সঞ্জীব দেবলস্কর
বাংলা ভাষার অধিকার চেয়ে একাদশ শহিদের আত্মত্যাগের ষাটটি বছর পেরিয়ে গেল। উনিশে মে এলে আজ বরাক উপত্যকা, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গ, আর আন্তর্জাতিক সীমা পেরিয়ে বাংলাদেশ, ইউরোপ, আমেরিকায় বাঙালিরা এক মুহূর্তের জন্য এ শহিদের কথা ভেবে শ্রদ্ধায়, কৃতজ্ঞতায় আনত হয়ে উচ্চারণ করে ‘বাংলাভাষার অমর শহিদ তোমাদের ভুলছি না, ভুলব না।’ উনিশ শো একষট্টি সালের উনিশে মে’ বেলা দ্বিপ্রহরে (২.৩৫ মি) শিলচর রেলস্টেশনে অহিংস সত্যাগ্রহীদের উপর পুলিশের গুলি চালনা এবং এর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ আজ ইতিহাস, এ ইতিহাস বরাকবাসীর কাছে এক চলমান ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসও বটে, যে-ইতিহাসের সূচনা আছে কিন্তু সমাপ্তি নেই। এই একষট্টির পথ ধরেই বরাকে উনিশশো বাহাত্তরে সংঘটিত হল দ্বিতীয় ভাষা-আন্দোলন, প্রাণ দিল আরেক ছাত্রনেতা। এর একটি দশক পেরোতেই বরাকবাসীক যেতে হল তৃতীয় ভাষা-আন্দোলনে; উনিশশো ছিয়াশির এ আন্দোলনে রক্তদিয়ে বাংলাভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করল আরও দুই শহিদ। এরপর? হ্যাঁ, এরপরও বরাক উপত্যকার চলমান ভাষা আন্দোলনে মাতৃভাষার অধিকার চেয়ে শহিদ হল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিভাষী তরুণী সুদেষ্ণা সিনহা। উনিশশো ছিয়ান্নব্বুইতে বরাকের সম্প্রসারিত ভাষাআন্দোলনে সংযোজন ঘটল দ্বিতীয় মহিলা ভাষাশহিদের। বিগত ষাট বছরে বরাকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শহিদের সংখ্যাও বেড়ে চলল। এর শেষ কোথায় আজও কেউ জানে না।
আজ তাই ‘উনিশে মে’ বরাকবাসীর কাছে শুধু একটি দিন নয়, একটি প্রতীকও। এদিকে আমাদের লক্ষ্য করা হয়ে ওঠে না, সূচনা থেকে উনিশের অভিমুখই ছিল বৃহত্তর প্রেক্ষিতের দিকে। এটা তো কেবল মাত্র ‘একটি ভাষা’ অর্থাৎ বাংলাভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ছিল না, আসাম রাজ্যের প্রতিটি ক্ষুদ্র, মাঝারি এমনকী লুপ্তপ্রায় ভাষিকগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনও ঘটেছিল ওই আন্দোলনে। স্বাধীনতা-পরবর্তী একটা বৃহৎ জন-আন্দোলনের রূপ ধারণ করেছিল উনিশের আন্দোলন। এই আন্দোলনে অগ্রণীর ভূমিকায় বাঙালিরা থাকলেও ডিমাসা-মণিপুরি-হিন্দিভাষী এবং অন্যান্য জনগোষ্ঠীরও এতে স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। রেলস্টেশনে সত্যাগ্রহীদের উপর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে আসাম বিধানসভা থেকে পদত্যাগীদের তালিকা দেখলেই আমরা এটা সম্যক উপলব্ধি করতে পারব। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি প্রতিনিধি নন্দকুমার সিং, হিন্দিভাষী বিশ্বনাথ উপাধ্যায়, রামপ্রসাদ চৌবের সঙ্গে এই পদত্যাগী বিধায়কের তালিকায় উজ্জ্বল উপস্থিতি রয়েছে সাংসদ দ্বারকানাথ তেওয়ারির। এখানে বাংলাভাষা বা বাঙালি জনগোষ্ঠী কোন একক সংগ্রামী সত্তা ছিল না, বৈচিত্র্যময় প্রদেশটির বহুভাষিক চরিত্রলক্ষণ নিয়ে তা ছিল একটি সমন্বিত সংগ্রামী সত্তাই। বিগত দিনগুলোতে ওই অমোঘ সত্যটি আমাদের ভুলিয়ে দেবার প্রয়াস দেখা গেছে, এই প্রয়াস আজও সক্রিয়।
স্মরণ রাখা প্রয়োজন, তৎকালীন পূর্ববঙ্গে পশ্চিমী ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে বাহান্নর আন্দোলনের উত্তরণ ঘটেছিল স্তরে স্তরে। সূচনায় যা ছিল পশ্চিমী উর্দুর আধিপত্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন, পরবর্তী দিনে তারই বিস্তার ঘটল বৃহত্তর রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। ভাষিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ক্রমে রূপান্তরিত হল একটি সমন্বিত পলিটিক্যাল স্টেটমেন্টে, ধুলিস্যাৎ হল দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তি, পরাভূত হল ধর্মীয় সংকীর্ণতা, আত্মপ্রকাশ করল একটি স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্র। (পরিবর্তিত পরিপ্রেক্ষিতে সে আদর্শের কোথায় বিচ্যুতি ঘটল, কোথায় ধর্মনিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ণ হল, সে অবশ্য স্বতন্ত্র অনুশীলনের বিষয়, আপাতত এদিকে যাবার প্রয়োজন নেই।)
বলছিলাম, ওপারে বিষয়টি এখানেই থেমে থাকেনি। নানা ঘাত প্রতিঘাতে, নবতর প্রত্যাহ্বানের মধ্য দিয়ে দেশটি চলতে থাকল এবং এরই মধ্যে বিশ্বকে উপহার দিল একটি বিশেষ দিন, ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’, আধুনিক বিশ্বের কাছে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উপহার নিঃসন্দেহে।
একষট্টির আন্দোলনের কেন্দ্রভূমি তদানীন্তন কাছাড় জেলা হলেও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালির অংশগ্রহণ তো এতে ছিল, সে সঙ্গে এ আন্দোলনে সক্রিয় সহযোগিতা ছিল খাসি-জয়ন্তীয়া এবং গারো জনজাতিরও, সমর্থন ছিল বড়ো জগোষ্ঠীরও। সমতল কাছাড়ের কথা বাদ দিলেও উত্তর- কাছাড়ের ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কথাও বলতে হয়। বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয় খাসি জননেতা হুভার হুইনির কথা, যিনি ১৯৬০ সালের ২ জুলাই শিলচরে অনুষ্ঠিত পার্বত্য অঞ্চলের প্রতিনিধিদের একটি সমাবেশে উপস্থিত থেকে ‘বহুভাষিক আসামের বৈচিত্র্যময়তাকে’ রক্ষা করার স্বপক্ষে জোরালো এক বক্তব্য রাখেন। এদের কথাগুলো আজও আমাদের কানে যেন দূরাগত মন্ত্রের মতো বাজে। খাসি নেতা হুইনি বলেছিলেন, ‘মাতৃভাষা মায়ের মতই পবিত্র। ভাষার মন্দিরে মানুষের আত্মার অবস্থিতি … ভাষার বন্ধন রক্তের বন্ধন অপেক্ষাও কার্যকর।’ প্রস্তাবিত ভাষাবিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আসে কাবুই নাগা সমাজের পক্ষ থেকেও। খাসি-জয়ন্তীয়া জেলা পরিষদের সদস্য টি. কাজি বলেন, ‘২৫ বৎসর পূর্ব থেকে বাংলাভাষাই সম্মানের আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল … আসাম উপত্যকার ষড়যন্ত্রের ফলেই শ্রীহট্ট পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, এবং এর ফলে খাসিয়া পর্বতের লোকের আর্থিক দুর্গতি বাড়ছে।’
এইসব কথা আজ কেমন যেন অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে, বিশেষ করে আসাম সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ি রাজ্যগুলোতে আচমকা বাঙালি বিরোধিতার জোয়ার। পূর্বের ইতিহাস বিস্মৃত হয়ে খাসি ছাত্রযুব সমাজ মেঘালয়ে বাঙালিদের উপর নতুন উপদ্যমে নির্যাতন চালাল এই অতিমারির প্রাক্মুহূর্তেই, মেঘালয়ের উপর দিকে বরাক উপত্যকার যানবাহন চলাচলে বাধা সৃষ্টি করল, সরকারের উপর সমতলবাসীদের জন্য ‘ইনার লাইন পারমিট’ দাবির সপক্ষে জনতা কারফিউ ডেকে মেঘালয়ের ইছামতী, ভোলাগঞ্জ অঞ্চলে বাঙালিদের সাতআট মাস কার্যত পণবন্দি করেই রাখল (মার্চ-অক্টোবর, ২০২০)। শুধু কি তাই? এই হিংসার রাজনীতির সংক্রমণ ঘটল রবীন্দ্র-সম্পর্কধন্য ত্রিপুরা রাজ্যে। রাজ পরিবারের সন্তান প্রদ্যুতকিশোর দেববর্মা আচমকা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত জাতীয়সংগীতে সংশোধনীর পক্ষে জোর সওয়াল উঠিয়ে আসর গরম করতে চাইলেন (আগস্ট ২০২০); ত্রিপুরাকে বরাক উপত্যকা না-বানানোর শ্লোগান উঠল। নিহিত অর্থ বাংলাভাষার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা আরকি। আর, মণিপুর রাজ্যে? সেখানেও রাতারাতি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এবং আজাদ হিন্দ বাহিনীর অভিযানের সঙ্গে সম্পৃক্ত বাঙালি-অধ্যুসিত জিরিবাম জেলার (যা প্রাক্-ঔপনিবেশিক আমলে ছিল স্বাধীন কাছাড়ের অন্তর্গত) দুর্গানগর-মধুপুর-কালীনগর-বাবুপাড়া ইত্যাদি দশটি গ্রামের নাম পরিবর্তন করে এ অঞ্চলে বাঙালি-সংশ্রব ঘুচিয়ে দিয়ে বাঙালিদের ভিটেমাটি ছাড়া করার জোরদার প্রয়াস দেখা গেল ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে (এ মর্মে একটি সরকারি নোটিফিকেশনও জারি হল–No.1/9/1/2020/DC (JMB) dated 23/12/2020)। আরেকদিকে, অম্লমধুর সম্পর্ক নিয়েই মিজোদের সঙ্গে বাঙালিদের যে বেশ চলে যাচ্ছিল, কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাবলির সূত্র ধরে ওখানে আবহাওয়া এত উত্তপ্ত হল যে সশস্ত্র মিজো যুবসমাজ (YMA, MZP) উত্তরপূর্বে বিদেশি (পড়ুন বাঙালি, বাংলাদেশি) অনুপ্রবেশকারী নির্মূল করার লক্ষ্যে সরাসরি বরাকের অভ্যন্তরে অভিযান চালিয়ে অগ্নিসংযোগ, লুঠতরাজ, বন্দুক দেখিয়ে ক্ষেতের ফসল কেটে নেওয়া, এবং গ্রেনেড মেরে বাঙালিদের ইশকুল ঘর উড়িয়ে দেওয়ার মত কাজেও লিপ্ত হল (ডিসেম্বর ২০২০)। এখানে স্মর্তব্য ইতিমধ্যে প্রতিবেশী পাহাড়ি রাজ্যগুলোকে আত্মপ্রকাশ করেছে একটি জোট (২০১৬) ‘নর্থইস্ট ডিমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স’ (নেডা)।
এরই মধ্যে আসামে ডিটেনশন ক্যাম্প নির্মাণ, সন্দেহজনক বিদেশি তকমা দিয়ে বাঙালিদের জেলে পুরে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলতে থাকল। এরই মধ্যে কোভিড সংক্রমণে জেরবার আসাম রাজ্যে হাতে গোনা তিন দিনের জন্য বিধান সভার অধিবেশন বসিয়ে ‘অসমিয়া ভাষা শিক্ষা আইন-২০২০’ পাশ করিয়ে নেওয়া হল। এর অব্যবহিত পরই আসাম মাধ্যমিক শিক্ষাপর্ষদ অন-অসমিয়া পড়ুয়াদের উপর জারি করে দিলেন আবশ্যিক অসমিয়া পাঠের ফর্মান। সম্ভবত কাকতালীয়ভাবেই বিগত বছরগুলোর প্রথা ভেঙে উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষার রুটিনে উনিশে মে’ কে’ই বহাল করে দিলেন। (এরা ভাষা শহিদ দিবসকে বরাকে ইতিপূর্বে যে Observance Day’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন, এটা প্রায়শঃই ভুলে যান)। এ নিয়ে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ উঠলে শিক্ষাপর্ষদ সভাপতি অবশ্য একটি প্রেস-কনফারেন্স ডেকে বাঙালিদের বিরুদ্ধে বিস্তর বিষোদ্গার করে অবশেষে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে চলে যাবার উপদেশ দিয়ে ঠাণ্ডা হলেন – সে আরেক সাতকাহন। তবে বরাক উপত্যকার প্রেক্ষিতে খুব অপ্রাসঙ্গিকও নয় – এইসব সুখদুঃখ নিয়েই কালযাপন করতে হচ্ছে যে উপত্যকাবাসীকে।
ফিরে যাই একষট্টির কথায়, আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির ওই ভাষাবিলের বিরোধিতা করেছিলেন সেদিন মিজো প্রতিনিধি থাঙ্গারিডেমাও। তাছাড়াও ‘পার্বত্য জাতি সমিতি’র সম্পাদক থেংটুয়ামাও সেদিন প্রস্তাবিত ভাষাআইন প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। প্রস্তাবিত এ আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে স্বোচ্চার হয়েছিলেন মণিপুরি প্রতিনিধি বি, সিং, খণ্ডজাতিসমূহের প্রতিনিধি বি, এস বর্মন, জৈন্তা প্রতিনিধি পর্শনা প্রমূখও। এতৎসত্বেও সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সভায় ২৪ অক্টোবর ১৯৬০ সালে আসাম বিধান সভায় রাজ্যভাষা আইন পাশ হয়ে গেল।
কিন্তু এরপর শুরু হল লাগাতার আন্দোলন, এবং এর বিরুদ্ধে সরকারি প্রতিরোধ আর নিপীড়ন, রচিত হতে লাগল ভিন্ন ইতিহাস। ১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি করিমগঞ্জে আয়োজিত এক গণ-কনভেনশনে কাছাড়ের ডিমাসা জননেতা অনিলকুমার বর্মন বলেন, ‘আমরা ভাষা আইনের জন্য দারুণ বিপর্যয়ের মুখে পতিত হয়েছি। … আসাম বিধানসভায় কাছাড়ের সদস্য ও লোকসভার প্রতিনিধিগণের দ্বিধাজড়িত আচরণে কাছাড়ের মানসম্মান আহত ও স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হতে চলেছে।’ এ কথাগুলো আজ বিশেষ করে স্মরণ করা প্রাসঙ্গিক এ কারণেই যে, আজ এই জনগোষ্ঠীর কতিপয় ব্যক্তির একটি আবেদনকে ভিত্তি করে রাজ্যসরকার বরাক উপত্যকার বিশাল গণদাবি উপেক্ষা করে ‘ভাষাশহিদ স্টেশন’ নামকরণের মাধ্যমে একাদশ শহিদের প্রতি সম্মান জ্ঞাপনের সরকারি সিদ্ধান্তকে ফাইল চাপা দিয়ে রাখলেন। ২০০৫ সাল থেকে উত্থিত এ দাবির স্বপক্ষে বরাক উপত্যকার জাতি-ভাষা-ধর্ম- দল-মত নির্বিশেষে আবেদন করেছেন এবং ২০১৬ সালের ৭ নভেম্বর কেন্দ্রীয় সরকারে স্বরাষ্ট্র দপ্তর থেকে এ মর্মে একটি ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ দিয়ে রাজ্য সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করারও নির্দেশ দেওয়াও হল। এরপর আরেক দীর্ঘ নীরবতা। ঐতিহাসিক কাল থেকেই বন্ধু মনোভাবাপন্ন সেই ভাষিকগোষ্ঠীকে দিয়ে উত্থিত কাছাড়ের শেষরাজা গোবিন্দচন্দ্রের নাম নিয়ে পালটা-প্রস্তাবকে ভিত্তি করে শহিদদের এ স্বীকৃতি আটকে দেওয়া হল। এখানে এটাও উল্লেখ করা প্রয়োজন, মহারাজ গোবিন্দচন্দ্র (১৮১৪-১৮৩১) উনবিংশ শতকে কাছাড়ের অন্যতম বন্দিত কবিও বটে, যাঁর রচিত ‘রাসোৎসব গীতামৃত’ কাছাড়ে বাংলা কাব্যজগতে স্বমহিমায় উজ্জ্বল। এও উল্লেখ্য, কাছাড়ে ডিমাসা রাজসভায় কেবলমাত্র বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতাই করেই রাজন্যকুল স্থির থাকেন নি, মহারাজ গোবিন্দচন্দ্র এবং তাঁর পূর্ববর্তী রাজা কৃষ্ণচন্দ্র স্বয়ং বাংলায় শাক্ত এবং বৈষ্ণবীয় পদাবলীও রচনা করে গেছেন যা আজও বরাক উপত্যকার অমূল্য সাংস্কৃতিক সম্পদ হিসেবে সমাদৃত। এ অবস্থায় ভাষাশহিদের নামে এ শহিদ-স্মারক যে কাছাড়ের সুমহান ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতাই ধারণ করবে তা এতে কোন সন্দেহ নেই। বিশ শতকের প্রথম দশকে ‘সুরমা সাহিত্য সম্মেলনে’র প্রয়াসে খাসপুর রাজবাড়ি সংরক্ষণ এবং মহারাজ গোবিন্দচন্দ্রের প্রয়াণ ক্ষেত্র হরিটিকরে একটি স্থায়ী স্মৃতিসৌধ প্রতিষ্ঠার জন্য মহামহোপাধ্যায় পদ্মনাথ বিদ্যাবিনোদ, আইনজীবী কামিনীকুমার চন্দ, ডিমাসা সমাজসেবী নন্দলাল বর্মন, জমিদার বিপিনচন্দ্র দেবলস্করের প্রয়াস (১৯১৪) ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে। এ ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতার প্রতিফল দেখা গেছে কাছাড়ের সুসন্তান, অনিলকুমার বর্মনের ১৯৬১ সালে করিমগঞ্জে অনুষ্ঠিত গণকনভেনশনে বক্তব্যে। তিনি সংগ্রামীদের উদ্দেশে বলেন, ‘পূর্ববঙ্গে বাঙালিরা বাংলাভাষার জন্য মৃত্যুকে তুচ্ছ করে যে সংগ্রাম করেছিলন, আমাদের উচিত তাঁদের সংগ্রাম থেকে প্রেরণা লাভ করা।’
(দুই)
বলেছিলাম উনিশের আন্দোলন শুধুমাত্র একটি ভাষিকগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এ আন্দোলনের স্বতস্ফূর্ত শ্লোগানটিও বিশেষ লক্ষ্যণীয়, ‘মাতৃভাষা জিন্দাবাদ’। অন্যান্য জনগোষ্ঠীর কণ্ঠও এতে মিশেছিল। সেদিন একাদশ শহিদের রক্তের বিনিময়ে যে অধিকার অর্জিত হল এতে বাংলা ভাষার কথা সুস্পষ্ট ভাবে উচ্চারিত হলেও অন্যভাষারত কথাও অনুক্ত ছিল না। শাস্ত্রী ফর্মুলা অনুযায়ী সংশোধিত ভাষা আইনের ৪ নম্বর ধারায় আসামে ওতোনমাস এলাকা’য় প্রচলিত ভাষাকে মান্যতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এর ফলে ষষ্ঠ তফশিলের অন্তর্গত বড়ো জনজাতিরা লাভ করলেন তাঁদের ভাষার স্বীকৃতি। তাছাড়াও এ আইনের ৭ নং দারায় স্পষ্ট ভাবে ‘Right of various linguistic groups’ । এ হল সমন্বিত জনমতের চাপের ফল।
আসাম রাজ্যভাষার সংশোধিত ভার্সনের ৫ নম্বর ধারায় শহিদের রক্তের বিনিময়ে সংযোজিত হল Safeguard of the use of Bengali language in the District of Cachar) এতে বলা হয়েছে: “Without prejudice to the provisions contained in S.3, the Bengali language shall be used for administrative and other official purpose upto and including district level in the district of Cachar`z
ওই সংশোধনীর সূত্র ধরেই আসামে বড়ো জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষার সংস্থান হয়েছে শিক্ষা এবং সরকারি ক্ষেত্রে। উনিশ তো শুধু একটি ভাষার জন্যই আশীর্বাদ হয়েই আসেনি। কিন্তু আজ আশ্চর্য লাগে দেখে এই ভাষাআইন সংশোধনী যখন অপরাপর ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করে দিল সেই আইনি সূত্রকে অবলম্বন করে রাজ্যে নব্বই লক্ষ লোকের মুখের ভাষাকে কোণঠাসা করে প্রায় সাড়ে ৩১ লক্ষ জনগোষ্ঠীর ভাষাকে দ্বিতীয় সহযোগী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হল। বাংলা ভাষা এখন সরকারের দুয়োরাণী। ২০২০ সালে সরকার কুড়িটির অধিক ভাষার সাহিত্য-সংস্কৃতি সংস্থার জন্য সর্বমোট ৭৫ কোটি টাকার অনুদান বিশেষ একটি ‘কর্পাস তহবিল’ গঠন করেন। এ তালিকায় সারা রাজ্যে একখানি বাঙালি সংগঠনের নামও দেখা গেল না। রাজ্যে এ ভাষিককগোষ্ঠীর অস্তিত্বকে সরাসরি অস্বীকার করার এ প্রয়াস। এর পেছনে রয়েছে প্রায় সাতটি দশকের প্রক্রিয়া। আমরা এর বিশদ অনুশীলনে আর যাব না, শুধু সম্প্রতি মাধ্যমিক শিক্ষাপর্যদের নির্দেশের (১৭ মার্চ,২০২১) প্রেক্ষিতে আসাম বিধানসভার প্রোসিডিংস থেকে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ মহোদয়ের একটি উক্তির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করব – ‘…ইট ইজ নট দ্যা ইনটেনশন অব দ্যা গভর্নমেন্ট টু মেক আসাম অ্যা বাই-লিঙ্গুয়েল স্টেট।’ আসলে দ্বিভাষিক নয় কাল থেকেই আসাম যে একটি বহুভাষিক রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করার ফলেই স্বাধীনতার সূচনালগ্ন থেকেই আসাম একটি জাতিবিদ্বেষের চারণভূমি হিসেবে গড়ে উঠেছে। এই সমস্যা থেকে মুক্তি কামনায় একে একে মেঘালয়, মিজোরাম, অরুণাচল প্রদেশ আসাম থেকে বেরিয়ে গেল। ইতিপূর্বেই মণিপুর, নাগাল্যান্ড—যা একটা সময় বৃহত্তর আসামের অন্তর্ভুক্তই ছিল—তাও স্বতন্ত্র রাজ্য হিসেবে গড়ে উঠেছে। বডো-কার্বি-ডিমাসা জনগোষ্ঠীর মধ্যেও অসন্তুষ্টি দানা বেঁধে উঠছে। বরাক উপত্যকাকে বারবার গলাধাক্কা এবং আসাম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উপদেশও দেওয়া হচ্ছে। যদি সত্যিই আসামের আরও চারটি কিংবা আরও কয়েকটি ভাষিক অঞ্চল রাজ্য থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হয়, তবে রাজ্যটি অস্তিত্ব কী ক’রে সুরক্ষিত থাকবে এ প্রশ্ন আজকের দিনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। উনিশে মে’র আন্দোলনে যে বহুভাষিকতার স্বর নিহিত আগামীদিনের আসামকে স্থায়ী শান্তি, সম্প্রীতি এবং সহাবস্থানের আদর্শে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে তা’ই। সীমান্তের ওপারে উনিশশো বাহান্নর বাংলাভাষার আন্দোলনের বুকেই জন্ম নিয়েছিল ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা’ চেতনা, বিশ্বের প্রতিটি ভাষিকগোষ্ঠীর ভাষার সুরক্ষার আওয়াজ, তেমনি আসাম রাজ্যে একষট্টির আন্দোলনেও যে রয়েছে বহুভাষিকতার জয়ধ্বনি। উনিশের মে’র সম্প্রীতি সহাবস্থানের বার্তাই খণ্ডিত, জাতি-ধর্ম-ভাষার পীড়নে জর্জরিত এই রাজ্যে স্থায়ী শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ নির্দেশ করতে পারে, যদি আমরা সেই বার্তা শুনতে চাই।
( এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত সম্পূর্ণ লেখকের। )