The Mirrow

১৯শে মে — চাই ভাষা-সাহিত্য চর্চার উপযুক্ত পরিবেশ

Share the Article

রাহুল রায়

১৪০ কোটির দেশে মাত্র ১৪০০০ মানুষ । শতাংশের হিসাবে সেটা কোথায় সেদিকে না গিয়ে বলতে হচ্ছে ভারতে সংস্কৃতকে মাতৃভাষা রূপে পরিচয় দেন মাত্র ১৪০০০ মানুষ।  অথচ এই সংস্কৃত ভাষার প্রচার ও প্রসারের জন্য দেশজুড়ে কেন্দ্রীয় সরকার উঠে পড়ে লেগেছে। তার রাজনৈতিক দূরভিসন্ধি কি সেটা পাশে রেখে বলতে হয় সংস্কৃত ভাষাকে এই দেশের জন্যই সসম্মানে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। কারণ এই প্রাচীন দেশের একটি বিশাল সময় জুড়ে সাহিত্যকর্মের অধিকাংশ হয়েছে সংস্কৃততে। প্রাচীন ভারতের সাহিত্যকর্মের মধ্যে রামায়ন, মহাভারত, বেদ, উপনিষদ, পুরাণ সবই কিন্তু এই ভাষাতেই রচিত। প্রাচীন ভারতের সমাজ, ইতিহাসকে জানতে হলে সে-সময়কার সাহিত্যকে জানতে হবে এবং সেই সাহিত্যকে জানতে হলে সেই সাহিত্যের ভাষা অর্থাৎ সংস্কৃত জানতে হবেই। যার জন্য আজও দেশ, বিদেশের গবেষকরা সংস্কৃতর প্রতি আকৃষ্ট হন। সেদিক থেকে ভারত সরকারের সংস্কৃতকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টাকে সম্পূর্ণ পণ্ডশ্রম বলা যায় না। শুধু সংস্কৃত নয়, একই কথা বলা যায় বৌদ্ধ সাহিত্যকর্মের জন্য পালি তথা মধ্যভারতের জন্য ফার্সি ভাষাকে। একটি ভাষার আয়ু নির্ভর করে তার নিজস্ব গ্রহণযোগ্যতার ওপর আর মানুষের কাছে সেই ভাষার গ্রহণযোগ্যতা তথা আকর্ষণীয়তার অনেকটাই নির্ভর করে সেই ভাষার মাধ্যমে হওয়া সাহিত্যকর্মের উপকর্ষতার ওপর। অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী কিন্তু অনমনীয় হওয়ায় সংস্কৃত আজ মৃতপ্রায়। তবু এই ভাষা সাহিত্যপ্রেমী মানুষের কাছে তার মাধ্যমে রচিত সাহিত্যকর্মের জন্য এখনও আকর্ষণীয়, জীবিত।

 দুই দশক আগের কথা। তখন শিশু, কিশোরদের উপহার হিসাবে বই দেওয়া হতো। বয়স ও রুচি অনুযায়ী জন্মদিনের মতো অনুষ্ঠানে নিয়মিত ভাবে বই আসতো। গল্প, কবিতা, উপন্যাস কিছুই বাদ যেতো না। বলাই বাহুল্য অধিকাংশই বাংলা। সেখানে বিবেকানন্দ, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, সুকান্ত সবাই আছেন। মহান সাহিত্যিক তথা তাদের সাহিত্যকর্ম নিয়ে প্রজন্মগুলো গড়ে উঠতো । বলা যায় এক প্রজন্ম এভাবে নিজেদের অমূল্য সম্পদ আগাম প্রজন্মের হাতে তুলে দিত। এতে সাহিত্যের প্রতি যেমন তাদের আগ্রহ বাড়তো তেমনি বাংলা ভাষার সঙ্গে তাদের গড়ে উঠতো চিরদিনের সম্পর্ক। আধুনিক সময়ে ভারতে বাংলার মতো সমৃদ্ধ সাহিত্যভাণ্ডার আর কোনো ভাষায় সম্ভবতঃ সৃষ্ট হয়নি। সেই সুসমৃদ্ধ সাহিত্যের প্রতি একজন মানুষের মধ্যে সেই শৈশব থেকেই আবেগ, গর্ব, অভিমান তৈরি হওয়াটা স্বাভাবিক।

এর পরের ধাপটি ছিল স্কুল, কলেজ। সাহিত্যচর্চার মধ্য দিয়ে বাংলার রত্নভাণ্ডারের সঙ্গে ছাত্র-ছাত্রীদের পরিচয় করানো হতো। চরিত্রগঠনে সাহিত্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। সিলেবাসগুলোতে সেদিকটা মাথায় রেখে বয়সের বিভিন্ন ধাপে সাহিত্যিক, কবি, বিপ্লবীদের সঙ্গে ছাত্র-ছাত্রীদের পরিচয় করানো হতো। চরিত্র, মনন গঠনের সেই বয়সে যে সাহিত্য ছিল মনের শ্রেষ্ঠ বন্ধু, সেই বন্ধুর ভাষা ছিল বাংলা। কিশোর-তরুণ অবস্থায় জীবনে আসা সাহিত্য যেমন সারাজীবনের জন্য মানুষের মনে ছাপ ফেলে তেমনি সেই সাহিত্যের ভাষার সঙ্গেও চিরদিনের সম্পর্ক হয়ে যায়। এতে নিজের ভাষার প্রতি নব্যপ্রজন্মের মধ্যে হীনমন্যতা সৃষ্টি হওয়ার ভয়টি গোঁড়াতেই অস্তিত্বহীন হয়ে যায়।

বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে গড়ে ওঠা এই সখ্যতার পরবর্তী ধাপ ছিল স্থানীয় বই এর দোকান তথা বইমেলাগুলো। দেড় থেকে দুই দশক আগেও শিলচরের বইয়ের দোকান বা বইমেলায় যে সাহিত্যসম্ভার থাকতো আজ তা প্রায় কল্পনা করা যায় না । বইমেলায় কলকাতার নামী দামী প্রকাশকরা স্টল সাজাতেন, তাতে ভিড় হতো দেখার মতো। গ্রাহকদের মধ্যে উদ্দীপনা দোকানীদের সমৃদ্ধ হতে উৎসাহিত করে। নান বয়সের জন্য নানা বই নিয়ে তাঁরা তাদের বিপনী সাজাতেন এবং বলা বাহুল্য সেগুলোর অধিকাংশই ছিল বাংলা। বাংলা ভাষার চর্চা, বিকাশ, বিস্তার এভাবেই হয়েছিল। শুধু মায়ের ভাষা বলে না, একটি সমৃদ্ধশালী সাহিত্যের ভাষা হিসাবে পাঠকশ্রেণীর মধ্যে প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলেছে।

আজকে শিলচর বইয়ের দোকানে ভালো বই পাওয়া যায় না। বইমেলাতে কলকাতার ভালো স্টল আসে না। অনলাইন থেকে সেরকম ভালো বাংলা বই পেতে যথেষ্ট কষ্ট হচ্ছে। এতে বাংলা ভাষার চর্চা ও ব্যবহার কমছে। নতুন প্রজন্ম বঞ্চিত হচ্ছে। এই অভিযোগগুলো সংস্কৃতি জগতে কান পাতলেই শোনা যায়। তবে এর জন্য দোকানী বা বইমেলার স্টলের মালিকদের কিন্তু দায়ী করা যায় না। দোকানে যোগান চাহিদার ওপর চলে। দোকানে দু’জন মানুষও যদি একটি বই এর জন্য যায়, তখন দোকানী তার কাছে না থাকলেও তিন নম্বর জন আসার আগে সেই বই আনিয়ে রাখবেন। একই অবস্থা মেলায়ও। চাহিদা বাড়লে কলকাতার প্রকাশকরাও এখানে মেলায় স্টল দেবেন। বিক্রি না হলে শিলচর এসে টাকা ও সময় নষ্ট তারা কেনই বা করবেন।

ফিরে আসি আগের জায়গায়। ভাষার সম্মান তথা অস্তিত্বরক্ষার্থে এর নিরন্তন চর্চা চাই। এতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় তার মধ্যে দিয়ে রচিত সাহিত্য। নবপ্রজন্মের মধ্যে ভাষাকে পৌঁছে দিতে হলে দিন বিশেষে সাড়ম্বরে ভাষার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলেই যে কাজ হবে না সেটা অন্ততঃ এই কয়েক বছরে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে। তার জন্য  সর্বাগ্রে তৈরী করতে হবে নবপ্রজন্মের মধ্যে ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা। সেই শ্রদ্ধা সৃষ্টি হবে যখন সেই ভাষার সঙ্গে তার সখ্যতা প্রগাঢ় হবে। তার জন্য চাই নিয়মিত চর্চা এবং সেই চর্চার জন্য তার হাতে চাই প্রয়োজনীয় রসদ।

প্রশ্ন হল সেই সাহিত্যসম্ভার রূপী রসদ কি নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছানো হচ্ছে? এখনও কি শিশু, কিশোরদের হাতে সময়ে, অসময়ে বাংলা ভাষায় রচিত সমৃদ্ধ সাহিত্য পৌঁছানো যাচ্ছে?  ঘরে সেটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে? স্কুল, কলেজের সিলেবাসে কি এখনও চরিত্র, মনন গঠনে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় রচনাগুলো বাংলার মধ্যে দিয়ে যোগান দেওয়া হচ্ছে?  ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি কলেজ জীবনে পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে যে সময়োপযোগী লেখার সম্ভার পেয়েছিলাম সেটা বাণিজ্যের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও বাংলাকে অন্যতম প্রিয় বিষয় হিসেবে দেখার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিশোর কবি সুকান্তের ‘আঠারো বছর’, কবিগুরুর ‘দুর্ভাগা দেশ’, বিদ্রোহী কবি নজরুলের ‘সাম্যবাদী’, তারুণ্যের প্রতীক নেতাজী সুভাষের ‘তরুণের স্বপ্ন’ কলেজপড়ুয়া মননে হিল্লোল তুলতে বাধ্য। আজ এরকম লেখনী, কবিতা কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না সেটা নিয়ে প্রশ্ন করার অবকাশ অতি অবশ্যই আছে। কারণ সরকারী এই নীতির ফলে সরাসরি ক্ষতি হচ্ছে আমাদের আগাম প্রজন্ম। বলতে বাধা নেই যে বাংলা ভাষা নিয়ে বরাক উপত্যকার নতুন প্রজন্ম আর আগের মতো আগ্রহী নয়।  তাই তো বই এর দোকানী আক্ষেপ করে বলেন যে ‘কার জন্য বই আনবো, বিক্রি নেই’, কলকাতার প্রকাশনী সংস্থার লোকেরা শিলচর এসে বলেন ‘ এভাবে এসে লাভ নেই, এখানে বই এর চাহিদা নেই ‘। নতুন প্রজন্মকে এই ভাষায় রচিত সাহিত্যসম্ভার নিয়ে আগ্রহী করার ব্যবস্থা করতে হবে। সে নিজে থেকেই তখন ভাষার প্রতি আগ্রহী হবে। নিজের ভাষা নিয়ে গর্ব, অভিমান করবে। ভাষা নিয়ে হীনমন্যতা তখন আর তার মধ্যে কাজ করবে না। তবে তার জন্য চাই উপযুক্ত পরিবেশ। শুধু কথায় ফুলঝুরিতে আর কাজ হবে না, এবার মাঠে নেমে হাত লাগাতে হবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!