উপত্যকা থেকে যুগপৎ তিন তিনজন দাপুটে মন্ত্রী দিসপুরে একসঙ্গে কর্তৃত্ব দেখিয়ে গেছেন। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, আসামের দু’টি রাজ্যসভার সাংসদের পদের মধ্যে একটি বরাক উপত্যকার জন্য সংরক্ষিত ছিল বলে বলা চলে। শিলচরের তাবড় তাবড় নেতারা সেই পদে প্রতিনিধিত্ব করে গেছেন। আজ সেগুলো ইতিহাস। সেই বরাক আর আজকের বরাক – বিস্তর ফারাক !
দোষটা কি কেবল নেতৃত্বের? দায়ভার কি কেবল রাজনীতির? প্রশ্ন থেকে যায়। সময়, পরিস্থিতি পাল্টানোর সাথে সাথে রাজনীতির মাঠে রকমফের হয়েছে। অতীতে বরাকবাসীর মতামত পরিচালিত সেই রাজনৈতিক অবস্থান্তর আখেরে সামাজিক-রাজনৈতিক আঙিনায় বরাকবাসীর মাথা কতটুকু উঁচু করে রাখছে বা রাখতে পারছে সেটার পরিমাপ পর্যালোচনা ইতিহাসে লেখা হবে নিশ্চয়ই। আপাতত একটি কথা বোঝা যাচ্ছে, রাজ্য রাজনীতিতে বরাক উপত্যকার গুরুত্ব ম্রিয়মান হয়ে যাচ্ছে।
সময়ের ক্যানভাসে এর সম্পূর্ণ দায়ভার সাম্প্রতিক রাজনীতির ওপর চাপিয়ে দিলে ‘না-ইন্সাফি’ হয়ে যাবে। দীর্ঘদিনের লুকিয়ে রাখা ঘা আজ যেন সকল মলমের প্রলেপকে ছাপিয়ে মারাত্মকভাবে প্রকট হয়েছে। আজ বোঝা যাচ্ছে সেদিনের সেই বরাকসূর্য, বরাকপিতা বা বরাকের লৌহপুরুষেরা কেবল ক্ষমতার দাপটই দেখিয়ে গেছেন, রাজ্য রাজনীতিতে বিগতদিনের বরাক উপত্যকার স্বকীয় প্রতিচ্ছবিটি রক্ষা করে রাখতে পারেননি। তারা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় বরাক উপত্যকা থেকে সংঘবদ্ধ বলিষ্ঠ নেতৃত্ব গঠনের কথা ভাবেনটনি, তা সে যতই ক্ষীণ হোক উপত্যকার গণ-আবেদনের মর্যাদা রক্ষা করার কথা বিচার করেননি। যার পরিণামে, আজ এর খেসারত দিতে হচ্ছে উপত্যকাকে।
গত শতকের ৬০-এর দশকে উপত্যকার বাঙালিদের ভাষাগত অধিকার রক্ষার জন্য উপত্যকার বিধায়কেরা নিজেদের বিধায়ক-পদ থেকে একযোগে পদত্যাগ করেছিলেন। সঙ্ঘবদ্ধ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে অধিকার আদায় হয়েছিল। আজ পরিবেশ পাল্টেছে, পাল্টেছে চিত্রপট। আজ জনপ্রতিনিধিদের রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার মাত্রা অনেকাংশে বেড়েছে। দলের রাজনৈতিক অবস্থানের ঊর্ধে গিয়ে নূন্যতম বোঝাপড়ায় একই বিন্দুতে মিলিত হওয়া দুরূহ হয়ে গেছে। পরিস্থিতি ঠিক এমনটাই। এই পরিস্থিতির শিকার উপত্যকার সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও। আজ তাই উপত্যকার কন্ঠ রুদ্ধ, স্বর ভগ্ন। এই অসহায়তার প্রতিফলন উপত্যকার আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনধারার পরতে পরতে সূক্ষ্মভাবে আজ প্রতিফলিত হচ্ছে।
সমাজ নেতা সৃষ্টি করে, সেই নেতাই সমাজকে রাজনৈতিকভাবে পরিচালিত করে। ফিরে যাওয়া যাক সেই ৬০-৬১-র ভাষা-আন্দোলনের অধ্যায়ে। মূলত সেই সময় বরাক উপত্যকার (কাছাড়ের) রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও জনপ্রতিনিধিরাই জনমত সংগঠনের মাধ্যমে সেই আন্দোলনকে সাধারণ নগরিকদের ঐক্যবদ্ধ গণ-আন্দোলনের রূপ দিতে পেরেছিলেন। এর প্রমাণ ১৯৬১ সালের ১৯শে মে শিলচর রেল স্টেশনে আত্মাহূতি দেওয়া ১১ জন শহিদের প্রায় সকলেই মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের সাধারণ নাগরিক ছিলেন। এখানেই ছিল সেই আন্দোলনের সাফল্য।
আজ সেই চিত্রপট মলিন। দীর্ঘ এক দশকেরও অধিক সময়কালের আন্দোলনের পরও ভাষা শহিদ স্টেশন হিসেবে শিলচর রেল স্টেশনের নামকরণের দাবিটি বিশ বাও জলে। এটি কেবল একটি উদাহরণ। এরকম অনেক গণদাবিই আজ অধরা থেকে গেছে দল-মত নির্বিশেষে পরিকল্পিত সংঘবদ্ধ আন্দোলন আর যথাযথ রাজনৈতিক উপস্থাপনের অভাবে। রাজ্য রাজনীতির পরিসরে আজ যদি বরাক উপত্যকা সঠিক গুরুত্ব পাচ্ছে না তবে এর জন্য বিগতদিনের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অবিমৃশ্যকারিতা অধিকাংশে দায়ী বলে মন্তব্য করাই যায়। তবে, সেই দৃষ্টিকোণে আজকের দিনের বরাক উপত্যকার রাজনীতির চালচিত্র ও হাল-হকিকত উপত্যকার ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি ও অবস্থানের দেওয়াল লিখনের কাজটি সেরে রাখছে সেটা তো বলাই যায়। আর সেই যদি হয় তবে বর্তমান রাজনীতির ওপর উপত্যকাবাসীর নিয়ন্ত্রণটুকু যথাসম্ভব রাখাটা প্রয়োজন, নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য।
বরাক এখন রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেওয়ার মতো নেতা নেই।সব কন্ট্রাক্টর।আর এর জন্য দায়ী আমরা।