The Mirrow

শিক্ষা ও সমাজ-সংস্কারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান

Share the Article

উনিশ শতকে বাংলার শিক্ষা ও সমাজসংস্কার আন্দোলনের ইতিহাসে যে-সমস্ত জ্যোতিষ্ক চিরস্মরণীয় অবদান রেখে গেছেন, তাঁদের মধ্যে একজন বাস্তববাদী ও মানবতাবাদী সংস্কারক ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তৎকালীন বাংলার ঘুনেধরা ও স্থবির সমাজ ব্যবস্থার মূলে কুঠারাঘাত করতে তিনি আমরণ লড়াই করেন। বিদ্যাসাগর তৎকালীন হিন্দু সমাজের প্রচলিত বিভিন্ন কুপ্রথা, কুসংস্কার, জাতিভেদ প্রথা প্রভৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি তাঁর অবদান রেখেছেন। এই প্রসঙ্গে তাঁর নারী মুক্তি আন্দোলন প্রণিধানযোগ্য। নারী মুক্তি আন্দোলনে তিনি ছিলেন ভারতের অন্যতম পথিকৃৎ।১৮২০সালের ২৬সেপ্টেম্বর তিনি বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ঠাকুর দাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মা ভগবতী দেবী।


ছোটবেলা থেকেই ঈশ্বর চন্দ্র অত্যন্ত প্রখর বুদ্ধি সম্পন্ন ও মেধাবী ছিলেন। নিজের শিক্ষা গ্রহণের সাথে সাথে তিনি শিক্ষা ও সমাজ সংস্কার নিয়ে ভাবনা চিন্তা শুরু করেন কিশোর বয়স থেকেই আর এর ফল স্বরূপ পরবর্তীতে আমরা তাঁকে শিক্ষা ও নারী মুক্তির একজন অন্যতম সংস্কারক হিসাবে পাই। গভীর মানবতাবাদে উদ্বুদ্ধ বিদ্যাসাগর প্রথম থেকেই শিক্ষার প্রসারে ব্রতী হয়েছিলেন। শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে তিনি অনেকগুলো পদক্ষেপগুলি নিয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর শিক্ষা সংস্কারের ক্ষেত্রে সবার আগে জোর দিয়েছিলেন বিদ্যালয় স্থাপনের ওপর। তিনি নিজে বিভিন্ন জেলায় ২০ টি মডেল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যার বেশিরভাগই তার নিজের খরচে চলত। এছাড়া ১৮৭২ খ্রিঃ তিনি নিজে মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা বর্তমানে বিদ্যাসাগর কলেজ নামে পরিচিত।
ভারতবর্ষের মাটিতে নারী শিক্ষা ছাড়া যে উন্নতি সম্ভব নয় তা তিনি মর্মে মর্মে উপলদ্ধি করেছিলেন। বিদ‍্যাসাগরই কলকাতায় প্রথম মেয়েদের স্কুল শুরু করেন। যার নাম হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় এবং বর্তমান নাম বেথুন স্কুল। এছাড়াও ৩৫ টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। প্রায় এক হাজার তিনশো ছাত্রী এই বিদ্যালয়গুলিতে পড়াশুনা করত।


বিদ্যাসাগর প্রথম থেকেই জোর দিয়েছিলেন মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের উপর।তবে একই সঙ্গে তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষার গুরুত্বকে অস্বীকার করেননি। পাশাপাশি তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সমন্বয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। শুধু তাই নয় শিক্ষাক্ষেত্রে তিনি বেশকিছু নিয়ম কানুন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কেবলমাত্র ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য সন্তানরা সংস্কৃত পড়তে পারবে এই নীতি তুলে দিয়ে সকল বর্ণের হিন্দু ছাত্রদের জন্য সংস্কৃত পড়ার দ্বার খুলে দেন তিনি। শুধু মাত্র বিদ্যালয় স্থাপন বা শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়মনীতি পালনের মধ্যেই তাঁর প্রয়াস সীমাবদ্ধ ছিল না। সেইসঙ্গে পাঠ্যপুস্তক রচনার দায়িত্বও তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। বর্ণপরিচয়, শিশুশিক্ষা, কথামালা, নীতিবোধ, চরিতাবলি সহ সংস্কৃত শিক্ষার সুবিধার জন্য সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা ও ব্যাকরণ কৌমুদী প্রভৃতি রচনা করেন। এছাড়াও আখ্যান মঞ্জরি, শব্দ মঞ্জরি, শ্লোক মঞ্জরি, ব্রজবিলাস, রত্নপরীক্ষা প্রভৃতি বই রচনা করেন যা বাংলা ও সংস্কৃত শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। এছাড়াও সীতার বনবাসের মতো গ্রন্থ রচনার মাধ্যমে তিনি বাংলা গদ্য লেখার নতুন পথ রচনা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কাছে তিনি ছিলেন ‘বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী।’


বিদ্যাসাগর সারাজীবন ধরেই সমাজের বহুমুখী সংস্কারে ব্রতী ছিলেন। কুসংস্কার ও বিভিন্ন নিয়মকানুনের বেড়াজালে আবদ্ধ হিন্দুসমাজের নারীদের সার্বিক উন্নয়নের জন্য তাঁর প্রচেষ্টা ছিল অবিস্মরণীয়। বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহের বিরােধিতা এবং বিধবাবিবাহের পক্ষে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। হিন্দু বিধবাদের অসহনীয় দুঃখ, তাঁদের প্রতি পরিবারবর্গের অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার গভীরভাবে ব্যথিত করেছিল তাঁকে। এই বিধবাদের মুক্তির জন্য তিনি আজীবন সর্বস্ব পণ করে সংগ্রাম করেছেন। তাঁর সংগ্ৰাম সফল হয়েছিল ১৮৫৬ সালে যখন সরকার বিধবা বিবাহ আইনসিদ্ধ ঘোষণা করেন।তিনি তাঁর নিজের ছেলেকে ভবসুন্দরী নামক এক অষ্টাদশী বিধবার সঙ্গে প্রথম বিবাহ দেন। বাল্যবিবাহ নামক সামাজিক ব্যাধি নির্মূল করার জন্য তিনি নিরলস সংগ্রাম করেন । তাঁর নিরলস প্রচেষ্টার ফলে সরকার ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে একটি আইন পাস করে মেয়েদের বিবাহের বয়স কমপক্ষে ১০ বছর ধার্য করে। সেই যুগে হিন্দুসমাজে পুরুষের বহুবিবাহ করার অধিকার ছিল। সমাজে এই প্রথার বহুল প্রচলন ছিল। এই প্রথা বন্ধ করার উদ্দেশ্যে তিনি সরকারি সাহায্য প্রার্থনা করেন। যদিও এবিষয়ে সরকার ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেনি। নারীশিক্ষার বিস্তার , উচ্চশিক্ষার প্রসার , সর্বোপরি জাতিভেদ , অস্পৃশ্যতাসহ বিভিন্ন সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধেও তিনি লড়াই চালিয়ে গেছেন।


সমাজ সংস্কারক রূপে বিদ্যাসাগর যে সমস্ত ক্ষেত্রেই সফলতা পেয়েছিলেন তা নয়, তবুও মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি সমাজ সংস্কারে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। মহাদেব গােবিন্দ রাণাডে বিদ্যাসাগরের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেছেন , ‘গবেষণা ও মৌলিকত্ব এবং জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ও শ্রেষ্ঠ সম্পদ দিয়ে তাঁর দেশের স্ত্রী জাতির বন্ধন মুক্তির কাজ করে বিদ্যাসাগর আগামী দিনের ভারতের ঘরে ঘরে আদর্শ ব্যক্তি ও মানব কল্যাণের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন’।

সমাজ সংস্কারক , শিক্ষাবিদ এবং নারী শিক্ষার অন্যতম পথিকৃৎ ঈশ্বর চন্দ্র বিদ‍্যাসাগর আমাদের কাছে আজও প্রাসঙ্গিক কেননা এখনও দেশের আনাচে কানাচে নারীদেরকে লাঞ্ছিত করা হয়। আজও পণের বলি হতে হয় নারীদের। নারী নির্যাতন রোধ করতে, লিঙ্গ বৈষম্য দূর করতে, এবং নারীর ক্ষমতায়নের প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বিদ্যাসাগরের ভাবনাকে আমাদের বেশী বেশী করে ছড়িয়ে দিতে হবে।


বিদ্যাসাগরের মূল্যায়ন করতে গিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘তাঁর দেশের লোক যে যুগে বদ্ধ আছেন, বিদ্যাসাগর সেই যুগকে ছাড়িয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।’ এই নির্ভীক সমাজসংস্কারক সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি আরও বলেছেন এই ভীরুর দেশে তিনিই একমাত্র পুরুষ সিংহ। কবি মধুসূদন দত্ত তার নিঃস্বার্থ ব্রত ও হৃদয়বত্তার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
আজ এই মহান শিক্ষাব্রতী ও সমাজ-সংস্কারকের জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!